জীবনীগ্রন্থের ছদ্মবেশে উপন্যাস

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ ১৮৯৯—২৯ আগস্ট ১৯৭৬)
কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ ১৮৯৯—২৯ আগস্ট ১৯৭৬)

বাংলাদেশে জীবনীগ্রন্থ রচনার যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে তাতে কারও জীবনের নানা ঘটনার একত্রে সন্নিবেশ করাকেই আমরা জীবনীগ্রন্থ বলে ঠাওরাই। এটা যে একধরনের সাহিত্য, জীবনীগ্রন্থের রচয়িতারা তা প্রায়শ ভুলে যান। ফলে শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়ায় তাকে সাল-তারিখ আর ঘটনাপঞ্জির নীরস গবেষণা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। গোলাম মুরশিদ এ ক্ষেত্রে বিস্ময়কর ব্যতিক্রম। বাংলা জীবনীগ্রন্থকে তিনি জীবনীসাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। তাঁর এই সফলতার প্রথম স্বাক্ষর মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনীগ্রন্থ আশার ছলনে ভুলি। দ্বিতীয় সফলতার স্মারক কাজী নজরুল ইসলামের জীবনীগ্রন্থ বিদ্রোহী রণক্লান্ত।

বাংলা সাহিত্যের যে কবিকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কল্পকাহিনি চালু আছে তিনি নজরুল ইসলাম। এর কারণ অনেক। তিনি নিজে তাঁর জীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই লিখে যাননি। আত্মজীবনী লেখার জন্য নিজের মধ্যে যে একধরনের আভিজাত্য বা মধ্যবিত্তপনা বা গোছানোপনা থাকতে হয়, তা তাঁর মধ্যে একেবারেই ছিল না। তা ছাড়া বাধাবন্ধনহীন জীবনের আসক্তি তাঁকে শুধু ঘটনা থেকে ঘটনান্তরেই নিয়ে গেছে। হাজারো অলিখিত, অভাবিত ঘটনা হাজারো কল্পকাহিনির জন্ম দিয়েছে। বাল্যকাল থেকে দারিদ্র্যের অসহ তাড়নায় বাস্তুত্যাগী হওয়ায় শৈশব-কৈশোরও হয়েছে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। এই ধোঁয়াশা, কল্পকাহিনি, মিথের জগৎ ভেদ করে নজরুলের প্রামাণিক, বাস্তবভিত্তিক ও একই সঙ্গে সাহিত্যরসালো জীবনী রচনার কষ্টকর পথে তেমন কাউকে হাঁটতে দেখা যায়নি। এ কারণে নজরুলের অধিকাংশ জীবনী গালগল্প আর মিথে ভরা। গোলাম মুরশিদ তাঁর নজরুল-জীবনী বিদ্রোহী রণক্লান্ত বইয়ে এই দুঃসাধ্য সাধনটি করেছেন। অকারণ আবেগ বাদ দিয়ে খুব নির্মোহভাবে তিনি ‘জন্ম, পরিবার ও পরিবেশ’, ‘হাবিলদারের বিদ্রোহ’, ‘ক্ষণিকের ধূমকেতু, চিরদিনের আশা (লতা)’, ‘ঘর বাঁধার পথে’, ‘রাজনীতির চোরাবালিতে’, ‘রণক্লান্ত’, ‘স্বপ্ন ও বাস্তবতা’, ‘স্বেচ্ছানির্বাসন’, ‘আধ্যাত্মিকতার পথে’, ‘নীরব কবি!’ শিরোনামের ১০টি পরিচ্ছেদে কালানুক্রম ঠিক রেখে নজরুলের জীবনের নানা গলি-ঘুপচির আলো-আঁধারিতে আলো ফেলেছেন।

নজরুলকে নিয়ে মুরশিদের আলাদা কোনো গল্প ফাঁদতে হয়নি বা ভাণ-ভণিতা করতে হয়নি। কারণ নজরুলের জীবন তো উপন্যাসের চেয়েও নাটকীয় ঘটনায় ভরা। মুরশিদ শুধু পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষার পথ না মাড়িয়ে দারুণ সরল, প্রাঞ্জল আর সরল ভাষায় দৃশ্যের পর দৃশ্যের বর্ণনা করে গেছেন। প্রয়োজনীয় জায়গায় দুর্লভ সব তথ্যপ্রমাণ হাজির করেছেন। এসব তথ্যপ্রমাণ ভার বাড়ায়নি; বরং পাঠকের বিস্ময়রসকে আরও ঘনীভূত করেছে। বিদ্রোহী রণক্লান্ত যেন জীবনীগ্রন্থের ছদ্মবেশে এক উপভোগ্য উপন্যাস।

কিন্তু একটি বিষয় বলতেই হবে, মুরশিদ তাঁর পুরো বইয়ে নজরুলকে দেখেছেন কিছুটা তির্যকভাবে, কর্তৃত্ববাদী মনোভাব থেকে। মাঝেমধ্যেই মনে হয়েছে নজরুল ইসলাম এবং গোলাম মুরশিদে ঠিক যেন মিলমিশ হচ্ছে না। মুরশিদ রুচি, ব্যক্তিত্ব আর আভিজাত্যের ধারণায় ছাপিয়ে যাচ্ছেন নজরুলকে। গোলাম মুরশিদের এই সংকট কিন্তু মাইকেলের জীবনী রচনার ক্ষেত্রে তেমন দেখা যায়নি। সেখানে মুরশিদ বরং কম কর্তৃত্ববাদী, একজন সাধারণ বর্ণনাকারী, বিনয়ী আর যথেষ্ট নিম্নকণ্ঠ। নজরুলের ক্ষেত্রে এমনটি হলো কেন! তবে কি যাঁর জীবন নিয়ে লেখা হচ্ছে আর যিনি লিখছেন, তাঁর জীবনদর্শনের ফারাকের রাজনীতি এই বিভেদরেখা তৈরি করে!

বিদ্রোহী রণক্লান্ত: নজরুল-জীবনী

গোলাম মুরশিদ

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮

৫৫২ পৃষ্ঠা, দাম ৮০০ টাকা।