জীবনটা তছনছ করে দিয়েছিল 'নীল ধ্রুবতারা'

>আফজাল হোসেন। চিত্রশিল্পী, েলখক ও অভিনেতা। নতুন এই িবভাগে তিনি লিখেছেন তাঁর প্রিয় ৫টি বিষয় নিয়ে

১. গান
গানটাকে কিছুতেই কান ও মন থেকে সরানো যেত না
আমার প্রিয় গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’। তখন ছাদের ওপর গোল হয়ে বসে রেডিওতে অনুরোধের আসর শোনা অভ্যাস ছিল। মাথার ওপর আকাশ। সামনে বড় অ্যালুমিনিয়ামের গামলায় পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ আর ঘানি ভাঙানো সরষের তেল দিয়ে মুড়ি মাখানো। মনে আছে, চিবানোর সময় মুখের মধ্যে কুড়মুড় শব্দ হতো; তাতে গান শোনা নষ্ট হবে বলে মুড়ি আর খাওয়া হতো না। একটা অপছন্দের গান বাজলে তবেই ছিল আমাদের মুড়ি খাওয়ার সময়। ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’ গানটা শোনার পর থেকে অদ্ভতু এক অস্থিরতা পেয়ে বসেছিল। যেখানে, যেভাবেই থাকি, গানটাকে কিছুতেই কান ও মন থেকে সরানো যেত না। বলা যায়, ছকের জীবনটা তছনছ করে দিয়েছিল ‘নীল ধ্রুবতারা’।

পথের পাঁচালী
পথের পাঁচালী

২. চলচ্চিত্র
‘পথের পাঁচালী’ আলাদা বোধ তৈরি করে দিয়েছিল
প্রিয় সিনেমা কোনটা? অর্ধশত বছরের বেশি বেঁচে থাকার পর প্রিয় একটা সিনেমার নাম উচ্চারণ করে স্বস্তি মেলে না। এ–ও ঠিক, অসংখ্য প্রিয় ছবির ভিড়ে কোনো একটা নাম মনে আলাদা জায়গাজুড়ে থাকে। তেমন জায়গা নিয়েই আছে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী। পথের পাঁচালীর প্রতি বিশেষ দুর্বলতা তৈরি হয়ে আছে সেই দেখার কাল থেকেই। চলচ্চিত্রের ভাষা নিয়ে মাথা ঘামানো তখনো শুরু হয়নি। এই চলচ্চিত্র দেখার পর দেখা সিনেমার তালিকায় একটা নতুন নাম যুক্ত হলো এমন নয়, পথের পাঁচালী দেখে ভাষাহারা হয়ে যেতে হয়েছিল। ভাষা হারিয়ে পাওয়া গিয়েছিল নতুন এক ভাষা, নতুন জ্ঞান। এই সিনেমাটা আমাদের বয়সীদের মধ্যে আলাদা বোধ নিয়ে সিনেমা দেখার তাগিদ তৈরি করে দিয়েছে নিঃসন্দেহে।
বয়সে যখন অনেক ছোট, সেই সময়ে হোস্টেল পালিয়ে ১১ মাইল দূরে এক গ্রামের মেলায় টিকিট কেটে প্যান্ডেলে যে সিনেমাটা উপভোগ করেছিলাম, তা তো জীবনের এক বিশেষ ঘটনা হয়ে টিকে আছে, থাকবে। মনে আছে, জ্যোৎস্না রাতে পাঁচিল টপকে পাঁচটা সাইকেলে চেপে আটজন বন্ধুর সিনেমা দেখার উত্তেজনাময় মহা–অভিযাত্রা। সেই সময়ে ওই সিনেমাটা তো সিনেমার ঘোর তৈরি করতে পেরেছিল। ভালো ছবি, মন্দ ছবি—এসব বোঝার বয়স তখন নয়, কিন্তু মাথার ওপর চাঁদ বয়ে নিয়ে সিনেমা দেখে ফেরার সময় রাত ভেঙেচুরে আমরা যে সিনেমার ভালো লাগা নিয়ে হুলুস্থুল আলোচনায় মেতেছিলাম, জীবনে তা ছিল এক স্বপ্ন সমান অভিজ্ঞতা। ছবিটার নাম ছিল জোয়ার এল।

৩. উপন্যাস
নতুন উপলব্ধি আমদানি করেছিল ‘বৃষ্টির ঘ্রাণ’
প্রিয় উপন্যাস শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বৃষ্টির ঘ্রাণ। আগে–পরে বহু উপন্যাস বিবিধ কারণে মনে দাগ কেটেছে। কিন্তু মনে এখনো প্রিয় হিসেবে ঘুরঘুর করে এই উপন্যাসটা। এটা আমাদের তারুণ্যকে নতুন মোড়ে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। বৃষ্টির ঘ্রাণ নতুন উপলব্ধি আমদানি করেছিল প্রাণে–মনে। জীবনে তেমন উপলব্ধি দরকারি কি না তা নিয়ে তুমুল তর্কে নেমেছিল যৌবন।

সেলিম আল দীনের নাটক ধাবমান
সেলিম আল দীনের নাটক ধাবমান

৪. মঞ্চনাটক
অনুভবে ‘ধাবমান’
প্রিয় মঞ্চনাটক সেলিম আল দীনের ধাবমান। সেলিম আল দীনের সব নাটকই প্রিয়, তবে ধাবমান–এর কথা বিশেষ করে বলার কারণ, এই নাটকের ভাবনাবিশেষ। এখানে নাট্যকার মানুষকে অতিক্রম করে একটা পশুর ভাব–অনুভব যে ব্যক্ত করতে চেয়েছেন, তা রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। নির্দেশক শিমূল ইউসুফ যুক্ত করেছিলেন আরও এক অসাধারণত্ব—মানুষের বিশেষ পরিবর্তন না ঘটিয়ে অভিনয়ের সময় এই মানুষটিই রূপায়ণ করবে সোহরাবরূপী ষাঁড়ের চরিত্র—দর্শকমনে এই বিশ্বাস স্থাপন করতে চেয়েছিলেন নির্দেশক এবং সে চেষ্টা বৃথা যায়নি। ধাবমান–এর ভাব–ভাষা দর্শকচিত্তে ঢেউলাগা জলে জ্যোৎস্নার মতো ঝলমলাতে থাকে।

পাবলো পিকাসোর ভাস্কর্য
পাবলো পিকাসোর ভাস্কর্য

৫. শিল্পকলা
পাবলো পিকাসোর ভাস্কর্য
প্রিয় চিত্রকর্ম না বলে প্রিয় শিল্পকর্মের কথা বলি। গিয়েছিলাম নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট গ্যালারিতে। সৌভাগ্য, সে সময়টাতে পাবলো পিকাসোর বেশ কিছু শিল্পকর্ম সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছিল। সেখানে লোহার তৈরি ভাস্কর্য, ছাগল দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। মানুষ কেন শিল্পী এবং শিল্পী নয়—ওই শিল্পকর্ম দেখে এর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া হয় । গ্রামের মানুষ আমি, গ্রামে জন্ম, বেড়ে ওঠা। ছাগল তো সারা জীবন কম দেখা হয়নি, কিন্তু কখনোই মনে হয়নি ছাগলের গড়ন এমন শিল্পিত, সে প্রাণীতে এমন অসাধারণত্ব রয়েছে। সেদিন মনে হয়েছিল, দেখার জন্য চোখ রয়েছে কিন্তু চোখ সব দেখায় না, মন দিয়েও অনেক কিছু দেখতে হয়।