টোকাই: বিবেকমঞ্চে ৪০ বছর

টোকাই নিছক কোনো কমিক চরিত্র নয়, কেবল হাস্যরস পরিবেশন তার উদ্দেশ্য নয়
টোকাই নিছক কোনো কমিক চরিত্র নয়, কেবল হাস্যরস পরিবেশন তার উদ্দেশ্য নয়

আত্মীয়-পরিজন কেউ নেই ওর; ফুটপাতে ঘুমায়, পার্কের বেঞ্চির কোণে বসে ঝিমায়। ডাস্টবিন থেকে ময়লা ঘেঁটে ফেলনা কুড়িয়ে বস্তায় ভরে। তখন ওর দেখা হয়, কথা হয় কাক ও কুকুরের সঙ্গে। উচ্ছিষ্ট খেতে খেতে কুকুর বলে, ‘মানুষরে আমার খুব ভয়...’। ওর উত্তর, ‘আমারও।’

পথবাসী ছন্নছাড়া রসিক বালকটির একটি নাম আছে। এই নামে সবাই ওকে চেনে। ওর নাম ‘টোকাই’। ওর বাবাই রেখেছেন এই নাম। বাবার নাম রনবী। ছেলের ছোট্ট নামটির সঙ্গে মিলেমিশে থাকার জন্য নিজের নামকেও তিনি সংক্ষিপ্ত করেছেন। বাবার পুরো নাম রফিকুন নবী। শিল্পী রফিকুন নবীর বিবেকজাত ওই শিশুর বয়স এখন চল্লিশ। বয়স বাড়লেও শিশুটি শিশুই রয়ে গেছে। চল্লিশে এসে চালশে হয়ে যায়নি ওর কথাবার্তা। কারণ, বিবেকশিশুর বয়স বাড়ে না। গৃহহীন শিশুর অতিসংবেদী মনই শুধু পারে নিঃশঙ্কচিত্তে সত্য উচ্চারণ করতে; বেপরোয়া ভঙ্গিতে সমাজ ও রাষ্ট্রের সব অন্যায় ও কপটতা লক্ষ্য করে ছুড়তে পারে বিদ্রূপের বাণ।

রাষ্ট্র যখন শিষ্ট আচরণ করে না, নষ্ট-ভ্রষ্ট কুশীলবেরা সমাজকে বেড়ি পরায়, রক্তাক্ত হয় মানবতা, তখন বিবেকের নিরপেক্ষ মঞ্চে ওই শিশুই একক বক্তা। নেতিপীড়িত কালের অসহ তাপে অতিষ্ঠ শিল্পী রনবীরই মুখপাত্র ওই চিরশিশু টোকাই।

সেই ১৯৭৮-এ জন্ম টোকাইয়ের। সামরিক, ছদ্মসামরিক, গণতান্ত্রিক, নিমগণতান্ত্রিক, শাসকের কত-না চক্র ও চক্রান্তে কেটে গেছে চার দশক। তবু ফুটপাতে বসে আছে টোকাই। ওর গৃহ নেই। আকাশচুম্বী দালানের পায়ের কাছে ও যেন আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে। ওর রাগ, অভিমান, তীব্রতা হারায়নি; বিদ্রূপ ও মশকরায় আগের মতোই তীক্ষ্ণ।

শিল্পী রফিকুন নবীর আঁকা টোকাই
শিল্পী রফিকুন নবীর আঁকা টোকাই

টোকাই কিন্তু কোনো কমিক চরিত্র নয়। নিছক হাস্যরস পরিবেশন ওর উদ্দেশ্য নয়। খেয়ালি-হেঁয়ালি ঢঙের সংলাপে ও আমাদের ন্যায়-অন্যায় বোধে ঘা মারে। দুষ্ট ও শিষ্টের সমীকরণটা ও আমাদের জানিয়ে দেয়। ওর কথার উপরিতলে কৌতুক থাকলেও ভেতরে অন্তর্জ্বালা আছে। নেতার দাপট, ধনাঢ্যের সুখের অসুখ, বিলাসী জীবনের কপট দীর্ঘশ্বাস—এসব দেখে টোকাইয়ের মন খেপে থাকে। তবে ও কখনো আগ বাড়িয়ে কথা বলে না; মন্তব্য করে না। ওর প্রতিপক্ষ কথা বললে তবে উত্তর দেয়। দুটি মাত্র সংলাপের পথনাটক যেন শিল্পী রফিকুন নবীর টোকাই। সুখী মানুষ প্রশ্ন করে, ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়তাছে তো...চিন্তায় আছি। তোর চিন্তা কী? টোকাইয়ের বুদ্ধিবাণ নিক্ষেপ, ‘নিজেরই দাম নাই! ভাবুম কেমনে...’। টোকাই চরিত্র নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণে গেলে সামষ্টিক মানুষের বিবেকবোধই প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এই সাধারণ মানুষ যুগে যুগে প্রতাপশালী শাসক-শোষকের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হয়ে লড়তে পারেনি; কিন্তু ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে প্রভাবশালীকে ঠিকই আক্রমণ করেছে। সু ও কু-এর রূপ পরিস্ফুট করেছে রূপকী ভাষায়। এর প্রমাণ আমরা দেখতে পাই লোকসাহিত্যের গল্পগাথায়। শিয়াল ধূর্ত, বিড়াল ও বক ভণ্ডতপস্বী, এভাবে পশুপাখির আচরণে মানুষের চালাকি, চতুরালি ও নিষ্ঠুরতার কথা ব্যক্ত হয়েছে। নকশা সাহিত্য, ব্যঙ্গচিত্র ও লোকচিত্রে উনিশ শতকের কলকাতায় কালের দুষ্টরূপ ফুটে উঠেছে শ্লেষ ও ব্যঙ্গের ভাষায়। ভ্রষ্টচরিত্রের বাবু-বিবিদের সমালোচনা করে কালীঘাটের পটুয়ারা সেদিন যে ছবি এঁকেছেন, তা-ই বাঙালির আধুনিক ক্যারিকেচার বা ব্যঙ্গচিত্রের আদি দৃষ্টান্ত। সেই পরম্পরার স্পর্শে আধুনিক ব্যক্তি-শিল্পী কার্টুনিস্ট হওয়ার প্রণোদনা পেয়েছেন। বেঙ্গল স্কুল পর্বে গগনেন্দ্রনাথ এবং বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্পী জয়নুল, কামরুল প্রমুখ সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে ক্যারিকেচার শিল্পে ছদ্মনামে আবির্ভূত হয়েছেন। কামরুল হাসান তো আমৃত্যু দুষ্ট শাসকের বিরুদ্ধেই লড়ে গেছেন।

রফিকুন নবীও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। টোকাই-জনক নিঃসন্দেহে রাজনীতিসচেতন শিল্পী। ভাবনার দিক থেকে সাম্যবাদী দর্শনের প্রতি তাঁর পক্ষপাত রয়েছে। তাই ধনী ও গরিবের বৈষম্যের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি তিনি সম্প্রচারিত করেছেন তাঁর টোকাইয়ের মুখ দিয়ে।

তবে রফিকুন নবীর মধ্যে বাস করে দুই শিল্পীসত্তা। এক সত্তা জলে-তেলে-অ্যাক্রিলিকে-প্রিন্টে ইমেজ রচনা করে প্রফুল্ল নিসর্গের আর নিসর্গলীন মানুষ ও প্রাণিকুলের; অন্য সত্তা দুঃসহ বর্তমান পর্যবেক্ষণ করে বিপন্ন মানবতার বার্তা প্রেরণ করে টোকাই নামের ক্যারিকেচার শিল্পে।

প্রতিদিন নিসর্গ ও জীবনের রূপ পাঠ করতে হয় সৃজনশীল মানুষকে। শাশ্বত সুন্দরে লীন হয়েও রচনা করা যায় অভূতপূর্ণ শিল্পী। কিন্তু রফিকুন নবী তাতে তুষ্ট নন। তুষ্ট নন তিনি শিল্পীজীবনের সূচনাপ্রহর থেকে। পাকিস্তান আমলেও আইয়ুবি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তিনি কার্টুন এঁকেছেন। জেদি, রাগী, অভিমানী, কৌতুকপ্রিয়, সর্বহারা পথবাসী টোকাইই এখন শিল্পীর সবচেয়ে আদরের সন্তান। সেই শিশু শুধু আমাদের হাসায় না, গভীরভাবে ভাবায় এবং মর্মবিদ্ধ করে কাঁদায়ও। একবার একজন তাঁকে প্রশ্ন করেছিল, ‘তোর কি কিছুই থাকতে নেই? মানে...রাগ...অভিমান...।’ টোকাইয়ের উত্তর, ‘থাকলেই বা দেখামু কাগো?’