গোয়াংজু লিটারেচার ফেস্টিভ্যালের খণ্ডস্মৃতি

গোয়াংজু লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে তালাশ উপন্যাসের লেখক শাহীন আখতারের সঙ্গে উপন্যাসটির কোরিয়ান অনুবাদক সিং হি জন
গোয়াংজু লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে তালাশ উপন্যাসের লেখক শাহীন আখতারের সঙ্গে উপন্যাসটির কোরিয়ান অনুবাদক সিং হি জন
>গোয়াংজু লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে দক্ষিণ কোরিয়ায় গিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতার। তিনি লিখেছেন সেই উৎসব নিয়ে

পাতাঝরার দিন

মেপল লিফ আর জিঙ্কগো লিফ। লাল আর হলুদ পাতায় সয়লাব গাছতল, পায়ে চলার পথ। গাছে গাছে এর মনকাড়া শোভা। রংবেরঙের ফুলের অভাব যেন পাতারা পুষিয়ে দিচ্ছে। রঙের বাহারে শামিল হয়েছে কুচকুচে সবুজ পাতার মাঝের গাঢ় কমলারঙা ফল—পার্সিমন। পরের মাসেই সব রং মুছে দিয়ে বরফ পড়তে শুরু করবে। বর্ণহীন হয়ে উঠবে প্রকৃতি। তাই উৎসবের দারুণ সময় এখন।

গোয়াংজু লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল এবার দ্বিতীয়বারের মতো হয়েছে। ২৫ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর। শেষের চার দিন লিট ফেস্ট, আর আগের বাকি সময়টা রাইটার্স রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম। কোরিয়ার সরকারি প্রতিষ্ঠান এশিয়া কালচার সেন্টারের (এসিসি) আমন্ত্রণে একে একে হাজির হন এশিয়ার বিভিন্ন দেশের লেখকেরা। রেসিডেন্সি প্রোগ্রামের শিডিউল ঢিলেঢালা। এসিসি ওরিয়েন্টেশন, এসিসি ট্যুর, রিডিং, হাইকিং। ম্যান বুকারজয়ী হ্যান ক্যাংসহ কোরিয়ান সাহিত্যিকেরাও শামিল হয়েছেন। নানা ভাষাভাষী লেখক। তাঁরা লেখেনও নিজ নিজ ভাষায়। ফিলিস্তিন, ভারত আর বাংলাদেশের আমি ছাড়া মিয়ানমারসহ পূর্ব এশিয়ার সব কজন লেখকের জন্যই পেশাদার ইন্টারপ্রেটারের ব্যবস্থা রয়েছে। অচিরেই হয়তো দক্ষিণ-পূর্ব আর পশ্চিম এশিয়ার সাহিত্যিকদের জন্যও হবে। রাতারাতি বাংলাসহ আর সব ভাষা শেখার প্রতিষ্ঠান খুলে পেশাদার ইন্টারপ্রেটার বানানো সম্ভব বইকি বর্তমানে এশিয়ার অন্যতম ধনী দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে। আপাতত আমাদের জন্য আছে ইংরেজি-কোরিয়ান ভাষার তরজমাকারী।

আমরা লেখকেরা যখন পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছিলাম, দুটি ভাষা ডিঙিয়ে ভাবের আদান-প্রদান করতে হচ্ছিল। তা বলে হাসি-ঠাট্টা, মিল-মহব্বত আটকে থাকেনি, কিছুটা ভুলভাবে বার্তা পৌঁছে যাওয়ার ঝুঁকি থাকলেও! অবশ্য সে রকম কোনো কেচ্ছা শোনা যায়নি। আয়োজকেরা আলোচনা-অনুষ্ঠান কম রেখে খোশালাপের দারুণ সব ব্যবস্থা রেখেছিলেন—ডিনারের পর ছোট ছোট বুকশপে রঙিন শেডের ল্যাম্প জ্বেলে বুক রিডিং, খাটো পায়ার টেবিলের নিচে পা লম্বা করে, কুশনে হেলান দিয়ে গ্লাস ঠোকাঠুকি, অজস্র পদের থালা-বাটি সাজিয়ে দীর্ঘ সময়জুড়ে খানাপিনা আর তুমুল আড্ডা, কখনো–বা ঘণ্টা ধরে হাঁটাহাঁটি গোয়াংজু-গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিবিজড়িত পাথুরে পথ ধরে, দল বেঁধে ঐতিহাসিক স্থান, পুরোনো হাট-বাজার আর প্যাগোডা পরিদর্শন, পদ্মাসনে বসে চা-উৎসবে অংশগ্রহণ ইত্যাদি। যেন উৎসব-আনন্দে খামতি পড়ে না কিছুতেই।

চলো একসঙ্গে হাঁটি

গোয়াংজু আলোর শহর। গণতন্ত্র আর মানুষের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে মৃত্যুবরণ করা অজস্র আত্মার শহর। ভবিষ্যতের পথ আলোকিত রাখতে গোয়াংজু মোমের আলো তুলে ধরেছে ঊর্ধ্বে। লিট ফেস্টের স্থান পর্বতবেষ্টিত গোয়াংজু নিয়ে এভাবেই বক্তব্য রাখছিলেন কোরিয়ান বক্তারা। দিনে দিনে ১৯৮০ সালের মে মাসের গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে আমরা সবিস্তারে জানতে পারি। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে এ ছিল ১০ দিনের গণ–অভ্যুত্থান, যা ছাত্ররা শুরু করেছিল, তারপর নির্মমভাবে দমন করা হয়েছিল। এতে হতাহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬২। নিখোঁজ ১২৪। সে সময়ে মেয়েরা যে ধর্ষিত হয়, তা ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ মুভমেন্টের সুবাদে সম্প্রতি জানা যাচ্ছে।

মে আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ করে লিট ফেস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় জাতীয় সেমেটারি ‘মে ১৮’ পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে। সারি সারি ঘাসে ঢাকা, ফুল আর ছবিতে সজ্জিত ফলক বসানো কবর। আমার নূর হোসেনের কথা মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’ স্লোগানটি। পাশে দাঁড়ানো ফিলিস্তিনি লেখিকা আদানিয়া তখন কার কথা ভাবছিলেন, প্রতিনিয়ত ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় যাঁর দেশের মানুষেরা? তা অজানা নয় ফেস্টিভ্যালের আয়োজকদের। গোয়াংজু গণতন্ত্রের লড়াইয়ের প্রতীক মাত্র। আর এ শহরে ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এশিয়া কালচার সেন্টার হচ্ছে একটি জানালা, যা দিয়ে এশিয়ার বিচিত্র সংস্কৃতির আদান-প্রদান ঘটবে। তা পশ্চিমের হেজিমনি রুখতে দরকারও—সূচনা বক্তব্যে বলছিলেন ফেস্টিভ্যাল অরগানাইজিং কমিটির চেয়ারপারসন পেইক নাক-চ্যাং। বিশ্বসাহিত্যের বাজার আজ আমেরিকা-ইউরোপের কবজাবন্দী। তারা এর গুণমান ঠিক করে এ নিয়ে বেসাতি করছে। তাতে এশিয়ার আঞ্চলিক সাহিত্য যে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে, তা থেকে উতরানোর চেষ্টা আমাদের করতে হবে। আমাদের হাঁটতে হবে একসঙ্গে।

জাতীয়  সেমেটারি  মে ১৮-তে এশিয়ান সাহিত্যিকেরা
জাতীয় সেমেটারি মে ১৮-তে এশিয়ান সাহিত্যিকেরা

শান্তির গান গাই, এশিয়ায়

যুদ্ধের আগুনে জ্বলছে এশিয়ার বিস্তৃত ভূখণ্ড—সিরিয়া, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন। টিভি খুললেই মোহনীয় ভঙ্গিতে লুটিয়ে পড়া হাইরাইজ বিল্ডিং, কঙ্কালসার শিশু, সারিবন্দী লাশ, ধুলা-ধোঁয়ার উদ্‌গিরণ, বাস্তুচ্যুত মানুষের কাফেলা।

আজকের যুদ্ধবাজেরাই শান্তির কারবারি। শান্তির পতাকা উড়িয়ে তলে তলে সমরাস্ত্র বেচাকেনা করে, সেনাবাহিনী সাজায়। ইসরায়েল ও তার বন্ধু আমেরিকার বেলায় তো সেই লুকোছাপাটুকুরও বালাই নেই। তাদের শান্তির পতাকা যুদ্ধ চায়, টমাহক মিসাইল চায়, টমাহক মিসাইল এখন শান্তির পবিত্র পতাকা—বলছিলেন ফিলিস্তিনি কবি জাকারিয়া মোহাম্মদ। তাহলে এমন জমানার একজন সাহিত্যিক কীভাবে শান্তির বার্তা দেবেন? তাঁর নিজের বোঝাপড়ার স্বরূপই–বা কী হবে? তা ধরাবাঁধা নিয়মে না থেকে বৈচিত্র্যময় বা প্রতীকীও হতে পারে কখনো কখনো।

তাইওয়ানের অর্কিড দ্বীপের তাও ট্রাইভের লেখক শ্যামন রাপনগান। ফ্রেঞ্চ সাহিত্যের গ্রাজুয়েট শ্যামন পেশায় মাছশিকারি। শীতের শেষে আর বসন্তের শুরুতে তাও ট্রাইভ ‘ফ্রাইং ফিশ’ উৎসব পালন করে। সুন্দরবনের মৌয়ালদের মতো নানাবিধ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান শেষে মাছ ধরতে যায় গভীর সমুদ্রে। শ্যামন জানান, এ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানই সমুদ্রের দেবতার সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করার তাও ট্রাইভের শান্তিচুক্তি।

ইয়ান লিয়ানকে চীনা সাহিত্যিক। তিনি গেল বছর নোবেল পুরস্কারের অনুবাদ বিভাগে মনোনীত হয়েছিলেন। সাহিত্যে শান্তির মতো ধোঁয়াশে বিষয়টি লেখক কীভাবে ইস্তেমাল করবেন, এ প্রসঙ্গে ইয়ান লিয়ানকে বলেন, নিজের জীবনের মতো অন্যের জীবনকে মূল্য দিতে হবে, যেভাবে এক উইঘুর নারী দিয়েছিলেন। উইঘুর মুসলিমরা বর্তমান চীনের সবচেয়ে নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠী। ইয়ান লিয়ানকের গল্পের সেই জনগোষ্ঠীর নারীটি পথের ধারে বসে বিশ্রাম নেওয়ার সময় এক প্যাকেট দাওয়াই পড়ে থাকতে দেখেন। ভাবেন নিশ্চয় ভুলে কেউ ফেলে গেছে। ঘরে হয়তো মরণাপন্ন রোগী আছে অচেনা লোকটির। তাই ফিরে আসবে এক্ষুণি। কিন্তু অচেনা লোকটি ফেরে না। উইঘুর নারী কদিন অপেক্ষা করে মাটিতে লম্বা বাঁশ পুঁতে এর আগায় ওষুধের প্যাকেটটা ঝুলিয়ে দেন। বাতাসে দোল খায় মানবতার নিশান। আর সেই নিশানই একদিন হারানো ওষুধের সন্ধান দেয় অচেনা লোকটিকে।

রিডিং সেশন

রিডিং সেশনে আমার সখী রঙ্গমালা উপন্যাসের অংশবিশেষ পড়তে গিয়ে মনে হলো, এ মহফিলে দুসরা কোনো প্রাণী নেই, যিনি আমার ভাষা বোঝেন। আমি যা পড়ব, তা ইংরেজি, কোরিয়ান, চাইনিজ, ভিয়েতনামি, তাইওয়ানিজ, ফিলিপিনো, বার্মিজ, মঙ্গোলিয়ান ভাষায় তর্জমা হয়ে গেছে। যথাসময়ে হেডফোন তুলে নিলেই হলো। এখন আমি যেভাবে খুশি পড়তে পারি—ডান থেকে বাঁয়ে বা ওপর থেকে নিচে। আমার ভাষা কেউ বোঝে না। অদ্ভুত এক স্বাধীনতা! ভাবতেই গা শিরশির করা খুশি খুশি ভাব হয়। মানুষের ঘরের চালে বা ঘরের কাছের গাছের ডালে লেজ দুলিয়ে পাখি যখন গান গায়, তখন এ রকম অনুভূতি হয় নাকি!

জাকারিয়া মোহাম্মদ যখন স্বরচিত আরবি কবিতা পড়ছিলেন, মনে হচ্ছিল কোরআন তিলাওয়াত শুনছি। সুরটা আজন্ম পরিচিত। অর্থ সুদূর পরাহত। ‘শয়তান’ শব্দটা কানে আসতে চমকে উঠি। পুরো রিডিং সেশনে আমার শোনা একমাত্র পরিচিত শব্দ ‘শয়তান’!

‘আমাদেরই গল্প’ তালাশ

আমার তালাশউপন্যাসের কোরিয়ান অনুবাদক, তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক সিং হি জন প্রায় আড়াই বছর আগে তালাশ-এর ইংরেজি অনুবাদ দ্য সার্চ পড়েন। ‘পড়ে আমি চমকে গেছি’—বলেই সিং হি তখন বলেন, ‘এ আমাদেরই গল্প।’

কথাটা শুনে আমি কিন্তু চমকাইনি। আমার মনে পড়ে, ২০০০ সালের টোকিও ট্রাইব্যুনালের কথা। প্রতীকী সেই ট্রাইব্যুনালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধর্ষণের শিকার কমফোর্ট নারীরা টোকিওতে হাজির হয়েছিলেন জাপানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে। অনেকের মধ্যে কোরিয়ান নারী কিম হাক সুনের কথা মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের কষ্টের কথাগুলো বলছি এ জন্য যে কোরিয়া আর জাপানের তরুণেরা জানুক, জাপান অতীতে কী করেছে।গোটা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের যুদ্ধাক্রান্ত নারীর ভাষ্যের সঙ্গে ১৯৭১ সালের ধর্ষণের শিকার নারীর অভিজ্ঞতার কত মিল! আর এ সমস্তটা মিলিয়েই ‘আমাদের গল্প’। এই ‘আমাদের গল্প’ তালাশ লেখায় অন্যতম প্রেরণা। টোকিও ট্রাইব্যুনালের আঠারো বছর পর, এশিয়ান লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল ২০১৮–তে কোরিয়ান ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে তালাশ। কিম হাক সুন বেঁচে নেই। ‘আমাদের গল্প’ হয়ে তাঁর দেশের মানুষের কাছে তালাশ পৌঁছেছে। ফিলিপিনো ভাষায় এর অনুবাদ নিয়ে আলাপ শুরু হয়েছে সম্প্রতি। যুদ্ধাক্রান্ত জনপদে তালাশ-এর এ পরিভ্রমণ চোখে পানি চলে আসার মতোই আনন্দের।