ইঙ্গিত ও ইশারার গল্প

নিরপরাধ ঘুম
নিরপরাধ ঘুম

একজন লেখকের কোনো একটি গল্প কোনো কারণে বিখ্যাত হয়ে গেলে তাঁর অন্য গল্পগুলো পাঠকের যথার্থ মনোযোগ পায় না, এ রকম উদাহরণ বিরল নয়। এক্ষেত্রে অগ্রজ লেখকদের মধ্যে সাইয়ীদ আতীকুল্লাহর ‘বুধবার রাতে’ বা শহীদুর রহমানের ‘বিড়াল’–এর কথা বলা যায়।

সুমন রহমানের ‘নিরপরাধ ঘুম’ গল্পটিও ওরকম। একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় গল্পটি সংক্ষিপ্ত তালিকায় চলে আসার পর পাঠকদের মধ্যে দারুণ কৌতূহল দেখেছি। এমনকি একই নামের একটা গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পরও পাঠকেরা প্রধানত ওই গল্পটি নিয়েই কথা বলছেন। অস্বীকার করব না, আমিও গল্পটি নিয়ে কৌতূহলী ছিলাম। কিন্তু বইটি হাতে পেয়ে ‘নিরপরাধ ঘুম’ পড়ার আগে প্রথম গল্প ‘আমার যত ভণিতা, জিনিয়াকে নিয়ে’ শিরোনামের সুপাঠ্য গল্পটি পড়ে মনে হলো, সব কটিই পড়তে হবে আমাকে। পড়ার পর আবিষ্কার করলাম, ‘নিরপরাধ ঘুম’-এর চেয়ে আমার কাছে অধিক প্রিয় হয়ে উঠেছে বইয়ের শেষ দুটো গল্প ‘হাবা যুবকের হাসি’ এবং ‘সুপারহিরো পরিবারে একটা খুব অর্ডিনারি পাতাঝরা দিন’। ‘নিরপরাধ ঘুম’ বিখ্যাত গল্প; নির্বিচারে, ক্রসফায়ারের গল্প ফেঁদে রাষ্ট্রীয় প্রযোজনায় যেসব হত্যাকাণ্ড চলছে বহুদিন ধরে, তারই একটুকরো ছবি এই গল্প। স্বাভাবিকভাবেই, এই দুঃসময়ে, এই ‘গণতান্ত্রিক’ স্বেচ্ছাচারিতার কালে যখন আমাদের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে ভয়ে ও শঙ্কায়, তখন এ রকম একটি বিষয় নিয়ে লেখা গল্প পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

শিল্পী: সব্যসাচী হাজরা
শিল্পী: সব্যসাচী হাজরা

তবে এই গল্পের ওপর অধিক মনোযোগের কারণে তাঁর অন্য গল্পগুলো অবহেলিত রয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যে দুটো গল্পের কথা বলছিলাম (‘হাবা যুবকের হাসি’ এবং ‘সুপারহিরো পরিবারে...’) সেগুলো ঠিক সাধারণ গল্প নয়। এ ধরনের গল্প খুব একটা পড়েছি বলেও মনে পড়ে না আমার। অটিজম-আক্রান্ত সন্তানকে নিয়ে এক দম্পতির অদ্ভুত এক ব্যক্তিগত যুদ্ধের গল্প ‘সুপারহিরো পরিবারে...’। কিছুটা প্রকাশিত আর অনেকখানি আড়াল করে যাওয়া এই গল্পের বিষাদ ও বেদনা পাঠককে দারুণভাবে নাড়া দেবে। আবার পরস্পরবিরোধী স্বভাবের দুই অদ্ভুত যুবক, শিমুল আর মাহাদীর গল্প ‘হাবা যুবকের হাসি’ পড়ে এক বিমূঢ় অনুভূতির সৃষ্টি হবে মনে। এই দুজন পরস্পরের বন্ধুও বটে। শিমুল সমকামী না হয়েও সেই ‘অপবাদ’ বয়ে বেড়ায় কেবল তার স্বভাবের কারণে, অথচ একসময় দেখা যায়, সে-ই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এক গৃহী জীবন-যাপন করছে। অন্যদিকে, যে মাহাদী শিমুলের সমকামিতার নীরব অভিযোগ তুলে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, সেই মাহাদীকেই অনেক দিন পরে দেখা যায় সমকামীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হতে। এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব যেন! আমরা লক্ষ না করে পারি না, লেখক বলছেন, ‘প্রতিটি পুরুষের মধ্যে নারী থাকে। নারীর মধ্যে পুরুষ। নারী আর পুরুষ দুটো চরম ধারণা। একটা ভীষণ লম্বা স্কেলের দুই প্রান্তে এই ধারণা দুটো থাকে। গোটা মানবসভ্যতা থাকে তার মাঝখানে।’

অথবা বহুকাল পর ফেসবুকের একটা ছবিতে সমকামীদের অধিকার আদায়ে আন্দোলরত মাহাদীর ছবি দেখে শিমুলের বুকের গভীরে কোথাও মোচড় দিয়ে ওঠে আর ভাবে, ‘আমার জীবন অন্য রকম হতে পারত। নিজের একটি জীবন হতে পারত।’ এ সময়ই আমরা বুঝে যাই, আমরা আসলে কেউই নিজের জীবনটি যাপন করি না, যাপন করি অন্য কারও জীবন।

এই গল্পগুলো না পড়লে, পাঠক হিসেবে অনেক কিছুই না-বোঝা থেকে যেত আমার। সব কটি গল্প পড়ে মনে হয়েছে, এই লেখকের ভেতরে এক বিরান-বিরাট খাঁ খাঁ প্রান্তর আছে, হাহাকার-ভরা। হয়তো ব্যক্তি-লেখককে দেখে তা বোঝা যায় না। অর্থাৎ তাঁর সামাজিক উপস্থিতি, অন্যদের সঙ্গে তাঁর আচরণের ধরন, তাঁর হাস্যমুখরতা ইত্যাদি আসলে তাঁর আদিগন্ত বিষাদকে আড়াল করে রাখে। সম্ভবত এই লেখকের সামাজিক উপস্থিতির ভেতরে তাঁকে খুঁজে পাওয়া কঠিন, অন্তত তাঁর বিষাদ ও বিষণ্নতাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন, ওসব পাওয়া যাবে তাঁর গল্পের ভেতরে। কবিতার মতো ইঙ্গিতময় আর মাধুর্যভরা এই গল্পগুলো পড়ার জন্য পাঠককে সাদর আমন্ত্রণ জানাই।