শিল্পী মবিনুল আজিমকে মনে করে

মবিনুল আজিম
মবিনুল আজিম

বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলা চর্চার ইতিহাসটা দীর্ঘদিনের নয়, ১৯৪৮–এ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও তাঁর কয়েক সতীর্থের হাতে গড়া ঢাকা আর্ট কলেজের যাত্রা শুরুর দিন থেকেই এর সূত্রপাত। পঞ্চাশের দশকেই এই প্রতিষ্ঠানটি কাঙ্ক্ষিত গতি পায় এবং এক আশ্চর্য অর্জনের ইতিহাস রচনা করতে থাকে। ওই ইতিহাসের এক শক্তিমান অথচ বর্তমানে বিস্মৃতপ্রায় শিল্পী মবিনুল আজিম। তাঁকে বিস্মৃত হওয়ার পেছনের একটি কারণ তাঁর অকালে হারিয়ে যাওয়া। ১৯৭৫ সালে ১ নভেম্বর মাত্র ৪১ বছর বয়সে তিনি মারা যান। অন্য কারণটি তাঁর দীর্ঘদিনের প্রবাসজীবন। যে সময়টাতে তাঁর বন্ধুরা ঢাকায় বসে শিল্পচর্চা করছেন এবং মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন, সে সময়টা মবিনুল কাটাচ্ছেন করাচিতে। সেখানে তাঁর নামডাক ছিল প্রচুর, কিন্তু ঢাকায় বসে তাঁর খবর রাখা অনেকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি যদি শিল্পচর্চার জন্য ঢাকাকে বেছে নিতেন, তাহলে ভাষা আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিয়ে মানুষের আবেগটা তাঁকে আরও কাছে টেনে নিত। তবে শিল্পীদের জন্য ঢাকার জীবন ওই সময়টা কঠিনই ছিল। করাচি তাঁকে সুস্থিরতা দিয়েছিল। অবশ্য স্বাধীনতার পর ঢাকায় ফিরে তিনি নতুন করে শুরু করেছিলেন; এবং শিল্পবোদ্ধাদের সমীহ আদায় করেছিলেন। মৃত্যু এসে তাতে বাধা দিল। তারপরও তিনি যা রেখে গেছেন, তা তাঁকে আমাদের শিল্প আন্দোলনের পথিকৃৎদের সারিতে একটি আসন দিয়েছে।

মবিনুল আজিমের চিত্রকর্ম
মবিনুল আজিমের চিত্রকর্ম

প্রকৃতিকে আঁকতেন মবিনুল, মানুষকেও। কিন্তু অন্যদের থেকে ভিন্নভাবে। মানুষ, অবয়ব বা ফিগারের একটা আভাস আঁকতে পছন্দ করতেন তিনি, আদলটা সম্পূর্ণ আঁকার পরিবর্তে, যদিও তা-ও তিনি যথেষ্ট করেছেন। প্রকৃতি আঁকতে গিয়ে রংটাকে ব্যবহার করতেন প্রধান ভাষা হিসেবে, তারপর একটা আধা বা পুরোপুরি বিমূর্ত ফর্মে তাকে সাজাতেন। মবিনুলের মতো এত স্বচ্ছন্দ, ছন্দিত এবং প্রাণময় রং ব্যবহার কম দেখা যায়। বিমূর্তের প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর, তবে ব্রাশের কারুকাজে বিমূর্তকে রহস্যময় করে তুলতেন, যেন ছবির একটু গভীরে উঁকি দিলে ছবির জীবনটা বোঝা যাবে। শেষ দিকে প্রকাশবাদী কিছু ছবি এঁকেছেন—রং ও গাঢ়বদ্ধ ফর্মকে অবলম্বন করে, যা দেখলে বোঝা যায়, তিনি একটা মোড় ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, হয়তো অনিশ্চিত হয়ে আসা সময়টাকে একটু বাজিয়ে দেখার জন্য।

মবিনুলের যেসব ছবি করাচি বা অন্যত্র রয়ে গেছে, সেগুলো দেখা তো আর সম্ভব নয়। তবে তাঁর পরিবারের, বিশেষত তাঁর সহধর্মিণীর সংগ্রহে কিছু আলোকচিত্র আছে, কয়েকটি ছবিও আছে। সেগুলো দেখা হয়েছে। আরও কিছু ছবি কারও কারও ব্যক্তিগত মালিকানায় বা দু-এক গ্যালারিতে দেখেছি। আমার মনে হয়েছে, তাঁর ছবিগুলো প্রকাশে যত বলিষ্ঠ, মেজাজে তত উদার। একটা গভীরতার আহ্বান ছবিগুলোতে পাওয়া যায়। এমনকি তাঁর প্রকাশবাদী ছবিতেও। যেন তারা বলছে, সময়টা কঠিন, কিন্তু মানুষ যেন কঠিন না হয়, শিল্প যেন কঠিন না হয়ে যায়। তাঁর ছবিগুলো অন্য কারও মতো নয়। এই নিজস্বতা, এই স্বাতন্ত্র্য এবং এই উৎকর্ষ বুঝিয়ে দেয়, তিনি আসলেই কত বড় শিল্পী ছিলেন।

নভেম্বরের ১ তারিখ এই শিল্পীর মৃত্যুদিবস গেল। আমি অবশ্য তাঁকে স্মরণ করি তাঁর মৃত্যুহীন অর্জনের জন্য। স্বল্প জীবনে যা রেখে গেছেন, তাই আমাদের সম্পদ।