'নিঃসঙ্গতা কাটাতেই লেখক হয়েছি'

যেখানেই যান, সেখানে পরিবার–পরিজনকে সঙ্গে নিয়ে যান অ্যাডাম জনসন। ছবি: সাইফুল ইসলাম
যেখানেই যান, সেখানে পরিবার–পরিজনকে সঙ্গে নিয়ে যান অ্যাডাম জনসন। ছবি: সাইফুল ইসলাম

সদ্যসমাপ্ত ঢাকা লিট ফেস্ট উপলক্ষে ঢাকায় এসেছিলেন পুলিৎজারজয়ী আমেরিকান লেখক অ্যাডাম জনসন। ২০১২ সালে উত্তর কোরিয়ার সমাজব্যবস্থার ওপর দ্য অরফ্যান মাস্টারস সন নামে একটি উপন্যাস লিখে এ পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। প্রথম আলোর সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় তিনি বলেছেন সেই বই লেখার আদ্যোপান্ত, বলেছেন তাঁর লেখকজীবনের কথা।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অদিতি ফাল্গুনী

অদিতি ফাল্গুনী: যত দূর জেনেছি, আপনার মা ছিলেন সফল চিকিৎসক এবং পিএইচডি নিয়ে ব্যস্ত। বাবা ছোটখাটো কাজ করতেন চিড়িয়াখানায়। মা–বাবার বিচ্ছেদের পর আরও কাজের ভেতরে ডুবে গেলেন আপনার মা। মায়ের কাছেই থাকতেন আপনি। তীব্র নিঃসঙ্গতাবোধই কি আপনাকে লেখার দিকে ঠেলে দিয়েছে?

অ্যাডাম জনসন: আসলে নিঃসঙ্গতা কাটাতেই লেখক হয়েছি। আমার শৈশবে কথা বলার মতো বাসায় কেউ ছিল না বলে এখন যেখানে যাই, সবার সঙ্গে কথা বলি। প্রাচ্যের বড় পরিবারগুলো আমাকে খুব টানে। একটি পরিবারে কত কত মানুষ! খাবার টেবিল ঘিরে অনেকে খাওয়াদাওয়া করছে, হইচই আর হাসি-ঠাট্টা করছে! এটা ভাবাই যায় না আমাদের পশ্চিমের জীবনে। আজ তাই আমি যেখানেই যাই, আমার পরিবার সঙ্গে নিয়ে যাই। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে আমার পরিবার। তবে সম্প্রতি আমার স্ত্রীর স্তন ক্যানসার হওয়ায় এবার তিনি সঙ্গে আসেননি, মেয়েরাও না।

অদিতি:০০৩ সালে বের হওয়া আপনার প্রথম উপন্যাস প্যারাসাইটস লাইক আস-এ প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপক হান্নাহ ও তার গ্র্যাজুয়েট ছাত্ররা ১১ থেকে সাড়ে ১১ হাজার বছরের পুরোনো ক্লোভিস সভ্যতার স্মারক এক কবরখানার সন্ধান পায়। এটা শেষ হিমবাহ যুগের প্যালিও-ইন্ডিয়ান সভ্যতার সময়ের কথা। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে একাধিক ডিগ্রি নিয়ে প্রথম উপন্যাসেই কেন নৃতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে কাজের আগ্রহ তৈরি হলো আপনার ভেতরে?


অ্যাডাম:
আসলে আমার দেশ আমেরিকাতেই আমার সঙ্গে নানান কাজের সূত্রে কিছু মানুষের পরিচয় হয়েছিল, যাঁরা এই একুশ শতকেও তির–ধনুক ব্যবহার করছেন, পশু শিকার করছেন। তাঁরা এমনভাবে জীবনযাপন করছেন, যেন তাঁরা হাজার বছর আগের মানুষ। কাজেই আমি কৌতূহলী হলাম যে কেন তাঁরা আজকের যুগেও প্রযুক্তি ও আধুনিক জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকছেন। এটা করতে গিয়েই তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয় হলো। দেখলাম, তাঁদের রক্তে রয়েছে ভিন্ন ডিএনএ আর আছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের নানান গল্প বা কিংবদন্তী।

অদিতি: এই বইয়ে কোন জাতিগোষ্ঠীর কথা বলেছেন, অ্যাংলো-স্যাক্সন গোত্রভুক্ত ফ্রাঙ্কিস নাকি আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান?

অ্যাডাম: উত্তর আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের ভেতরেই কাজ করেছি আমি। তারা প্রায় সবাই সাইবেরিয়া ও মঙ্গোলিয়া থেকে এসেছিল। কাজেই তাদের রয়েছে এশীয় ঐতিহ্য।

অদিতি: তাদের কি আজও কোনো লিখিত সাহিত্য বা ইতিহাস নেই?

অ্যাডাম: না, এখন তাদের কিছু লিখিত কাগজপত্র তৈরি হচ্ছে। তবে তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রায় সমগ্রটাই শ্রুতিপরম্পরায় প্রবাহিত।

অদিতি: আপনি নিজে শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের মানুষ। আজকের উত্তর আমেরিকান সভ্যতা মূলত ‘শ্বেতাঙ্গ অভিবাসী/বহিরাগত’দের সভ্যতা। এই বহিরাগতরা রেড ইন্ডিয়ান সভ্যতা ও ওই সভ্যতার অজস্র মানুষকে ধ্বংস করেছে। তো, শ্বেতাঙ্গ হয়েও রেড ইন্ডিয়ানদের নিয়ে লিখলেন আপনি, আপনার দিক দিয়ে এটা কি তবে গণহত্যার এক ধরনের দায় বা দেনা শোধ?

অ্যাডাম: দেনা বা দায় শোধের কথা যদি বলেন, তাহলে বলতেই হয় যে গণহত্যার দায় কখনোই শোধ করা যায় না। ইউরোপের আগ্রাসনকারীরা যখন উত্তর আমেরিকায় এল, প্রায় ৯০ ভাগ রেড ইন্ডিয়ান মারা পড়ল ইউরোপ থেকে সভ্য মানুষের আনা নানান রোগের বীজাণুর সংক্রমণে। সভ্য দুনিয়ার এত সব রোগের সঙ্গে তাদের পরিচয়ই ছিল না, জানত না কীভাবে ওদের সঙ্গে লড়তে হয়! প্রাণে টিকে থাকার জন্য ইউরোপীয় কামান-বন্দুকের মুখে তাদের অনেককেই গ্রহণ করতে হলো ইউরোপের খ্রিষ্টবিশ্বাস ও জীবনাচার। যারা এই বশ্যতা মানতে চায়নি, তারা ধ্বংস হলো। কাজেই তাদের ভেতর নিজেদের গৌরবগাথা লিখে যেতে পারবে, এমন মানুষ বলতে গেলে বেঁচে থাকল না প্রায় কেউই।

অদিতি: আপনার বিখ্যাত উপন্যাস দ্য অরফ্যান মাস্টারস সন উত্তর কোরিয়ার প্রেক্ষাপটে লেখা। উত্তর কোরিয়ার এক শ্রমশিবিরে এক বন্দীর রোজনামচা পড়ে আপনি ঠিক করলেন যে এই দেশ নিয়ে উপন্যাস লিখবেন। সে জন্য ওই দেশে কাজের জন্য আবেদন করলেন। এরপর ওখানে ছিলেন বেশ কিছুদিন। সেই অভিজ্ঞতাটি কেমন ছিল?

অ্যাডাম: উত্তর কোরিয়া ভ্রমণ কঠিনই ছিল। আমি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করলাম, যেন পিয়ংইয়ংয়ে খুব স্বল্প সময়ের জন্য হলেও একটি কাজ পাই। খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের একটি কাজ পেলামও। তবে উত্তর কোরিয়া গিয়ে দেখলাম, সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি নেই। এটা বোধ হয় পৃথিবীর একমাত্র জায়গা, যেখানে বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলা যায় না। অথচ আমি এর আগে চীন, জাপান, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ায় ঘুরেছি। তো, উত্তর কোরিয়ায় এই অবস্থা দেখে ভাবলাম যে এখানে কথাই যদি বলতে না পারি, তবে দেশের প্রকৃত হাল কীভাবে জানব? তখন ঠিক করলাম, একটি দেশের হাল তো সে দেশের রাস্তাঘাট, দালান-কোঠা বা মানুষের মুখ দেখেও কিছুটা পড়া যায়। বোঝা যায়, ব্যক্তি হিসেবে তারা কতটা স্বাধীন। এ সময়ই আমি ক্যাং চোলেহওয়ানের দ্য অ্যাকুরিয়াম অব পিয়ংইয়ং পড়ছিলাম। বইটি গভীরভাবে ছুঁয়ে যায় আমাকে। ১৯৫৭ সালে এ দেশ থেকে মাত্র ২৭ হাজার উত্তর কোরীয় বাইরের পৃথিবীতে পালাতে পেরেছে। তবে উত্তর কোরিয়ার সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ প্রবল। এখানকার সমাজে এক ব্যক্তির কাছে এক টুকরা খাবার থাকলে সেই টুকরাটিও সে আরেকজনের সঙ্গে ভাগ করে খায়। একে অপরকে দারুণভাবে সাহায্য করে উত্তর কোরীয়রা। তাদের সমাজে এই সারল্য এখনো আছে ঠিকই, তবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সেখানে খুবই কড়া। সেখানে ইন্টারনেটই নেই এই অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগেও। একবার ভাবুন তো! ‘ওরসকম’ নামে সেখানে একটি মিশরীয় কোম্পানি আছে, যারা উত্তর কোরিয়ার মুঠোফোন–ব্যবস্থা দেখাশোনা করে। এই মুঠোফোন–ব্যবস্থার আবার তিনটি স্তর আছে। ৩০ লাখ মুঠোফোন ব্যবহারকারীর ভেতর সংখ্যাগরিষ্ঠরাই কেবল দেশের ভেতর ফোন করতে পারে এবং সেসব ফোনে কোনো ইন্টারনেট সংযোগ নেই। ই-মেইল আছে বৈকি, তবে তা-ও শুধু উত্তর কোরিয়ার ভেতরেই ব্যবহার করা যায়। অভিজাত শ্রেণির মানুষেরা অবশ্য ইন্টারনেট ও স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতে পারে। তবে তারা মোট জনসংখ্যার মাত্র তিন শতাংশ। বাইরের পৃথিবীর পত্রিকা, সংবাদপত্র, বই, সিনেমা, উপন্যাস ও টেলিভিশন—কোনো কিছুতেই তাদের কোনো অভিগম্যতা নেই। আছে শুধুই রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র। তবু আমার উপন্যাসে আমি এটাই বলতে চেয়েছি যে এত কড়াকড়ির ভেতরেও মানুষ রুটি ভাগ করে খায় বা অপরাধ করে না, সরল ও বিশ্বস্ত থাকে। এটাই আমার বক্তব্যের উদ্দিষ্ট ছিল।

দ্য অরফ্যান মাস্টারস সন–এর প্রচ্ছদ
দ্য অরফ্যান মাস্টারস সন–এর প্রচ্ছদ


অদিতি:
আপনি কি মনে করেন, আপনার বইটি তাদের জীবনে কোনো খোলা জানালা মেলে দিতে পেরেছে?

অ্যাডাম: উত্তর কোরিয়ার সাধারণ মানুষ তো জানেই না যে আমি তাদের নিয়ে কোনো বই লিখেছি! যেহেতু বাইরের পৃথিবীর কোনো তথ্য বা বই–ই তাদের কাছে যায় না। আমার ধারণা, তাদের সরকার বা শাসকশ্রেণি জানে।

অদিতি: লেখককে সর্বদা নিজের ভাষাই লিখতে হয়—এমনই জানতাম শৈশব-কৈশোরে। যেমন লিও তলস্তয় রাশিয়া নিয়ে লিখেছেন রুশ ভাষায়। ধ্রুপদি লেখাগুলো এভাবেই হয়েছে। আজকের পৃথিবীতে সালমান রুশদি বা অমিতাভ ঘোষ অবশ্য ইংরেজিতে লিখছেন, তবু কমবেশি ভারত উপমহাদেশ নিয়েই লিখছেন তাঁরা। এখন এই যে আপনি ইংরেজি ভাষায় উত্তর কোরিয়া নিয়ে লিখলেন, সেটি কতটুকু কালোত্তীর্ণ হবে? আজ আমি ইন্দোনেশিয়া গিয়ে, কিছুদিন সেখানে থেকে ইন্দোনেশিয়া নিয়ে আমার ভাষায় একটি উপন্যাস লিখলেই কি সেটি কালোত্তীর্ণ হবে?

অ্যাডাম: উপনিবেশিত মানুষ বা লেখকের জন্য এটা সবসময়ই একটি কঠিন প্রশ্ন, সে কার ভাষায় লিখবে, সাম্রাজ্যের বা সাম্রাজ্যবাদীর ভাষায়, না তার নিজের ভাষায়? এডওয়ার্ড সাঈদ, ভি এস নাইপল—তাঁরা সবাই ইংরেজিতে লিখেছেন। দান্তে তাঁর ডিভাইন কমেডি অবশ্য ইতালীয়তেই লিখেছেন। আজকের পৃথিবীতে প্রায় সব লেখককেই এমন ভাবনা একবারের জন্য হলেও ভাবতে হয়।

হ্যাঁ, আমার ভাষাটা ঔপনিবেশিকের ভাষা আর ইংরেজি ভুবনায়নের ভাষা। তবে এই ভুবনায়নের কালে আপনি বা আমি কেন কোরিয়া বা চীন নিয়ে একটি বই লিখতে পারব না? আর উত্তর কোরিয়ায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার এমনই হাল যে ভালোমতো একটি বই লেখাও সেখানে কঠিন। সব বই–ই সেখানে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত। লেখকেরা মন খুলে কথা বলতে গেলে জেলে যেতে পারেন। কাজেই যেদিন সেখানে লেখকেরা হাত খুলে লিখতে পারবেন, সেদিন আর আমার বই লেখার দরকার হবে না।

অ্যাডাম জনসন
১৯৬৭ সালের ১২ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ডাকোটায় জন্ম। বড় হয়েছেন অ্যারিজোনায়। ২০১২ সালে উত্তর কোরিয়ার প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস দ্য অরফ্যান মাস্টারস সন উপন্যাসের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার এবং ২০১৫ সালে রচিত গল্পের বই ফরচুন স্মাইলস-এর জন্য পেয়েছেন দ্য ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড। এর আগেই গল্প সংকলন এম্পোরিয়াম (২০০৩) ও প্রথম উপন্যাস প্যারাসাইটস লাইক আস (২০০৪) লিখে আলোচিত হয়েছিলেন। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক; সৃজনশীল রচনা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দিকনির্দেশনাও দিয়ে থাকেন।