বাংলা বিজ্ঞান কল্পকাহিনির আদিপর্ব

প্রচলিত ধারণা অনুসারে বলা হয়ে থাকে, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু রচিত ‘নিরুদ্দেশের কাহিনি’ই বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনি। কিন্তু গবেষক ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনিকার সিদ্ধার্থ ঘোষের (‘সায়েন্স ফিকশন: একটি পরিভাষার জন্ম’, সিদ্ধার্থ ঘোষ, এক্ষণ, শারদীয়া ১৯৮৮) অনুসন্ধান মারফত জানা যায়, বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনিটির লেখক হেমলাল দত্ত। তাঁর লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘রহস্য’। গল্পটি দুই কিস্তিতে প্রকাশ পেয়েছিল ১৮৮২ সালে, সচিত্র বিজ্ঞান দর্পণ পত্রিকায়। গল্পের মূল চরিত্র বাঙালি। নাম তাঁর নগেন্দ্র, যে কিনা আবার লন্ডনপ্রবাসী। শুরুতেই চরিত্রটি জানায়, ‘একদা বিজ্ঞান আমাকে অজ্ঞানি বাঙালি পাইয়া কীরূপ দুর্গতি করিয়াছিল তাহা বলিতেছি, শুনিয়া আপনাকে কাঁদিতে হইবে’। এ গল্পে মূলত বলা হয়েছে নগেন্দ্রর ইংরেজ বন্ধু হার্বির অদ্ভুত ও অত্যাধুনিক যন্ত্রসমৃদ্ধ বাড়িতে গিয়ে হেনস্তা হওয়ার হাস্যরসাত্মক কাহিনি।
হেমলাল দত্তের গল্প প্রকাশের এক যুগের বেশি সময় পরে ১৩০৩ বঙ্গাব্দ বা ১৮৯৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় জগদীশচন্দ্র বসুর ‘নিরুদ্দেশের কাহিনি’। ঝঞ্ঝাময় সমুদ্রে এক শিশি কুন্তলীন তেল ফেলে দেওয়ার পর গর্জমান সমুদ্র নিমেষেই শান্ত হয়ে গেল—গল্পটির মূল চমক খানিকটা এমন। সঙ্গে চমৎকার এক উপশিরোনামও জুড়ে দিয়েছিলেন লেখক, ‘বৈজ্ঞানিক রহস্য’। গল্পটি ওই সময় কুন্তলীন তেল কোম্পানির পক্ষ থেকে ‘কুন্তলীন পুরস্কার’ও পায়। অবশ্য ২৫ বছর পর নিজের একমাত্র বাংলা গ্রন্থ অব্যক্ততে গল্পটি অন্তর্ভুক্ত করার সময় জগদীশচন্দ্র এর কিছু পরিমার্জন-পরিবর্ধন ঘটান। গল্পটির নামও পাল্টে দেন, এবারে শিরোনাম ধার্য করেন: ‘পলাতক তুফান’।
একই সময় বিজ্ঞান-লেখক ও শান্তিনিকেতনের বিজ্ঞানের শিক্ষক জগদানন্দ রায়ও একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লিখেছিলেন। ভিনগ্রহবাসী বা ‘এলিয়েন’সদৃশ জীবদের বর্ণনাসমৃদ্ধ ‘শুক্র ভ্রমণ’ নামের ওই গল্পটি তাঁর প্রাকৃতিকী গ্রন্থে সংকলিত হয়। বইটি ১৩২১ বঙ্গাব্দে প্রকাশ পেলেও জগদানন্দ দাবি করেছিলেন, বই আকারে প্রকাশের প্রায় বাইশ বছর আগে এটি তিনি লিখেছেন। এ ছাড়া রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সুলতানাস ড্রিমকেও (১৯০৫) ভিন্নধারার একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
আধুনিক পাশ্চাত্য কল্পকাহিনির ধারার সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীদের পরিবারের পরিচয় ছিল। এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন দেখি তাঁরই ভাই কুলদারঞ্জন জুল ভার্নের মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড বইয়ের অনুবাদ করেছিলেন আশ্চর্য দ্বীপ নামে ( তাঁরও আগে অবশ্য বাংলা অনুবাদে প্রথম জুল ভার্নকে হাজির করেন রাজেন্দ্রলাল আচার্য, ১৯১৪ সালে তিনি অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেইজ-এর অনুবাদ করেছিলেন)। রায় পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি সুকুমার রায় তাই ছেলেবেলায় জুল ভার্ন বা আর্থার কোনান ডয়েলের প্রফেসর চ্যালেঞ্জার চরিত্রকে ঘিরে আবর্তিত বিজ্ঞান কল্পকাহিনিগুলো পড়েছেন, এমনটা আন্দাজ করা খুব ভুল হবে না। পরে তিনি রচনা করেন ‘হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’ শীর্ষক বিজ্ঞান কল্পকাহিনি। এর নেপথ্যে কোনান ডয়েলের লস্ট ওয়ার্ল্ড উপন্যাসখানা তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল বৈকি; কিন্তু এ বাদে ওই কল্পকাহিনির চরিত্র, ঘটনাবিন্যাস, তাবৎ সংলাপ—সবই শেষ অব্দি একান্তভাবে ‘সুকুমারীয়’। পরে সুকুমার-পুত্র সত্যজিৎ রায় প্রফেসর শঙ্কু চরিত্র সৃষ্টি করে কীভাবে বাংলা বৈজ্ঞানিক কাহিনিকে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সে কাহিনি সবারই জানা।