বিজ্ঞান কল্পকাহিনির ২০০ বছর

বিজ্ঞান কল্পকাহিনি দেখায় ভবিষ্যতের পৃথিবী
বিজ্ঞান কল্পকাহিনি দেখায় ভবিষ্যতের পৃথিবী

চল্লিশ দশকের কথা। নিজের গড়া দ্য মারকিউরি থিয়েটারে অরসন ওয়েলস প্রচার করলেন এইচ জি ওয়েলসের দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে একটি রেডিও নাটক। ওই নাটকে বলা হয়েছিল, অন্য জগৎ থেকে এলিয়েনরা আক্রমণ করতে আসতে পারে। এরপর ঘটল তেলেসমাতি কাণ্ড। মানুষ সংবাদটি বিশ্বাস করল, আতঙ্কিত হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল তারা।
দ্বিতীয় ঘটনাটিও চল্লিশ দশকের, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার। ব্রিটিশ ও মার্কিন সামরিক বাহিনীর সদস্যরা নতুন নতুন ধারণা নেওয়ার জন্য নেড়েচেড়ে দেখত বিজ্ঞান কল্পকাহিনির সাময়িকীগুলো। ক্লিও কার্টমিলের লেখা ‘ডেডলাইন’ নামের এক গল্পে উল্লেখ করা হয়েছিল পারমাণবিক বোমা বানানোর কাল্পনিক পরিকল্পনার কথা। ফলে এফবিআই সদস্যরা হানা দিল তখনকার বিজ্ঞান কল্পকাহিনি সাময়িকী অ্যাস্টাউন্ডিং-এর অফিসে।
ওপরের দুটি ঘটনাই বিজ্ঞান কল্পকাহিনির শক্তিমত্তার পরিচায়ক। এই যে বিজ্ঞান কল্পকাহিনি, বিশ্ববাসীর কাছে যা ‘সায়েন্স ফিকশন’ নামে পরিচিত, গত ২০০ বছরে তাকে ঘিরে ঘটনার ঘনঘটা কম নয়। এখানে ‘২০০ বছর’ কথাটি বলারও কারণ আছে। এ বছর বেশ সাড়ম্বরেই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির ২০০ বছর পালিত হচ্ছে ১৮১৮–তে বের হওয়া মেরি শেলির উপন্যাস ফ্রাঙ্কেনস্টাইন–এর প্রকাশ সালকে মনে রেখে। তবে মতভেদ পিছু ছাড়েনি এখানেও। একদল বলছেন, বিজ্ঞান কল্পকাহিনির জন্ম আরও আগে। তাঁরা বলছেন, ৩৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্লেটোর আটলান্টিস দিয়েই যাত্রা শুরু ‘বিজ্ঞান কল্পকাহিনি’ নামক শাখাটির। আবার কারও কারও বিবেচনায়, ২৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের গিলগামেস মহাকাব্যই প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনি।
তবে ‘গ্র্যান্ডমাস্টার অব সায়েন্স ফিকশন’ আইজাক আসিমভ বলেছেন ভিন্ন কথা: ‘আমার মতে, এসব ধারণা হয় মূর্খতা, না হলে ভন্ডামি। বিজ্ঞান কল্পকাহিনিকে অবশ্যই বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সঙ্গে জড়াতে হবে। নিদেনপক্ষে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে ছুঁয়ে যেতে হবে। শুধু তা-ই নয়, এমন এক সমাজকাঠামোর মধ্যে এর গল্প ফাঁদতে হবে, যাতে ওই সময়ের প্রকৃত সমাজচিত্র থেকে লেখা গল্পটি লক্ষণীয়ভাবে অন্য রকম হয়। সোজা কথা, একটা ফারাক থাকবে। আর এই ফারাকটা হতে হবে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে ঘিরে।’
এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যাঁরা একমত তাঁদের অনেকে মেরি শেলির ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইনই বিশ্বের প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনি’—কথাটি বেশ বড় গলায় বলে থাকেন। সেই হিসেবে নিশ্চয়ই এ বছর বিজ্ঞান কল্পকাহিনির ২০০ বছর পালন করা যায়। আরেকাংশ মনে করেন, বিজ্ঞান কল্পকাহিনির সূচনা ১৯ শতকের প্রথম দিকে। কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন, ১৭৬৫ সালে হোরাস ওয়ালপোলের লেখা দ্য ক্যাসল অব অন্টোরান্টোর মাধ্যমে গথিক রোমান্টিক গল্পের ধারার শুরু। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে সেই ঘরানায় ফেলতে চান তাঁরা। তারপরও যেসব রচনাকে বিজ্ঞান কল্পকাহিনি বলে ভাবা হয়েছে, সেগুলোর গায়ে গথিক ঘরানার লেবেলটি সহজেই সেঁটে দেওয়া যায়।
কিন্তু আসিমভের মতে, ১৮৬৩ সালে লেখা জুল ভার্নের ফাইভ উইকস ইন আ বেলুন হলো বিশ্বের প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনি। তিনি বলেছেন, ‘জুল ভার্নের এই রচনা গথিক ঢঙের বাইরে একটি সত্যিকারের বিজ্ঞান কল্পকাহিনি। তাই ১৮৬৩ সালই হলো বিজ্ঞান কল্পকাহিনির শুভসূচনার বছর।’ তবে এখানে একটি ‘কিন্তু’ আছে। আসিমভের এই বক্তব্য যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়, তা স্বয়ং আসিমভও স্বীকার করেছেন।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০ বা ১৮১৮ কিংবা ১৮৬৩—যে সময়েই বিজ্ঞান কল্পকাহিনির সূচনা হোক না কেন, এটা সবাই মানবেন যে সাহিত্য ও বিজ্ঞানের নিবিড় যোগসূত্রে গ্রথিত এই ধারা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে দিনকে দিন।
বিজ্ঞান কল্পকাহিনি বিংশ শতাব্দীরই বিস্ময়। হয়তো এসব কারণেই এই ধারার সাহিত্যকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘আগামী দিনের রূপকথা’ নামে। বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে একদিন যা ছিল কেবল লেখকের কল্পনা, পরে তা হয়েছে নিরেট বাস্তব—আজ এমন উদাহরণের অভাব নেই চারপাশে।

মেরি শেলি, জুল ভার্ন এবং এইচ জি ওয়েলস: প্রথম িদককার বিজ্ঞান কল্পকাহিনির তিন স্রষ্টা
মেরি শেলি, জুল ভার্ন এবং এইচ জি ওয়েলস: প্রথম িদককার বিজ্ঞান কল্পকাহিনির তিন স্রষ্টা

১৯২৯ সাল থেকে সাহিত্যের অন্যতম এই শাখা পুরোনো খোলস ফেলে আবির্ভূত হলো নতুনরূপে। ১৯২৬ সালে হুগো গার্নসব্যাক তাঁর সায়েন্স ফিকশন সাময়িকীর মাধ্যমে এডগার অ্যালান পো, জুল ভার্ন ও এইচ জি ওয়েলসের মতো বিখ্যাত লেখকদের বিজ্ঞান কল্পকাহিনির সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিলেন। গার্নসব্যাকের সম্পাদিত অন্য আরেকটি সাময়িকী অ্যামেজিং স্টোরিজ-এর প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে এই লেখকদের সম্পর্কে তিনি বললেন, ‘এঁরা রোমান্সের জাদুর সঙ্গে বৈজ্ঞানিক তথ্য এবং ভবিষ্যৎ দেখার শক্তির মোহনীয় সংমিশ্রণ।’ গার্নসব্যাক তাঁর এই নতুন ধরনকে অভিহিত করেছেন নানা নামে, এর ভেতর একটা হলো ‘সায়েন্টি ফিকশন’। এ শ্রেণির সাহিত্যে প্রথম থেকে যেসব বিজ্ঞান কল্পকাহিনিমূলক সাময়িকীর রাজত্ব ছিল, তার মধ্যে আছে অ্যামেজিং স্টোরিজ, থ্রিলিং ওয়ান্ডার স্টোরিজ, অ্যাস্টাউন্ডিং স্টোরিজ অব সুপার সায়েন্স ইত্যাদি।
সায়েন্স ফিকশনের সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে মার্কিন মুলুকে ‘এসএফ’ কথাটা চালু ছিল। ষাটের দশক পর্যন্ত এটা ব্যবহার করেছে ব্রিটিশরা। সে সময় এই ধারায় ব্রিটিশ লেখক ছিল খুবই কম। এটা ঠিক যে নতুন এই ধারায় সিএস লুইসের মতো লেখকেরা পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছেন। ওয়েলসের ধারার কিছু বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ ঘটিয়ে লুইস সৃষ্টি করেছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞান কল্পকাহিনির নতুন এক ঘরানা।
তবে লক্ষ করার ব্যাপার হলো, মার্কিন লেখকেরাই আদতে আসল ম্যাজিকটা দেখিয়েছেন, যার শুরু ত্রিশ দশক থেকে। তবে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বৃদ্ধি পায় বিজ্ঞান কল্পকাহিনির সমৃদ্ধি আর জনপ্রিয়তা। এ সময় চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের জন্য সিরিজ নির্মাণ করা শুরু করেন চলচ্চিত্রনির্মাতারা। পাশাপাশি এই ধারার বই প্রথমে হার্ডকভার এবং পরে পেপারব্যাকে প্রকাশিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো পূর্ব ইউরোপেও বিকশিত হয়েছে এই ধারা। তথ্য-উপাত্তমতে, রাশিয়ায় প্রতিবছর বিজ্ঞান কল্পকাহিনিমূলক বইয়ের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চেয়ে বেশি। এখানে রাশিয়ার একজন লেখকের কথা বলতেই হবে—আলেক্সান্দর বেলায়েভ। ১৯২০ থেকে ১৯৩০—এই সময়ের মধ্যে লেখা তাঁর কল্পকাহিনিগুলো অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে তাঁকে। প্রফেসর ডয়েলস হেড, অ্যাম্ফিবিয়ান ম্যানসহ দুর্দান্ত সব মানবিক বিজ্ঞান কল্পকাহিনির লেখক বেলায়েভ। তাঁর গল্প পড়েই বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লিখতে উৎসাহিত হয়েছিলেন আমাদের হুমায়ূন আহমেদ। অস্ট্রিয়ান সমালোচক রোটেনস্টাইনার দ্য সায়েন্স ফিকশন বুক নামের বইয়ে সেরা সমকালীন বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক হিসেব পোল্যান্ডের অধিবাসী স্তানিস্লাভ লেমের নাম উল্লেখ করেছেন। আবার জেরাল্ড জোনাস নামের সমালোচক মুখেও শোনা গেছে তাঁর নাম: ‘লেমই হলেন একমাত্র বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক, যিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন।’
জেনে নেওয়া যাক বিজ্ঞান কল্পকাহিনির আরও কয়েকজন লেখক সম্পর্কে, যাঁদের লেখা পৃথিবীর মানুষকে ভাবতে শিখিয়েছে নতুন করে। এ ক্ষেত্রে আসিমভের নাম জোরের সঙ্গেই উচ্চারণ করতে হবে। আসিমভের রোবটিক্সের তিন সূত্র এবং এর মধ্য থেকে গল্প ফাঁদা সত্যিই দুরূহ এক কর্ম। কিন্তু এ কাজে তিনি সিদ্ধহস্ত। তাঁর ‘ফাউন্ডেশন’ সর্বকালের সেরা বিজ্ঞান কল্পকাহিনি সিরিজ।
আর আর্থার সি ক্লার্ক? বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক বললে যে গুটিকতক নাম আমাদের চোখে সবার আগে জ্বলজ্বল করে, তার অন্যতম তিনি। তাঁর ‘অডিসি’ সিরিজ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায় মানুষকে। অন্যদিকে ‘রোবট’ নামটি যাঁর লেখায় প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল, তিনি ক্যারেল চাপেক। নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক ক্যারেল চাপেক রুমস ইউনিভারসাল রোবটাস নামে নাটক লিখে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।
এ জগতের আরেক বড় নাম রে ব্র্যাডবেরি। মজার ব্যাপার হলো, বিজ্ঞান কল্পকাহিনির জগতের বাইরের লেখক ছিলেন তিনি। তাঁর বিজ্ঞান কল্পকাহিনি সম্পর্কে রাশিয়ার এক সমালোচক বলেছিলেন, ‘আমেরিকার বিবেক হলো ব্র্যাডবেরি।’
গোটা বিশ্বে যখন বিজ্ঞান কল্পকাহিনির জয়ধ্বনি, এ ধারার লেখকদের দেওয়া হচ্ছে ‘নেবুলা অ্যাওয়ার্ড’ ও ‘হুগো অ্যাওয়ার্ড’ নামে পৃথক দুটি পুরস্কার; এর ঢেউ বেশ আগেই আছড়ে পড়েছিল বঙ্গদেশে। বাংলা ভাষার প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লিখেছেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। তবে এ নিয়ে মতভেদ আছে। অন্যদিকে বাংলা ভাষায় প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনির পত্রিকার নাম আশ্চর্য। আর বাংলাদেশে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির শুরু হয় বিদেশি সাহিত্য অবলম্বনে, ১৯৬৯ সালে। প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনি হিসেবে এ বছর প্রকাশিত হয় মহাশূন্যের কান্না নামের উপন্যাস। লেখক কাজী আবদুল হালিম। তারপর দীর্ঘ বিরতি। ১৯৭৩ সালে হুমায়ূন আহমেদ লিখলেন বাংলাদেশের প্রথম মৌলিক বিজ্ঞান কল্পকাহিনি তোমাদের জন্য ভালোবাসা।
বিজ্ঞান কল্পকাহিনির ক্ষেত্রে আমাদের এখানে এখন যে জোরালো জোয়ার, ফি বছরই বের হচ্ছে প্রচুর বিজ্ঞান কল্পকাহিনির বই, এর পেছনে সবচেয়ে বেশি যাঁর অবদান তিনি মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তারপর যাঁর নাম উচ্চারণ করতে হবে তিনি দীপেন ভট্টাচার্য। এ দেশ থেকে বেরোনো বিজ্ঞান কল্পকাহিনির প্রথম পত্রিকা মৌলিক। সম্পাদক আহসান হাবীব। এ পত্রিকার হাত ধরে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতিশীল বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক বেরিয়ে এসেছিলেন, যাঁদের মধ্যে অনেকে এখনো সক্রিয়। এ ছাড়া নতুন লেখকেরাও আসছেন সাহিত্যের এই নতুন জমিতে ফসল ফলাতে।
এ বছর বিজ্ঞান কল্পকাহিনির ২০০ বছর, নাকি এর জন্ম আরও আগে বা পরে, তা নিয়ে তর্ক চলতেই থাকবে। কিন্তু এটা তর্কাতীত যে বিজ্ঞানের সঙ্গে কল্পনার মিলমিশে যে নতুন ধারার সাহিত্যের জন্ম হয়েছে, তা যেমন পাল্টে দিয়েছে সাহিত্যের গতিপথ, তেমনি পৃথিবীকে বদলানো এবং মানুষকে স্বাপ্নিক করে তোলার পেছনে এই ধারার অবদান কম নয়।