আলোক-অভিযাত্রার দিকে

>
বাংলা একাডেমির একটি অনন্য গ্রন্থমালা স্মৃতি ৭১
বাংলা একাডেমির একটি অনন্য গ্রন্থমালা স্মৃতি ৭১
বাংলা একাডেমির ৬৩তম জন্মবার্ষিকী ছিল ৩ ডিসেম্বর। এ উপলক্ষে জাতির মননের প্রতীক এই প্রতিষ্ঠানের দিকে ফিরে দেখা

সম্প্রতি কলকাতার মোহরকুঞ্জে বাংলাদেশ বইমেলা শুরুর পরপরই দেখি বাংলা একাডেমির স্টলে উৎসুক মানুষের ভিড়। কালীপূজার মৌসুমে শত ব্যস্ততার মধ্যেও দূরদূরান্ত থেকে বহু ক্রেতা-পাঠক এসেছেন বাংলা একাডেমি প্রকাশিত জেলাভিত্তিক লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা আর ফোকলোর সংগ্রহশালার বিভিন্ন খণ্ডের জন্য। এঁদের কারও পূর্বসূত্র প্রোথিত বাংলাদেশের বরিশাল, বিক্রমপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা বা যশোরে। ফেলে আসা ভিটেমাটির মতোই টান অনুভব করেন তাঁরা সেখানকার ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির প্রতি। বলছিলেন সবাই, ‘বাংলা একাডেমির এই কাজগুলো অসাধারণ!’ মাত্রই কয়েক বছর আগেকার কথা মনে এল তখন। ২০১১ সালে মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের কক্ষে রাত অব্দি সাক্ষাৎকার গ্রহণ চলছিল লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা কর্মসূচির সংগ্রাহক ও সমন্বয়কারীদের। বহু যাচাই-বাছাইয়ের পর উদয়াস্ত মাঠকর্মের ফল হিসেবে যে সিরিজ গ্রন্থমালা বেরিয়েছিল তার স্বীকৃতি এখন দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে বহির্বিশ্বেও ব্যাপ্ত। বাংলা একাডেমির মূল কাজ তাই বলে কেবল লোকজ সংস্কৃতির চর্চা নয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে (৩ ডিসেম্বর ১৯৫৫) নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে একাডেমি, তবে এই অভিযাত্রায় কখনোই কার্যসম্পাদনের একরৈখিকতাকে মেনে নেয়নি। তাই দেখব একাডেমি প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান-এর পাশাপাশি প্রণয়ন ও প্রকাশ করেছে আঞ্চলিক ভাষার অভিধান থেকে শুরু করে ইংরেজি-তুর্কি-আরবি-ফার্সি-সংস্কৃত অভিধান। মহার্ঘ্য বিজ্ঞান বিশ্বকোষ-এর পাশাপাশি শিশু–কিশোরদের কথা মাথায় রেখে প্রকাশ করেছে ছোটদের অভিধানও। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস যেমন প্রকাশ করেছে, তেমনি ইতিপূর্বে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং আরব জাতির প্রামাণ্য ইতিহাসও অনুবাদ আকারে প্রকাশ করেছে। বাংলা ভাষায় ফেরদৌসীর শাহনামার ছয় খণ্ড পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ প্রকাশের কৃতিত্ব যেমন একাডেমির, তেমনি নিৎসের জরথুস্ত্র বললেন, প্লেটোর রিপাবলিক, মর্গানের আদিম সমাজ, ইবনে খালদুনের আল মুকাদ্দিমা-এর মতো বইপত্র প্রকাশ করে ধ্রুপদি ও সমকালীন বিশ্ব-জ্ঞানসমুদ্রের বিচিত্র কল্লোলের সঙ্গে বাঙালি মননের যোগসূত্র স্থাপন করেছে। তবে সৃজনশীল সাহিত্যের বিকাশেও প্রতিষ্ঠানটি পিছিয়ে ছিল না।

সংস্কার করার পর বর্ধমান হাউসের বর্তমান রূপ। ১৯৫৫ সালে এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা একাডেমি। ছবি: প্রথম আলো
সংস্কার করার পর বর্ধমান হাউসের বর্তমান রূপ। ১৯৫৫ সালে এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা একাডেমি। ছবি: প্রথম আলো

আহমদ শরীফের সম্পাদনায় লায়লী মজনু (১৯৫৭) বই প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রকাশনা-ক্ষেত্রে একাডেমির যে যাত্রারম্ভ, তা ক্রমেই ব্যাপ্ত হয়েছে প্রাচীন-মধ্য-আধুনিক যুগের ইতিহাস গ্রন্থাবলি, বিশ্বখ্যাত আত্মজীবনী, বিজ্ঞান, দর্শন, নাটক, পাঠ্যপুস্তক, শিশুসাহিত্য ইত্যাদি বিচিত্র বিষয়ে পাঁচ সহস্রাধিক বইয়ে। গুরুভার বিষয়ের বইও যে সাধারণ পাঠকের কাছে বিপুলভাবে আদৃত হতে পারে তা একাডেমির ভাষাশহীদ গ্রন্থমালার আওতায় প্রকাশিত ১০১টি বই এবং জীবনী গ্রন্থমালা সিরিজের পাঠকপ্রিয়তার দিকে লক্ষ করলেই অনুধাবনে আসে। এ কথা আজ জোর দিয়ে বলা যায়, বিগত দু-আড়াই শ বছরের বঙ্গীয় মনীষার চিন্তাচর্চার পূর্ণায়ত ধারা বুঝতে হলে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত কয়েক শ রচনাবলির কাছে আমাদের আসতেই হবে। মীর মশাররফ হোসেন, বেগম রোকেয়া, নজরুলের প্রামাণ্য ও পূর্ণাঙ্গ রচনাবলি প্রকাশ বাংলা একাডেমির জন্য গর্বের বিষয়।
যে ভাষা আন্দোলনের রক্তশপথের ভিত্তিতে বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা সে সংগ্রামের ইতিহাস, ভাষাশহীদ ও ভাষাসংগ্রামীদের জীবনী প্রকাশ এবং ভাষা আন্দোলন জাদুঘরের মাধ্যমে একাডেমি ঋণ শোধ নয়, ঋণস্বীকারের চেষ্টা করেছে মাত্র।
১৯৭১-এর পাকিস্তানি কর্তৃত্বের ছায়াতলেও একাডেমি তার স্বাতন্ত্র্য হারায়নি। তাই একাত্তরের একুশের অনুষ্ঠানমালায় একাডেমি কোনো সরকারি কর্তাব্যক্তির বদলে প্রধান অতিথি করে এনেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। একাডেমির সাবেক পরিচালক কবীর চৌধুরী, একাডেমিতে মুক্তিযুদ্ধকালে কর্মরত লেখক আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবদুল হক, সরদার ফজলুল করিম, ফজলে রাব্বি প্রমুখের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, একাডেমির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একাত্তরের মার্চে গণ–আন্দোলনের শহীদদের পরিবারের সাহায্যার্থে খোলা তহবিলে নিজেদের একদিনের বেতন তুলে দেন। একাডেমির প্রেসে গোপনে প্রকাশিত হয় মুক্তিযুদ্ধের বুলেটিন জয়বাংলা। একাডেমি প্রাঙ্গণে মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলার কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীরা শপথ নিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। তাই পাকহানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ কালরাতে রবীন্দ্র-নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক বর্ধমান হাউসকে লক্ষ্য করে শেল নিক্ষেপ করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক সূতিকাগারকে ধ্বংস করা। কিন্তু বাংলা একাডেমি বাংলাদেশের মতোই ধ্বংসের কালরাত পেরিয়ে স্বাধীনতার আভায় নতুন করে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। একাত্তরের শহীদ বাংলার শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বাংলা একাডেমির ছিল আত্মার সম্পর্ক। তাই স্বাধীনতার পর এই বুদ্ধিজীবীদের চিরস্মরণীয় করে রাখতে একাডেমি তাঁদের রচনাবলি প্রকাশ করেছে, রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় প্রকাশিত স্মৃতি: ১৯৭১ নামের কয়েক খণ্ডের বইয়ে ধরে রেখেছে একাত্তরের অবিনাশী স্মৃতি।
এই প্রতিষ্ঠানটি কেন্দ্র ও প্রান্তের মধ্যে কোনো সীমারেখা টানতে চায়নি। দেশের দুটি প্রান্তীয় স্থান রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দিতে মীর মশাররফ হোসেনের সমাধিস্থলে একটি স্মৃতিকেন্দ্র এবং রংপুরের পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়ার জন্মস্থলে আরেকটি স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপন করছে। একাত্তরের জনযুদ্ধের সামগ্রিকতা আবিষ্কারের লক্ষ্যে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ করে চলেছে মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস।
এত সব কাজের পরও বাংলা একাডেমির জনপরিচিতি বোধকরি বিশ্বের দীর্ঘকালব্যাপ্ত গ্রন্থমেলার আয়োজক হিসেবেই। তিন দশক পেরিয়ে একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল প্রান্তরে বিস্তৃত।
১৯৫৪ সলের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর ফ্রন্টের ২১ দফার বাস্তবায়ন হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা-বিকাশের লক্ষ্যে ১৯৫৫-এর ৩ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে বাংলা একাডেমি। পৃথিবীর নানা দেশে ভাষা ও সাহিত্য গবেষণাকেন্দ্রিক বহু সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু বলতে গেলে এদের কোনোটিরই ভাষা আন্দোলনের মতো এমন ঐতিহাসিক-সংগ্রামী প্রেক্ষাপট নেই। ১৯৮৬ সালের ৩ ডিসেম্বর কথাশিল্পী শওকত ওসমান প্রদত্ত একাডেমির প্রতিষ্ঠা দিবস ভাষণে মতো আমাদেরও উপলব্ধি ও প্রত্যাশা এমন: ‘বাংলা একাডেমি কি প্রাতিষ্ঠানিক একটি নাম মাত্র? না। এই নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দেশের ইতিহাস অতীতের অযুত নর–নারীর যৌথ কণ্ঠস্বররূপে দুদ্দাড় আমার কানে আছড়ে পড়ে।...এই প্রতিষ্ঠান পৃথিবী-অবলোকনের জানালা, জ্ঞানচর্চার বিশাল নিকেতনরূপে কালে কালে বিস্তার লাভ করুক। বাংলাদেশের ঠিকানা হোক বাংলা একাডেমি।’

একনজরে বাংলা একাডেমি
● প্রতিষ্ঠা ৩ ডিসেম্বর ১৯৫৫।

● বর্ধমান হাউসকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি। এই বর্ধমান হাউসে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ বিশিষ্টজনেরা।

● বাংলা একাডেমির প্রথম মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পারস্য প্রতিভার লেখক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, প্রথম পরিচালক ভাষাবিজ্ঞানী মুহম্মদ এনামুল হক এবং প্রথম মহাপরিচালক ফোকলোরবিদ মযহারুল ইসলাম।

● প্রথম বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয় ১৯৬০ সালে। পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকেরা হলেন— ফররুখ আহমদ, আবুল মনসুর আহমদ, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, আসকার ইবনে শাইখ, খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীনও আবুল হাশেম খান।

● বর্তমানে বাংলা একাডেমির সঙ্গে যে মনোগ্রামটি ব্যবহৃত হয়, সেটি এ প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় মনোগ্রাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে এই মনোগ্রামের নকশা করেন হাশেম খান। আর একাডেমির প্রথম মনোগ্রামের নকশাকার খাজা শফিক আহমদ।

● এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রথম প্রকাশিত বই দৌলত উজির বাহরাম খাঁ প্রণীত এবং আহমদ শরীফ সম্পাদিত লায়লী মজনু (জুন ১৯৫৭)। এ পর্যন্ত এখান থেকে বেরিয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশিসংখক বই।

● বাংলাদেশে মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহার হাতে বইমেলার গোড়াপত্তন হলেও বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা আনুষ্ঠানিক রূপ পায় ১৯৮৪ সালে।

সূত্র: বশীর আলহেলালের লেখা বাংলা একাডেমির ইতিহাস, ১৯৮৬