আমার জীবন, আমার নারী

>

উইমেন-এর প্রচ্ছদ
উইমেন-এর প্রচ্ছদ

আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেনের ছবির বই উইমেন। নারীকে উপজীব্য করে বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। এ বইয়ের পরিকল্পনা কেন করেছিলেন আনোয়ার? এ বছরের ২০ এপ্রিল এক আড্ডায় তাঁর কাছে প্রশ্নটি রেখেছিলেন কাউন্টার ফটোর শিক্ষার্থী আলোকচিত্রী তৌফিকুল হাসান। উত্তরে সেদিন খোলামেলাভাবে নিজের জীবনের অনেক কথা বলেছিলেন খ্যাতিমান এই আলোকচিত্রী। ধারণকৃত সেই কথামালার নির্বাচিত অংশের সমন্বয়েই এই লেখা

নারীর সঙ্গে পুরুষের সংযোগটি খুবই গভীর। নারীর গর্ভেই পুরুষের জন্ম, তার মা, স্ত্রী, বোন—সবাই-ই নারী। আর এ কথা তো বলাই বাহুল্য, মা, স্ত্রী, বোন, বান্ধবী—এদের ছাড়া সৃষ্টি চলতে পারে না। আমার বাল্যকালে—বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে নানাভাবেই মায়ের প্রভাব রয়েছে। ছোটবেলার দু-একটি ঘটনা বললেই বিষয়টি স্পষ্ট হব। পরিবারের প্রথম ছেলে আমি ছোটবেলায় ছিলাম খুব শীর্ণকায়, হালকা-পাতলা। আমি এমন এক সময়ের কথা বলছি, যখন কেবল বসা শিখেছি। আমার ছোট ভাই নীলু, সে ছিল খুব নাদুসনুদুস। বাবা ছিলেন চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত। সারা বাংলাদেশে সিনেমা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। একদিন সফর শেষে বাবা বাড়ি ফিরে আমার ছোট ভাইকে কোলে নিলেন, যেহেতু সে ছিল নাদুসনুদুস আর আমি রোগাপটকা।

সেই সময় আমার মা নাকি বাবাকে বলেছিলেন, ওকে রেখে আপনার প্রথম সন্তানকে কোলে নেন। এই যে ঘটনা, অনেকের কাছে এটা খুব সহজ মনে হতে পারে; কিন্তু আমার কাছে মোটেও সহজ ছিল না। যেকোনো শিশুর জন্যই এটা কঠিন ব্যাপার। এর সঙ্গে আরেকটি ঘটনাও বলতে হবে—আমাদের পরিবার ছিল খুব দরিদ্র এবং আমি ঠিক মায়ের দ্বারা বেড়ে উঠিনি, আমাকে বড় করেছেন আমার খালা। খালার কোনো সন্তান ছিল না। খালা আর আমরা পুরান ঢাকার একই গলিতে থাকতাম। খুবই চিকন একটা গলি। তো, তিন মাস বয়সে আমি যখন মায়ের দুধ খাওয়ার জন্য টানাটানি করছিলাম, ওই অবস্থায় মা আমাকে একটা থাপ্পড় দেন। এরপর যে ব্যাপারটি ঘটল, আমি নাকি কখনোই আর মায়ের দুধ পান করিনি। একটু বড় হওয়ার পর পরিবারের লোকজনের কাছে শুনেছি যে, সেই শিশু বয়সে আমার এই ঘটনায় পরিবারের মানুষজন নাকি একটু অবাকই হয়েছিলেন। হয়তো তাঁরা ভেবেছিলেন, এই ছেলেটার এত রাগ, তিন মাস বয়সেই অভিমান করে মায়ের দুধ খাবে না! আবার এমনও হতে পারে, ওই থাপ্পড়ের ঘটনায় আমি ভয় পেয়েছিলাম। তাই আর দুধ খাইনি। যা-ই হোক না কেন, আমার মনে হয়, এই দুধ না খাওয়ার পেছনে আমার এক ধরনের অভিমান তো ছিলই।

এরপর খালার কাছে দিয়ে দেওয়া হলো আমাকে। তাঁর কাছে ছিলাম ছয় বছর বয়স পর্যন্ত। এই যে ঘটনাগুলোর কথা বললাম, এ থেকে নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে আমার জীবনে নারীরা কীভাবে প্রভাব ফেলেছেন। মা, খালা ছাড়াও ছিলেন আমার দাদি। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন; কিন্তু মায়ের সঙ্গে তাঁর ঝগড়া লেগেই থাকত, যা খুব আঘাত দিত আমাকে। যখন কলেজে পড়ি, আমাদের বাসার সঙ্গে আমার খালার ঝগড়া হলো। এরপর থেকে তিনি জানালা দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতেন, কিন্তু বাসায় আসতেন না। এই সবকিছু মিলিয়ে মনের মধ্যে সে সময় খুব খারাপ লাগা তৈরি হয়েছিল।

যদ্দুর মনে পড়ে, মা, খালা ও দাদি—আমার জীবনে এই তিন নারীর অভিজ্ঞতা দেখে মেয়েদের থেকে দূরে দূরে থাকতাম। স্কুলে আমার নাম দেওয়া হয়েছিল সত্যবাদী। সেই আমিই পরবর্তী জীবনে যখন উইমেন নামে ছবির বই তৈরি করলাম, ততদিনে ডলির সঙ্গে আমার একটা গাঁটছড়া হয়েছে। এটাকে পুঁজি করে বাংলাদেশের কিছু আলোকচিত্রী এবং সিনেমার কিছু লোকজন এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায় যে নারীসংক্রান্ত ব্যাপারে আমি নাকি খুব খারাপ। আমি নাকি বাংলাদেশে অন্যতম দুশ্চরিত্র লোক ইত্যাদি ইত্যাদি। এর পেছনে তাদের একটা উদ্দেশ্য ছিল—আমি যেন কোনো কাজ না পাই।

এখনো পাঁচ-দশটি মেয়ে সামনে এলে অতি দ্রুত তাদের সঙ্গে আমি মিশে যেতে পারি। নিজেকে আমি এখনো পবিত্র মনে করি। কথা হলো, মেয়েরা কি এতই বোকা? একটা কুকুরও জানে তুমি কখন তাকে লাথি মারবে, কখন তার ক্ষতি করবে। তাহলে কি একটা মেয়ে জানে না? তাহলে কী করে মেয়েরা আমাকে এখনো এত পছন্দ করে? আমার জীবনে নারীরা নানা রূপে, নানা ভাবে আসে। ডলি তো শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করল।

জীবনের বিচিত্র এসব অভিজ্ঞতার কারণে একসময় আমার মনে হয়েছিল, মানুষের মুখাবয়বই তো আমি বেশি তুলি, এই মুখাবয়ব নিয়ে আমি তিনটি কাজ করব, এর একটা হলো উইমেন। তখনকার সেই বাংলাদেশে এই বইটা বের করা, কোনো লোকের সেই বই নিয়ে কোনো প্রকার আপত্তি না তোলা এবং তরুণদের বইটা উল্টেপাল্টে দেখা—আমার কাছে সবকিছুই ছিল বিস্ময়কর ঘটনা।

তারপর আমার জীবনে বহু নারী এসেছেন। কারণ আমি খুব উন্মুক্ত মনোভাবের। নারীদের পৃথিবীর চালিকা শক্তি মনে করি আমি। জটিলতা তো মনে করি সব পুরুষদের মধ্যে।

আমি মনে করি, বাংলাদেশের সমসাময়িক আলোকচিত্রের পাটাতন তৈরি হয়েছে আমার কবরের ওপর দাঁড়িয়ে। এই কবরের ওপর এটা তৈরি হওয়ার পর যে আমি বেঁচে আছি তা কেবল চারজন নারীর আশীর্বাদে। অনেকেই বলেছেন, আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নাকি নারীরা আমার পাশে থাকবেন, তাঁরা আমার যত্ন নেবেন, আমাকে আশীর্বাদ করবেন। তো, এভাবেই উইমেন বইটা নিয়ে কাজ শুরু হয়। এরপর জীবন ওলট-পালট হয়ে যাওয়াতে মেন আর চাইল্ড (পুরুষ ও শিশুদের নিয়ে)—এই দুটো বই এখনো করতে পারিনি। কিন্তু গত এক বছর আমার চোখে ভাসছে যে পুরুষই হবে আমার পরবর্তী বইয়ের থিম; শুধু দশটা ছবি, যে দশটা ছবি নিয়ে পৃথিবীতে হইচই পড়ে যাবে। মাথার মধ্যে ঘুরছে ছবিগুলো, যা কেউ দেখেনি কখনো। আসলে আমার আশি-নব্বই ভাগ ছবি কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি। যখন ফ্রান্সে গিয়েছি, আমার দশ ট্রাঙ্ক নেগেটিভ ছিল, এখন পনেরো ট্রাঙ্ক হবে।

উইমেন বইটা আমার জীবনে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মানুষ আমাকে কেন যেন অযথা নারীর সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে, ভুলভাবে জড়িয়ে ফেলে—এগুলোরই কিছু সূত্রপাত আমার এই বই। তোমরা ফ্যামিলি অব ম্যান বইটা দেখেছ হয়তো, সেটারই আমার করা সংস্করণ হলো উইমেন। তবে উইমেন, মেন ও চাইল্ড—এই তিনে মিলেই হবে আমার পূর্ণ প্রকল্প।

আনোয়ার হোসেনের কথামালার মধ্যে থাকা ইংরেজি শব্দগুলো বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।