মুক্তিযুদ্ধের ছবি নিয়ে যা বলেছিলেন আনোয়ার হোসেন

>২০০৮ সালে আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্রের কাজ শুরু করেছিলেন স্থপতি ও লেখক শাকুর মজিদ। ছবিটি আর শেষ হয়নি। সেখানে নিজের তোলা মুক্তিযুদ্ধের ছবি নিয়ে কথা বলেছিলেন আনোয়ার হোসেন
১৯৭১–এর মুক্তিযুদ্ধের সময় সহযোদ্ধার সঙ্গে থ্রি–নট–থ্রি রাইফেল ও ওয়ান টুয়েন্টি ক্যামেরা হাতে সেদিনের তরুণ আনোয়ার হোসেন (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭১–এর মুক্তিযুদ্ধের সময় সহযোদ্ধার সঙ্গে থ্রি–নট–থ্রি রাইফেল ও ওয়ান টুয়েন্টি ক্যামেরা হাতে সেদিনের তরুণ আনোয়ার হোসেন (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

আজ আমার সুখ ও দুঃখ দুটোই হচ্ছে। আজ ১৬ ডিসেম্বর ২০০৮। (ওই দিনের পত্রিকা দেখিয়ে) আমাদের জাতীয় প্রকাশনা এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় এখানে (ক্রোড়পত্রে) মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের যে ছবিটা দেখছেন, ওটা আমার গ্রামের, ওখানে (ছবিতে) যাঁরা আছেন, তাঁরা আমার বন্ধু–আত্মীয়। এর মধ্যে তিন/চারজন চাচাতো ভাই। আমি ওই মুক্তিযোদ্ধা দলে ছিলাম—দোহারের চরকুশা, বাস্তা, জয়পাড়া—এসব এলাকায়। সেখানেই এই ছবিটি (রাইফেল হাতে মুক্তিযোদ্ধারা) তুলেছিলাম।

এই ছবিসহ মুক্তিযুদ্ধের সময় তোলা আমার অন্যান্য ছবি—এগুলো এখন পাইকারি হারে ছাপা হচ্ছে। কিন্তু এঁরা কোথাকার মুক্তিযোদ্ধা, এঁদের নামটা কী, এঁদের গ্রামের অন্তত নামটা কী; আমাদের মা–বোনেরা আমাদের প্রত্যেকের একেকটা নাম দিয়েছেন, আমাদের সবারই একটা নাম আছে। তবে কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় এসব ছবি ছাপা হলেও আলোকচিত্রী বা ছবির পাত্রপাত্রীর কোনো নাম–নিশানা নেই। আমার তোলা মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো, এটা যেমন বিজয়ের ছবি, আরেকটা ছবি আছে, যেখানে বাংলাদেশের মানচিত্রওয়ালা পতাকা নিয়ে বসে ঘাসফুল চিবুচ্ছেন আমারই দুই মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু, আর তাঁদের পেছনে বসে আছেন অন্য মুক্তিযোদ্ধারা—এই ছবিগুলো এই ২০০৮ সালেও ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারি ও বেসকারি উদ্যোগে নানা পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। কিন্তু এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচিতি নেই, তাঁদের গ্রামের নাম নেই, এমনকি আমি যে এই ছবিটা তুলেছি, তাতে আলোকচিত্রী হিসেবে আমার নামও নেই। কয়েক দিন আগে এক পত্রিকা অফিসের একজন আমাকে বললেন, ‘ওহ, এটা আপনার তোলা ছবি, আমরা তো জানতামই না, অথচ এটা মুক্তিযুদ্ধের বহুল প্রচলিত ছবি!’ কথা হলো বহুল প্রচলিত ছবি যদি হয়, তাহলে এই না জানার ব্যাপারটা ঘটল কেন? সরকার যে ক্রোড়পত্র করছেন, ক্রোড়পত্রে ছাপা হচ্ছে ছবিটা, এর নিশ্চয় বড় একটা বাজেট আছে। বছরের পর বছর ধরে একই ঘটনা ঘটছে, অথচ এটা যে আমার ছবি, ছবির পাত্রপাত্রীরা যে আমার গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা, এটা কেউ জানে না। এটা অন্যায়। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল স্বদেশ আর মাটির জন্য, বাংলাদেশের জন্য আমার বন্ধুরা যুদ্ধ করেছিলেন এবং আমি মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি তুলেছিলাম। মু্ক্তিযুদ্ধে আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম আমার ক্যামেরা নিয়ে। তাই এখনো যখন মুক্তিযুদ্ধের এসব ছবির অবহেলা দেখি, ছবির স্রষ্টা, ছবির যাঁরা প্রাণ, তাঁদের অবহেলিত হতে দেখি, এটাকে আমি মুক্তযুদ্ধের প্রতি অবহেলাই বলব।