বুদ্ধিজীবীর দায় ও শহীদুল্লা কায়সার

তখন বোধ হয় সবে হাইস্কুলে প্রবেশ করেছি। বাবাই ছিলেন আমাদের বড় শিক্ষক। বাবার সঙ্গে গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটা ছিল এক দারুণ শিক্ষাসফর। বাবা কোনো না–কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে হাঁটতেন। গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কখনো গাছের পাতা ছিঁড়লে শুরু হতো কেন গাছের পাতা ছেঁড়া উচিত নয়—এই নিয়ে বিচিত্র সব কথাবার্তা। এই আলাপ গড়াত জগদীশচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে ধর্মগ্রন্থ পর্যন্ত। আবার কখনো কখনো স্কুলের পাঠ্য কোনো রচনা বা ভাবসম্প্রসারণে প্রাসঙ্গিক কী কী উদ্ধৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে তা–ও তিনি বলতেন। ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’—পরীক্ষার জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ এই ভাবসম্প্রসারণে প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলতেন, ‘এ ক্ষেত্রে তুমি ডা. লুৎফর রহমানের একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করতে পার। উদ্ধৃতিটা এ রকম, “যদি কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে চাও তবে সেই জাতির শিক্ষিত ও জ্ঞানী মানুষের মাথা কাটো”।’ বাবার কথা শুনে আমার বালক–মনে হঠাৎই জ্বলে উঠত পাঠ্যবইয়ে পড়া বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি তারিখ—১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। বাবার মুখে শোনা লুৎফর রহমানের সেই উক্তি আমাকে স্কুলপাঠ্য ভাবসম্প্রসারণের জগৎ থেকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে এনে ফেলে দেয় ১৯৭১ সালের বিভীষিকার মধ্যে, বুদ্ধিজীবী হত্যার ইতিহাসের মধ্যে। আমি হাবুডুবু খেতে থাকি পাঠ্যবইয়ে পড়া ১৯৭১-এর আগের ইতিহাসের ভেতরে। বইয়ের পাতার জড়তা থেকে মুক্ত হয়ে কিছু শহীদ বুদ্ধিজীবীর বিষণ্ন মুখচ্ছবি ঘাই মারতে থাকে আমার মাথায়। মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে কয়েকটি চেহারা।

চশমা পরা দীপ্ত অথচ আমার দৃষ্টিতে বিষণ্ন চেহারার শহীদুল্লা কায়সার (১৯২৭—১৯৭১)-এর চেহারা ছিল এই ‘কয়েকটি চেহারা’র মধ্যে অন্যতম।

শহীদুল্লা কায়সার বাংলাদেশের একজন বুদ্ধিজীবী ছিলেন। এখন বুঝতে পারি বুদ্ধিজীবী মানে কী। বুদ্ধি আর মেধাকে কাজে লাগিয়ে যিনি জীবিকা নির্বাহ করেন, তিনি বুদ্ধিজীবী! তা অবশ্য। কিন্তু পৃথিবীতে কিছু মানুষ যেমন আহার, নিদ্রা, সন্তান উৎপাদনের বাইরেও পৃথিবীর অপরাপর মানুষের জন্য বাড়তি কিছু কাজ না করে পারেন না, বুদ্ধিজীবীর ব্যাপারটাও তেমন। এখন এই ধারণা খুব দৃঢ় হয়েছে যে বাড়তি কিছু না করে থাকতে না পারার বিষয়টি যুক্ত না থাকলে যত মহৎ পেশাতেই থাকুন না কেন, তিনি বুদ্ধিজীবী নন। শিক্ষকতা, ওকালতি, সাংবাদিকতা, ডাক্তারি, লেখালেখি—এগুলো পেশা। এইসব পেশার মানুষেরা স্বভাবতই বুদ্ধিজীবী—এই তত্ত্ব এখন আর মানতে মন সায় দেয় না। এই পেশাগুলো যখন কারও একান্তই ক্ষুণ্নিবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত থাকে, তখন এর সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষটি স্রেফ একজন পেশাজীবী ছাড়া আর কিছুই নন। কিন্তু এসব কাজ যখন ব্যক্তির সচেতন সত্তায় ধাক্কা দিয়ে তাঁকে তাঁর কাজসহ নিয়ে আছড়ে ফেলে দেয় দেশ ও দশের মধ্যে, তিনি তাঁর কাজের জন্য যখন চক্ষুশূল হন কায়েমি স্বার্থবাদী শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা, তখনই তিনি হয়ে ওঠেন বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবী তিনি, যিনি তাঁর জ্ঞান-বুদ্ধিকে তাঁর জাতির কল্যাণে ব্যয় করতে চান। তিনিই বুদ্ধিজীবী, যিনি জাতির সংকটে নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন। ফলে বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠার ব্যাপার, স্বভাবত কোনো বিষয় নয়। এ কারণে বুদ্ধিজীবিতা সব সময় সব কালে একটা বাড়তি ঝুঁকির বিষয়। বুদ্ধিজীবিতা ভোগ এবং উপভোগের কোনো বিষয়ও নয়। বুদ্ধিজীবী সম্পর্কিত এই পাঠ আমরা দাঁড় করিয়েছি শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের জীবন ও কর্ম ছেঁকে। তাঁর জীবনব্যাপী কর্মকাণ্ডই বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা আর দায় বোঝার জন্য যথেষ্ট বলে মনে করি। একজন প্রকৃত বুদ্ধিজীবী নিজেই বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা। বুদ্ধিজীবী সম্পর্কিত সহস্র-অযুত-নিযুত পৃষ্ঠা তাঁর জীবনের কাছে অচল।

প্রশ্ন ওঠে, শহীদুল্লা কায়সার তাঁর ক্ষুণ্নিবৃত্তির বাইরে বাড়তি কী করেছেন? শহীদুল্লা কায়সারের জীবন ও লেখালেখির দিকে নজর দিলে দেখব, তাঁর জীবনের প্রায় ষোলোআনাই রুটিরোজগারের বাইরের কাজে কেটেছে। ১৯৪০ সালে কলকাতায় ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’বিরোধী আন্দোলন করেছেন নিতান্ত কিশোর বয়সে। ১৯৪৮ সালে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের সুবেহ সাদেকে’ তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হলে সব কমিউনিস্ট কর্মী যখন আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছেন, তখন তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাকিস্তান বিরোধিতার কারণে একটা বড় সময় তাঁকে কাটাতে হয়েছে জেলে। দেশ ও দশের জন্য বিচিত্র বিপরীতধর্মী কর্মতৎপরতার যজ্ঞে ডুবে থাকতেন বলে তাঁকে সমকালে অনেকে বলতেন ‘কলিকালের সব্যসাচী’।

শহীদুল্লা কায়সার তাঁর নাতিদীর্ঘ জীবনে রচনা করেছিলেন দুটি উপন্যাস; সারেং বৌ (১৯৬২) ও সংশপ্তক (১৯৬৪)। উপন্যাস দুটিও তাঁর বুদ্ধিজীবীসুলভ জীবন-চেতনার সঙ্গে খুবই সম্পর্কিত। সারেং বৌ উপন্যাসটি আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় একজন ‘ছোট’ সারেং কদম এবং তার বউ নবিতুনের সংসারজীবন আর প্রেমানুভবের টানাপোড়েনের আখ্যান। সেটা সত্যও বটে, কিন্তু তারচেয়েও বেশি করে চোখে পড়ে জনজীবনের এক গভীর তলকে তুলে আনার চেষ্টা। ভেবে বিস্ময় মানতে হয়, শহীদুল্লা কায়সার গ্রামজীবনের কত গভীরে ডুব দিয়েছিলেন! উপন্যাসটির ভাষা আর লোকচেতনা এমন একাকার হয়ে গিয়েছে যে এই গুণটি বাংলাদেশের খুব কম ঔপন্যাসিকের মধ্যে পাওয়া যাবে। উপন্যাসটিতে একজন খাঁটি মার্ক্সসিস্ট সব সময় ক্রিয়াশীল থেকেছে। জনজীবনের ভাষাকে অবলম্বন করে অনেকে উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু পূর্ববাংলার বাক্​ভঙ্গি আর শব্দভান্ডারের এমন আকাঁড়া প্রকাশ খুব কম লেখকের মধ্যে পাওয়া যাবে। লোকমানুষের ভাষার অন্তর্তলের এমন দরদি ও অমোঘ খবর একজন মার্ক্সসিস্ট হিসেবে শহীদুল্লার ভালো জানা ছিল। এ কারণে তিনি তাঁর উপন্যাসে লোকমানুষের গহিন অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে লোকগানের ব্যবহার করেছেন মাঝেমধ্যেই। গরিবের সংগ্রামের এই মর্মস্পর্শী বয়ান হাজির করা দেশ ও দশের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত মানুষের পক্ষে ছাড়া সম্ভব নয়।

একজন বুদ্ধিজীবী সর্বদা সচেতন থাকেন তাঁর স্বদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের গতিবিধি বিষয়ে। তিনি নির্মাণ করতে চান তাঁর স্বদেশের কাঙ্ক্ষিত ইতিহাস। তবে যুগে যুগে ক্ষমতাধরেরা নিজের মতো করেই নির্মাণ করতে চায়। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই কাজটাই করতে চেয়েছিল; তারা বাংলার ইতিহাসকে ইসলামীকরণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু একজন প্রকৃত লেখক-বুদ্ধিজীবী, স্বদেশের জনগোষ্ঠীর অভিভাবক রাগী বুদ্ধিজীবীর দায় থাকে ইতিহাসকে জনগোষ্ঠীর মনন-মনস্বিতার পক্ষে রাখা। সংশপ্তক উপন্যাসে শহীদুল্লা কায়সার সেই কাজটিই করতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের উপন্যাসের ইতিহাসে সংশপ্তক প্রথম রাজনৈতিক উপন্যাস, যেখানে তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুর ঘেরাটোপের মধ্যে থেকেও অসাম্প্রদায়িক বাংলার ইতিহাসের বয়ান হাজির করেছেন। এ সম্পর্কে সংশপ্তক উপন্যাসের ভূমিকায় জহুর হোসেন চৌধুরী বলেছেন, ‘রাজনৈতিক পটভূমিকায় রচিত উপন্যাসকে সার্থক করে তোলার কঠিন কাজে জীবনের অন্য ক্ষেত্রের মতোই শহীদুল্লা কায়সার সফল হয়েছেন। এ দেশে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত জীবন নিয়ে এবং অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে অনুপ্রাণিত প্রথম সার্থক সৃষ্টি সংশপ্তক।’

শহীদুল্লা কায়সার বেঁচেছিলেন—বলা ভালো তাঁকে বাঁচতে দেওয়া হয়েছিল—মাত্র ৪৪ বছর। এই ৪৪ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনে তিনি সেই কাজটিই করেছিলেন, একজন প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর যা করণীয়। তিনি জানতেন তাঁর স্বজাতির অগ্রসর মানুষ হিসেবে তাঁর দিকে তাঁর স্বজাতি তাকিয়ে থাকে। তাঁর সারা জীবনের কর্ম আর সৃজনশীলতা দিয়ে তিনি সেই তাকিয়ে থাকার মূল্য দিয়েছিলেন। এই মূল্য এমনকি তিনি নিজের জীবন দিয়ে দিতে পিছ–পা হননি। আজকের দিনে শহীদুল্লা কায়সার আমাদের বর্তমান বুদ্ধিজীবিতার জন্য এক দৃষ্টান্তই বটে।

শহীদুল্লা কায়সার
শহীদুল্লা কায়সার

শহীদুল্লা কায়সার

শহীদুল্লা কায়সারের জন্ম ১৯২৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মাজুপুর গ্রামে। তাঁর পুরো নাম ছিল আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লা। সমসাময়িক রাজনৈতিক আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে একাধিকবার কারাবরণ করেছেন। ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। সাংবাদিকজীবনের হাতেখড়ি ইত্তেফাক পত্রিকায় হলেও বেশির ভাগ সময় কাজ করেছেন সংবাদ–এ। ছিলেন সংবাদ–এর সহযোগী সম্পাদক। দেশপ্রেমিক ছদ্মনামে ‘রাজনৈতিক পরিক্রমা’ ও বিশ্বকর্মা ছদ্মনামে ‘বিচিত্রা কথা’ শিরোনামে কলাম লিখতেন তিনি। তাঁর বইয়ের মধ্যে সারেং বৌ, সংশপ্তক—এই দুই উপন্যাস ছাড়াও রাজবন্দীর রোজনামচা, পেশোয়ার থেকে তাসখন্দ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ১৯৬২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। ১৯৭১–এর ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আলবদর বাহিনী ঢাকার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় তাঁকে। তিনি আর ফেরেননি।