তাঁর অভাব আমি খুব বোধ করি

>

২০১০ সালে নিউইয়র্কে একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। সেই সাক্ষাৎকারে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন তিনি। এ লেখাটি তৈরি করা হয়েছে সৈয়দ হকের কথামালার নির্বাচিত অংশের সমন্বয়ে।

সিরাজুদ্দীন হোসেন আমাদের খুব বড় মাপের, বড় মানের একজন নির্ভীক সাংবাদিক ছিলেন। এই ‘ছিলেন’ বলতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তিনি আমার চেয়ে বয়সে কিছু বড় ছিলেন এবং আমি যখন এ পৃথিবীতে এখনো রয়েছি, তাঁরও থাকার কথা। কিন্তু তিনি যে পৃথিবীতে নেই, তাঁকে যে আমরা শহীদ বলে অভিহিত করি, এর পেছনে রয়েছে বাংলার একটি ইতিহাস। সেই ইতিহাস হচ্ছে ১৯৭১ সালের।

সেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ঢাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করেছিল। অগ্নিকাণ্ড, লুট, ধর্ষণ সর্বোপরি মানুষ খুন করেছিল, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল। নগরের বস্তির পর বস্তি, জনপদের পর জনপদ, বসতির পর বসতি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তারা ভেবেছিল যে এভাবে বাঙালিকে দমন করা যাবে। এভাবে বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহাকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যাবে। সেটা যে যায়নি, তার প্রমাণ তো আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

কিন্তু এই যে ১৯৭১ সাল, এই গণহত্যার বিরুদ্ধে বাঙালি যে রুখে দাঁড়িয়েছিল, সেটা শুধু অস্ত্র হাতে নয়, বিশ্বব্যাপী জনমত সৃষ্টি করা এবং মানুষের কাছে প্রকৃত খবর পৌঁছে দেওয়া, প্রতিদিনের ঘটনাবলি, নির্মম অত্যাচারের কাহিনি, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কাহিনি, বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাহিনি জানিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল, বিশ্লেষণ করার দরকার ছিল, বোঝার দরকার ছিল কেন বাঙালিকে স্বাধীন হতে হবে। কেন বাঙালিকে তার নিজের একটি রাষ্ট্র পেতে হবে, সেই কাজটিতে শুধু যোদ্ধারা নন, কলম সাংবাদিকেরা, কণ্ঠ সাংবাদিকেরা কাজ করেছিলেন বেতারে, লিখে, প্রচারে।

সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন ইত্তেফাক-এর বার্তা সম্পাদক। তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারের কাহিনি নিপুণভাবে বিশ্লেষণ করে পুঙ্খনাপুঙ্খভাবে বিশ্ববাসীর কাছে জানিয়ে দিচ্ছিলেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর মাসে আমি নিজে বিবিসির সঙ্গে খণ্ডকালীন সংবাদপাঠক হিসেবে যুক্ত ছিলাম, সংবাদ বিশ্লেষণগুলো প্রচার করতাম অনুবাদ করে এবং সেই সময় দেখেছি সিরাজুদ্দীন হোসেনের যেসব বিশ্লেষণমূলক রচনা, সংবাদভাষ্য এবং সংবাদ বিবিসির সংবাদকক্ষে লন্ডনে এসে পৌঁছাচ্ছে, সেগুলো কী নিপুণভাবে বলে দিচ্ছে, কী প্রত্যক্ষদর্শীভাবে বলে দিচ্ছে, আমরা কী চাই, ইতিহাস কী চায় এবং ইতিহাস কোন দিকে বাঁক নিচ্ছে। এই যে কাজ, এই কাজ আজকে ২০১০ সালে বসে যখন বলছি, তখন মনে হতে পারে, এটা তো যেকোনো সাংবাদিকের কাজ, কিন্তু মনে রাখতে হবে ১৯৭১ সালে সেই অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে বসে একজন সাংবাদিক নির্ভীকভাবে যে বার্তাগুলো পাঠাচ্ছেন, সেই পাঠানোটা খুব সহজ ছিল না। অত্যন্ত বিপদসংকুল ছিল। শত্রুর অগোচরে, শত্রুপ চোখে ধুলো দিয়ে গোপনপথে এই সংবাদভাষ্য, এই সংবাদ বিশ্লেষণগুলো সিরাজুদ্দীন হোসেন পাঠাতেন। লন্ডন বিবিসি বাংলা বিভাগ থেকে এবং তৎকালীন লন্ডন রেডিও থেকে সেই সংবাদগুলো, সে বার্তাগুলো, সে বিশ্লেষণগুলো প্রচারিত হতো, তাতে যাঁরা বাঙালি ছিলেন সারা বিশ্বে, তাঁরা অনুভব করতেন, যে যুদ্ধ একটা হচ্ছে, সেটা মুক্তিযুদ্ধ এবং এই মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিপক্ষের জয় অবশ্যম্ভাবী, পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হবেই হবে। এ ব্যাপারটি যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তৎকালীন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ টের পেয়ে যায়, তখন তারা লেলিয়ে দেয় কাদের? সেই পাকিস্তানের দালাল যারা ছিল, সেই রাজাকার, আল বদর, আল শামস, সেই শান্তি কমিটির লোকজন, তাদের হাতে দায়দায়িত্ব দেয় সিরাজুদ্দীন হোসেন এবং তাঁর মতো যাঁরা নির্ভীক, অকুতোভয় হয়ে যাঁরা বিশ্ব জনমত তৈরি করছিলেন, তাঁদের যেন নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়।

আমরা ১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যার কথা জানি, অনেক বুদ্ধিজীবীকে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল, তার ঠিক চার দিন আগে ১০ ডিসেম্বর সিরাজুদ্দীন হোসেনকে এই দালালেরা, রাজাকারেরা ধরে নিয়ে হত্যা করে। তিনি ছিলেন—এ কথাটা বলতে যে আমার কষ্ট কেন হয়, সেই কথাটাই আমি আপনাদের একটু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছি।

সিরাজুদ্দীন হোসেনের মতো নির্ভীক, অকুতোভয় সাংবাদিকের প্রয়োজন আছে। তাঁর মতো সন্তানের প্রয়োজন আছে বাংলা মায়ের। তামি তাঁকে খুব যে কাছে থেকে জানতাম, সেটা নয়, কিন্তু সে সময় পূর্ব বাংলায়, ঢাকায় শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক—এঁদের সংখ্যা এমন কিছু বড় মাপের ছিল না এবং আমরা সবাই সবাইকে জানতাম, চিনতাম, একসঙ্গে উঠতাম, বসতাম, চা খেতাম। প্রেসক্লাব আমার এবং আমাদের মতো কবি-সাহিত্যিকদের একটা প্রিয় জায়গা ছিল আড্ডা দেওয়ার, কথা বলার এবং এর ভেতর দিয়ে আমাদের যে স্বাধীনতার স্পৃহা সেই ষাটের দশকে জাগ্রত হচ্ছিল, সে সম্পর্কেও সাংবাদিক বন্ধুদের কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু জানতে পারতাম। ঠিক এ রকম সূত্রে সিরাজুদ্দীন হোসেনের সঙ্গে আমার পরিচয়, ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে। তাঁর ভেতরে একটি বিশ্বাস দেখেছি, সেই যখন ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হলো অঘোষিতভাবে; পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ করে যে তাঁর গান গাওয়া যাবে না, তাঁর কথা বলা যাবে না, তাঁকে নিয়ে সভা করা যাবে না, রবীন্দ্রনাথ আমাদের কেউ নয়, ঠিক সেই সময় সিরাজুদ্দীন হোসেন বলতেন, আমার এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, ‘রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে কোনো বাঙালি তার অস্তিত্ব আছে বলে ভাবতে পারে না।’ এবং এরই সূত্র ধরে তিনি বলতেন, তখনো স্বাধীনতার কথা উচ্চারিত হয়নি ষ্পষ্টভাবে, ‘আমাদের নিজের জমি খুঁজে পেতে হবে, আমাদের অধিকার ফিরে পেতে হবে।’

মনে পড়ে, ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যে ছয় দফা দিলেন, সেই ছয় দফা আসলে কী, তা নিয়ে যেমন কাগজে বিস্তর লেখা হচ্ছিল, আমরাও কিন্তু আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদের জিজ্ঞেস করতাম, আমাদের একটু বুঝিয়ে বলুন, আমাদের একটু জানিয়ে দিন ভেতরের কথাগুলো। কারণ, আমাদের মনে হচ্ছিল, কবি-লেখক-সাহিত্যিক, আমরা যাঁরা সরাসরি রাজনীতি করি না, কিন্তু রাজনীতির অন্তর্গত, দেশ-মানুষের অন্তর্গত, দেশের ইতিহাসের ভেতর আমরা যারা অবস্থান করছি, আমরা বুঝে দেখতে চাইছিলাম, এই ছয় দফা বাইরের কেবল কিছু কথা, কিন্তু ভেতরে বা শিকড়ে আরও কিছু কথা রয়েছে, আরও কিছু সত্য রয়েছে। আমরা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা করতাম, তারই একটি পর্যায়ে আমার মনে পড়ে, একদিন বিকেলবেলায় সিরাজুদ্দীন হোসেন প্রেসক্লাবের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘আমার মনে হয়, আমরা বোধ হয় স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হচ্ছি।’ এ রকম একটি অগ্নিময় শব্দ—স্বাধীনতা, সিরাজুদ্দীন হোসেনের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে শুনেছি সেদিন। এ রকম একজন মানুষ আজ নেই, তাঁর অভাব আমি খুব বোধ করি।

সিরাজুদ্দীন হোসেন
সিরাজুদ্দীন হোসেন

সিরাজুদ্দীন হোসেন

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশার প্রথম শিকার হন সিরাজুদ্দীন হোসেন। ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাক–এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক। ১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ এই দেশে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে সাংবাদিকতা করে গেছেন। সে সময় তাঁর লেখা ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’, ‘অধুনা রাজনীতির কয়েকটি অধ্যায়’ ধরনের উপসম্পাদকীয় এবং ‘এত দিনে’ শিরোনামে সম্পাদকীয় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে তাঁর দৃঢ় অবস্থানের সাক্ষ্য দেয়। সিরাজুদ্দীন হোসেন এ দেশে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জনক। পত্রিকায় তিনি যেসব অসাধারণ সংবাদ শিরোনাম করতেন, সেগুলো বাঙালি জাতির রক্তে আগুন ধরিয়ে দিত। ‘চিনিল কেমনে’, ‘সুকুইজ্জা কডে’, ‘জয় বাংলার জয়’, ‘বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন’ পাঠককে বিষয়ের গভীরে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ছয় দিন আগে ১৯৭১–এর ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা চামেলীবাগের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় তাঁকে। তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।