একাত্তরের মুনীর চৌধুরী

>
ঈশা খাঁ রোডের বাসার সামনে ছোট ছেলে তন্ময়সহ মুনীর ও লিলি চৌধুরী, ১৯৭০। ছবি: জালাল আহমেদ
ঈশা খাঁ রোডের বাসার সামনে ছোট ছেলে তন্ময়সহ মুনীর ও লিলি চৌধুরী, ১৯৭০। ছবি: জালাল আহমেদ

শহীদ বুদ্ধিজীবী ও লেখক মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী লিলি চৌধুরী। এ লেখায় তিনি তুলে ধরেছেন ১৯৭১ সালে তাঁর স্বামীর দিনযাপনের চিত্র।

১৯৭১ সালের স্মৃতি আমার বুকের ভেতর, হাড়–পাঁজরে থরে–বিথরে সাজানো রয়েছে। প্রথমেই মনে পড়ে ২৫ মার্চের সেই বিভীষিকাময় রাত। আমরা তখন থাকতাম নীলক্ষেতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোয়ার্টারে। শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ রাত ১২টার দিকে শুরু হলো ভীষণ গোলাগুলির শব্দ।
দোতলায় ছিল আমাদের বাসা। গুলাগুলির শব্দে বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। আমার এক দেবর ওই সময় ফোন করলেন। মুনীর চৌধুরী ফোনটা ধরে দু–একটা কথা বলার পরই লাইন কেটে গেল। তখন মুনীর শুধু একবার বলল, ‘আর্মিরা ট্যাংক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।’ ওই সময় চারপাশের পরিস্থিতি দেখে আমি বেশ ভয় পেয়ে যাই, আমার স্বামীও।

সেই রাতে বাচ্চারা ঘুমালেও, আমরা বড়রা বেশ শঙ্কা নিয়ে জেগে ছিলাম। এ সময় প্রথমেই আমার মাথায় এল, বিছানা থেকে তোশক নামিয়ে মাটিতে ঘুমাতে হবে। কারণ উঁচুতে ঘুমানো কোনোভাবেই নিরাপদ ছিল না। জানালা দিয়ে গুলি চলে আসার আশঙ্কা ছিল। আমার ছোট ছেলে তন্ময়ের (আসিফ মুনীর) বয়স ছিল তখন সাড়ে তিন বছর। ও ঘুমাত একটু উঁচু একটা বেবিকট বা খাটে, বারান্দার ঝুলন্ত দোলনায়। দোলনা থেকে ওকে নামিয়ে নিয়ে এলাম। পাশের ঘরে আমার আরও দুই ছেলে ভাষণ (আহমেদ মুনীর) আর মিশুক (আশফাক মুনীর) ছিল। ওদেরও তোশক মাটিতে নামিয়ে মেঝেতে ঘুমাতে বললাম। এসব বিষয়ে আমার স্বামী আমাকে সাহায্য করছিল। তবু ভেতরে ভেতরে সে যেন হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল। আমি যা-ও একটু কিছুটা ভেবে কাজ করছিলাম, সে পুরোটাই হাল ছেড়ে দিয়ে বসেছিল। আমার ধারণা, দেশে যে এমন কিছু হতে চলেছে এর আভাস মুনীর আগেই পেয়েছিল।

পরে কারফিউ উঠে যাওয়ার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যার খবর আমাদের কানে আসতে থাকে। পরিচিত মানুষদের মৃত্যুর খবর পাচ্ছিলাম। বস্তুত আমরা তখন ছিলাম হতবুদ্ধি অবস্থার মধ্যে। এর ভেতরে আমার স্বামী সিদ্ধান্ত নিল, এখানে এভাবে আর থাকবে না। সে আমাদের সেন্ট্রাল রোডে আমার শ্বশুরবাড়ি—যে বাড়ির নাম ‘দারুল আফিয়া’—সেখানে পাঠিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু আমার মনে হলো, এ মুহূর্তে হাতিরপুলে আমার ননদের বাসাই বেশি নিরাপদ। কারণ সেন্ট্রাল রোডে আমার শ্বশুরবাড়ি ছিল মূল সড়কের পাশে, আর হাতিরপুলে আমার ননদ যেখানে থাকত, জায়গাটি ছিল অপেক্ষাকৃত আড়াল–আবডালময়।
বাচ্চাদের নিয়ে হাতিরপুলে ননদের বাসায় চলে এলাম আমরা। ওই দুর্দিনেও আমাদের বেশ যত্নআত্তি করলেন আমার ননদ। ওখানে আমরা ছিলাম প্রায় দুই মাস।

তবে আমি জানতাম না মুনীর ওখানে থাকতে খুব একটা স্বস্তি বোধ করছে না, বোনের বাসার চেয়ে সেন্ট্রাল রোডে বাবার বাসায়ই থাকতে চাইছে সে। মাস দুয়েক পরে সে আমাকে এ ব্যাপারে বললে আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে মূল সড়কের পাশে এমন একটা বাড়িতে থাকা এখন তার জন্য মোটেও নিরাপদ হবে না। তখন সে আমাকে বলল, ‘এই দুই মাসের মধ্যে আমার খোঁজে তো কেউ আসেনি, আমাকে নিয়ে ওভাবে কোনো সমস্যা নেই। ওখানে থাকলে এখন আর অসুবিধা হবে না।’ অগত্যা তার সিদ্ধান্তে আমরা চলে এলাম সেন্ট্রাল রোডের দারুল আফিয়ায়, আমার শ্বশুরবাড়িতে।

এর মধ্যে মে মাসের দিকে হঠাৎই মুনীরের এক আত্মীয় সুফিয়া ভাবি পেছনের বাড়ি থেকে ডেকে পাঠালেন ওকে। সে গেল এবং ফিরে এল আমার বড় ছেলে ভাষণের লেখা একটি চিঠি হাতে। ভাষণের বয়স সে সময় ১৯ বছর। ইংরেজিতে সেই চিঠিটি ভাষণ লিখেছিল আমাদের উদ্দেশে। চিঠির মূল কথা ছিল, ‘আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। আমার মনে হয়, আমি এভাবে আমার দেশের উপকার করতে পারব। তোমরা ভালো থেকো।’ ওই চিঠিটি পড়ে আমার স্বামী খুব ভেঙে পড়েছিল। সে ধরেই নিয়েছিল যে ওকে বাঁচানো যাবে না। সুফিয়া ভাবির বাসা থেকে আসার পর আমাকে সে প্রশ্ন করেছিল, ‘লিলি, আমি এখন কী করব?’ সেদিন আমি তাকে কোনো উত্তর দিতে পারিনি। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। নিজের ছেলের জন্য সে যে কিছু করতে পারছে না, এটি ভেতরে ভেতরে তাকে খুব কষ্ট দিচ্ছিল।

মানুষ হিসেবে মুনীর চৌধুরী ছিল অহিংস। ভাষণ যুদ্ধে গেছে—এটি জানার পর আমাকে বলেছিল, ‘লিলি, আমাদের ছেলে যুদ্ধে গেছে। যুদ্ধে গেলে তো মানুষ মারতে হয়। ভাষণ যদি মানুষ মারে, তাহলে আগের মতো আমরা ওর দিকে তাকাতে পারব?’

ভাষণের সেই চিঠিটি পলিথিনে মুড়ে ব্লাউজের সঙ্গে একটি সেফটিপিন দিয়ে আটকে আমার বুকের মধ্যে আমি রেখে দিয়েছিলাম যুদ্ধের নয়টি মাস। সে সময় কেবলই আমার মনে হতো, ভাষণ যদি আর ফিরে না আসে, তবে এ চিঠিই হবে ওর শেষ স্মৃতি।

ডিসেম্বর এলে এ রকম কত ঘটনা যে মনের ভেতরে তোলপাড় তোলে—একটার পর একটা! যুদ্ধের প্রথম দিকে মুনীর এতটাই হতবিহ্বল হয়ে পড়ল যে বিষণ্ন মনে সারা দিন তন্ময়কে নিয়েই ব্যস্ত থাকত। পরে অবশ্য স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছে। বাজারে যেত, বাসার জন্য কেনাকাটা করত। কিন্তু সে বাজারে যাক, আমি এটি চাইতাম না। আমার ভয় ছিল, বাইরে বেরোলেই পাকিস্তানি সৈন্যদের নজরে পড়বে সে। এ নিয়ে তার প্রতি রাগও দেখিয়েছি আমি, বলেছি, ‘তুমি কি বাজার সরকার?’

আমার স্বামীকে অনেকে পালাতে বললেও সে পালায়নি। তার কথা ছিল, দেশের ভেতরে যেখানেই সে যাক না কেন, কোনো লাভ হবে না, পাকিস্তানিরা তাকে ধরে ফেলবে। এ ছাড়া একাত্তরে মুনীর ছিল শারীরিকভাবে অসুস্থ, তার মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড ব্যথা ছিল। সব মিলিয়ে বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে চাইত না সে। এ বিষয়ে তার সঙ্গে আমার কথা–কাটাকাটিও হয়েছে।

এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়েও যেতে হয়েছে তাকে এবং সেখানে সে যেত নিতান্তই দায়ে পড়ে। সে সময় সম্ভবত জুন–জুলাইয়ের দিকে টিক্কা খান তাকে একটি চিঠি দেয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অধ্যাপক যেন সরকারবিরোধী কাজে যুক্ত না হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য মহোদয় চিঠিটি আমার স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেন। আলাদাভাবে তার নামে এ রকম সতর্ক করে দেওয়া চিঠি পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজিরা দিতে হয়েছিল মুনীরকে। এর আগে অবশ্য সে সব সময়ই বাড়িতেই থাকত।

তাকে টুকটাক লেখালেখিও করতে দেখছি ওই সময়। একাত্তর সালে আমাদের সেন্ট্রাল রোডের বাড়িতে তখন তার ভাইবোনেরা, তাদের পরিবার আসত বিভিন্ন সময়। তাই অত মানুষজনের মধ্যে দিনে তো আর লেখার সময় পেত না, লিখত সাধারণত রাতের দিকে। তার মৃত্যুর পর কয়েকটি নাটক ও অনুবাদের খণ্ডাংশ পাওয়া যায় (যেমন ওথেলো), সেগুলো ওই বছরের লেখা।

যুদ্ধের এই অস্থির সময়ে আগস্ট মাসের দিকে একদিন খবর পেলাম ভারত থেকে ভাষণ দেশে এসেছে এবং হাতিরপুলে আমার ননদের বাসায় উঠেছে। আমাদের সেন্ট্রাল রোডের বাসায়ও যে সে কোনো একসময় আসবে, সে খবরও জানতে পারলাম। এরপর একদিন আমাদের বাড়িতে এল ভাষণ। ছেলে ভেবেছিল, বাবাকে বুঝিয়ে ভারতে নিয়ে যেতে পারবে। সেই দৃশ্যটির কথা এখনো আমার চোখে ভাসে: আমাদের শোয়ার ঘরে বিছানায় বসে আছে মুনীর। আর ভাষণ বাবার সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন বলছে। বাবা ঢাকা ছেড়ে যাবে না, তাই ভাষণের চেহারায় ছিল ক্রোধ; আর ওর বাবা বেশ হতাশ হয়ে বিছানা থেকে কখন যেন মেঝেতে বসে পড়েছেন। সেদিন পুরোটা সময় ওই ঘরে ছিলাম না আমি। তাই পিতা–পুত্রের মধ্যে কী কথা হয়েছিল তা পুরোপুরি বলতে পারব না। তবে এটুকু বুঝেছিলাম, বাপ–ছেলের মতানৈক্য হয়নি। ভাষণ চলে গেল। এই ঘটনায় বোধকরি ভাষণও মনে মনে খুব ভেঙে পড়ে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে এসেছিল বাবাকে নিরাপদে ভারতে নিয়ে যেতে। কিন্তু মুনীর রাজি হয়নি। তাই বাবাকে না নিয়েই তাকে ফিরে যেতে হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় জানালার পাশে থাকতে ভয় পেত মুনীর। ওর মনে হতো বাইরে থেকে আসা গুলিতেই ও মারা যাবে। আমি একদিন ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কোথাও যে যেতে চাও না, ভয় করে না তোমার?’ উত্তরে মুনীর বলেছিল, ‘কী বলছ তুমি? ভয়ে আমার হাত–পা পেটের ভেতরে ঢুকে যায়। থরথর করে কাঁপতে থাকি। কিন্তু লিলি, আমি যে নিরুপায়। মাকে (আমার শাশুড়ি) ফেলে আমি যেতে পারব না।’
তবে ডিসেম্বর মাসের শুরুতে অনেক কষ্টে তাকে ঢাকা ছাড়তে রাজি করিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেটিও আর হলো না, কারণ আমার শাশুড়ি চেয়েছিলেন ওয়ারীতে থাকা তাঁর বোনের পরিবারকেও সঙ্গে নিতে। কথা ছিল, ১৪ ডিসেম্বর আমরা সবাই ঢাকা ছাড়ব, কিন্তু ১৪ তারিখ সকালে আবার কারফিউ এবং তারপরেই তো সব শেষ।

মূলত ১০ ডিসেম্বর থেকেই মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে ঢাকা। এ পরিস্থিতিতে আশাবাদী হয়ে ওঠে মুনীর। বরাবরই সকালে ঘুম থেকে উঠত সে, উঠেছিল ১৪ ডিসেম্বরেও। সাধারণত আমি একটু দেরিতেই উঠতাম, সেদিনও উঠে নাশতার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। ওকে দেখলাম বুকের ওপর একটি রেডিও নিয়ে মাটিতে শুয়ে আছে। যুদ্ধের সময় মুনীর নিয়মিত বিবিসি শুনত। আমাকে দেখে একপর্যায়ে শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বলল, ‘লিলি, আর দেরি নেই। দেশ এবার স্বাধীন হয়ে যাবে। আর ভয় নেই আমাদের। আর্মিরা সব পালাচ্ছে।’ ওর চোখে তখন ভয়হীন এক শিশুর আনন্দ দেখেছিলাম।

পরে দুপুর ১২টার দিকে মুনীর যখন খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন পাঞ্জাবি পরা ২০–২৫ বছর বয়সের একদল ছেলে এল বাড়িতে। দরজায় আঘাত করল, ‘এই খোল।’ পাকিস্তানি নয়, বাঙালি ছেলে, একই ছাই রঙের পোশাক, শাল পরা। কিন্তু এই ছেলেদের দেখে প্রথম দিকে একটুও ভয় পাইনি আমি। কারণ তারা সবাই ছিল বাঙালি। কিন্তু না, তাদের দেখে অবশেষে ভয় পেতেই হলো। হঠাৎই দেখলাম, এক ছেলে একটি বন্দুক বের করে সেটি ধরল মুনীরের পিঠে, আর বন্দুকের স্পর্শে সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠল মুনীর, চলে গেল ওদের সঙ্গে। আমি দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে আসার পর দেখলাম, ও চলে যাচ্ছে, পেছন ফিরে একবার তাকাচ্ছেও না। মুনীর চলে গেল, চলে গেছে।

তাঁর সঙ্গে সেই তো আমার শেষ দেখা। প্রতিবছর ডিসেম্বর আসে, আর আমার চোখে ভাসে ১৯৭১–এর সেই বিষাদময় ডিসেম্বর।

মুনীর চৌধুরী
মুনীর চৌধুরী

মুনীর চৌধুরী
নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক, শিক্ষাবিদ মুনীর চৌধুরী ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানাধীন গোপাইরবাগ গ্রামে। ইংরেজ আমলের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরীর ১৪ সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেও ১৯৫৫ সালে যোগ দেন বাংলা বিভাগে। ১৯৬২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো রক্তাক্ত প্রান্তর, কবর, চিঠি, কেউ কিছু বলতে পারে না, মুখরা রমণী বশিকরণ প্রভৃতি। ১৯৭১–এর ১৪ ডিসেম্বর মুনীর চৌধুরীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের সহযোগী আল–বদর বাহিনী তাঁর বাবার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং সম্ভবত ওই দিনই তাঁকে হত্যা করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় বাবা–মাকে লেখা মুনীর–লিলি চৌধুরীর বড় ছেলে ভাষণের অপ্রকাশিত চিঠি
বৃহস্পতিবার, ৬ মে
ইমরান মহল

আমার প্রিয়,

বাবা, মা, তন্ময়, মিশুক। তোমরা এতক্ষণে জেনে গেছ, আমি বাড়ি ছেড়েছি। আমি তোমাদের সবাইকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। তাই মনে কোরো না, আমি তোমাদের প্রতি রাগের বশে এ কাজ করেছি। আমি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ আমার বিশ্বাস, এই পন্থায় বাংলাদেশকে আমি সেবা করতে পারি, সাধ্যে যতটা কুলায়। আমি কাজের সূত্রে প্রতি ১০–১২ দিন পর ঢাকায় আসব। তখন দেখা করব তোমাদের সঙ্গে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি এবং তা বদলাবে না। তোমাদের সন্তানের জন্য গর্ব কোরো। দেশের এখন আমাদের মতো তরুণদের দরকার, যারা বাংলাদেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। আমাদের স্লোগান হলো, ‘হয় স্বাধীনতা, নয় মৃত্যু’। তবে মুক্ত দেশে তোমাদের সঙ্গে কাটাতে আমি বেঁচে থাকতেই চেষ্টা করব। বাবা, চেষ্টা কোরো শক্ত থাকতে। কিছুকেও ভয় কোরো না। জীবন সম্পর্কে তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি, আর আমি বিশ্বাস করি, তুমিই আমার দেখা সেরা মানুষ। মা, দয়া করে কেঁদো না। তোমার সন্তানের কথা ভাবো, যে দেশের গর্ব হতে যাচ্ছে। তোমাকে ভালোবাসি, মা। আমি জানি, তুমি ভালোবাসো আমাকে। সারা বিশ্বের মুক্তিযোদ্ধা আর তাঁদের সন্তানদের কথা ভাবো, আশা করি তাতে তুমি সান্ত্বনা পাবে। আমার মনপ্রাণ জুড়িয়ে যাওয়া এই মুহূর্তটিতে, মিশুক, ভাইটি আমার, তোকে বড় ভালোবাসি রে। বাবার কথা শুনে চলিস, পুরো পরিবারের খেয়াল রাখিস। তুইই তাদের ভরসা। মা, বাবা, মিশুক, মনটা সবচেয়ে বেশি পুড়বে আমার চোখের মণি তন্ময়ের জন্য। আমার চোখে ও সবচেয়ে মজার মানুষ ছিল, এখনো আছে। তোমাদের যে আমি কত ভালোবাসি, তোমরাও আমাকে কত ভালোবাসো—ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এই বিচ্ছেদ তোমাদের সবার জন্য কষ্টের হবে। সত্যি বলতে কি, আমার জন্যেও তা কী যে কষ্টের। আমাকে বোঝার চেষ্টা কোরো। তোমাদের কাছে যেসব ভুলত্রুটি করেছি, পারলে ক্ষমা করে দিয়ো।

বাবা,
১. সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ কোরো না।
২. আমাকে খোঁজার চেষ্টা কোরো না, তাতে তোমার আমাদের দুজনারই জীবন বিপন্ন হবে।
৩. এই চিঠি ধ্বংস করে ফেলো।
তোমাদের সবার জন্য আমার হৃদয় নিঙড়ানো ভালোবাসা।
ভাষণ
তোমাদের ছেলে

নানা, নানি. দাদি, বাদল মামা এবং পরিবারের বাকি সবাইকে আমার ভালোবাসা
ভাষণ
.....
ইংরেজিতে লেখা এই চিঠিটি বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।