'যদ্দিন লিখতে পারি, তদ্দিনই যেন বাঁচি'

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়ে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ২০১৪ সালে বলেছিলেন তাঁর জীবনের নানা অধ্যায় সম্পর্কে। সেই অন্তরঙ্গ আলাপের বড় অংশ ইতিমধ্যেই ছাপা হয়েছে। এখানে পত্রস্থ হলো ওই কথোপকথনের সর্বশেষ অংশ। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আলতাফ শাহনেওয়াজ

আলতাফ শাহনেওয়াজ: কথা বলতে চাই আপনার খুব জনপ্রিয় কবিতা ‘অমলকান্তি’ নিয়ে। ‘অমলকান্তি আমার বন্ধু...সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।’ অমলকান্তি কি আদতেই রোদ্দুর হতে চেয়েছিল?

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী: এই কবিতায় যে ঘটনাগুলোর উল্লেখ আছে, এর সবই আমার জীবন থেকে নেওয়া, এক বিন্দুও মিথ্যা নয়। অমলকান্তি আমার বন্ধু। নামটাও পাল্টাইনি। অমলকান্তিই তার নাম। গরিব ঘরের ছেলে ছিল। থাকত বস্তিতে। তখন এইট কি নাইনে পড়ি। একদিন আমরা খেলাধুলা শেষে কলকাতার গড়ের ময়দানে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম, কে কী হবে? কেউ বলল, ডাক্তার; কেউ উকিল; কেউবা বলল, মাস্টার হবে। অমলকান্তিকে বললাম, তুই কী হবি? অমলকান্তি বলল, আমি রোদ্দুর হব। ওটা মাথায় ছিল। পরে লিখেছি কবিতাটা। আমার দ্বিতীয় কবিতার বইয়ে আছে। অমলকান্তি কেন রোদ্দুর হতে চায়, জানো? কারণ, একটা ঘিঞ্জি বস্তিবাড়ির মধ্যে সে রোদ্দুর পায় না। ফলে সে রোদ্দুর চাইতে নিজেই রোদ্দুর হয়ে যেতে চেয়েছে। মোদ্দা কথা হলো, অমলকান্তির রোদ্দুর হওয়ার দরকার ছিল।

আলতাফ: কবিতার সঙ্গে কল্পনার যোগ সহজাত। কিন্তু প্রায়ই আপনি বলেন যে কল্পনা করে আপনি লিখতে পারেন না। তাহলে কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় আপনার মধ্যে জন্ম নেয় কবিতা?

নীরেন্দ্রনাথ: একটু আগে আমাকে এই প্রশ্নটা করা হয়েছিল। আমি হাটে-মাঠে ঘুরে বেড়ানো লোক। লোকের মুখের কথা শুনি। লোক যেভাবে কথা বলে সেটাই আমার কবিতার উপকরণ।

আলতাফ: নিখুঁত ছন্দের ভেতর দিয়ে গদ্যের একটা চলন পাওয়া যায় আপনার কবিতায়, এবং সেটি প্রথম বই নীলনির্জন থেকেই। ছন্দময় কাব্যভাষার মধ্যে গদ্যকে প্রতিস্থাপন করা—এই কাজটি কি সচেতনভাবে করেছেন আপনি?

নীরেন্দ্রনাথ: না, এটা সচেতন প্রয়াস নয়, এমনভাবে আমার হয়ে গেছে। খুব খোলাখুলি একটা কথা বলি। যাকে আমরা ছন্দ বলি, সেই ছন্দ সবকিছুতেই আছে। মেয়েটি বসে আছে, এতে একটি ছন্দ আছে, পাশের বাড়ির বউটি স্নান করে এসে ভেজা কাপড় নেড়ে দিচ্ছে, তারও একটা ছন্দ আছে। যা কিছু আমরা বলি না কেন—সবই ছন্দের মাধ্যমে হয়। কিন্তু যেটা আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ছন্দ—যে ছন্দে রামায়ণ, মহাভারত লেখা হয়েছে—আমাদের গদ্য ভাষার ছন্দ। মীর মশাররফ হোসেনের গদ্য ভাষাতে একটা ছন্দ আছে। অসম্ভব ভালো গদ্য লিখেছেন তিনি। এমন গদ্য তিনি লিখেছেন যে মনে হয় এখানে এই শব্দটা তুলে অন্য শব্দ বসাবার কোনো উপায় নেই। তাঁর গদ্যের মধ্যে কোনো শব্দকেই নতমুখ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখিনি। প্রতিটি শব্দই অনিবার্য। কবিতার মধ্যেও তো সেই ভাষাটি রয়েছে।

গদ্য ভাষার নিজস্ব যেটা ছন্দ, সেই ছন্দ যদি কবিতায় চলে আসে ক্ষতি কী। প্রসঙ্গত, দুটি ভাষা পরস্পরের কাছ থেকে শব্দ ধার করে। গদ্য আর পদ্য পরস্পরের কাছ থেকে যদ্দিন না নিতে শিখছে, তদ্দিন গদ্যেরও মুক্তি নেই, পদ্যেরও মুক্তি নেই।

আলতাফ: কবিতার সঙ্গে গদ্যের সম্পর্কটি কেমন হওয়া উচিত?

নীরেন্দ্রনাথ: ওই যে বললাম, দুজনেরই দুজনের কাছ থেকে নেবার রয়েছে। তুমি লক্ষ করে দেখো, কারা ভালো গদ্য লেখেন, প্রধানত কবিরাই কিন্তু ভালো গদ্য লেখেন। একটা উদাহরণ দিই, টিএস এলিয়ট বড় কবি, খুব বড় গদ্যলেখকও তিনি। একটু আগে যে কথটি বলেছি, ভাষার যেমন দরকার আছে অন্য ভাষা থেকে নেবার, তেমনি পদ্যেরও দরকার আছে গদ্যের কাছ থেকে নেবার।

আলতাফ:দীর্ঘদিন আপনি যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতার সঙ্গে। আনন্দবাজার দিয়ে শুরু এবং এখানেই কাটিয়েছেন গোটা সাংবাদিকতা জীবন। সাংবাদিকতায় এসেছিলেন কেন?

 নীরেন্দ্রনাথ: কিছু পয়সা রোজগার করবার জন্য। যখনকার কথা বলছি, সে সময় আমার নিজের হাতখরচ দরকার। তখন আমি কলেজে পড়ি। আমাকে কখনোই মাইনাকড়ি দিয়ে পড়তে হয়নি। তবু হাতখরচ বলে একটা কথা আছে তো। আরে, সিগারেট খাব, তা-ও মায়ের কাছে পয়সা চাইতে হয়। বাজার করতে যাই, সেখান থেকে দুটো পয়সা মারি। তাতেও হয় না। চেষ্টা করলাম দুটো পয়সা রোজগারের। গৃহশিক্ষকতা শুরু করলাম। একটা ছেলেকে যুক্তিবিদ্যা পড়াতাম। এত অবিবেচক ছেলে আমি জীবনে আর দেখিনি। আমি তাকে যুক্তিবিদ্যা পড়াবার ভার নিলাম, আর সেই বজ্জাত সব বিষয়ে পাস করে কিনা যুক্তিবিদ্যাতেই ফেল করল! তখনই বুঝে গেলাম, এ রাস্তা আমার নয়। আমাদের বাড়িতে সবাই পড়াতেন, সবাই ছিলেন অধ্যাপক। সবাই পড়ান, আর একমাত্র আমিই পড়ি। যা হোক, তখনই আমি বুঝে গেলাম শিক্ষক হিসেবে আমার রেকর্ড ভালো না। ফলে অন্য লাইনে গেলাম, মানে সংবাদপত্রে।

আলতাফ: গত শতকের পঞ্চাশের দশকে, যখন আপনি সাংবাদিক হিসেবে নাম লেখালেন, সংবাদপত্রে সেই সময়ের পরিবেশ কেমন ছিল?

নীরেন্দ্রনাথ: একে অপরের সঙ্গে খুব সদ্ভাব ছিল। আমি যখন আনন্দবাজার–এ যোগ দিই তখন সম্পাদক ছিলেন সন্তোষ কুমার ঘোষ। দু-এক দিন কাজ করার পর তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন লাগছে, পরিবেশটা কী রকম। আমি বললাম, ভালো লাগছে। তখন তো উত্তর আফ্রিকায় যুদ্ধ চলছে। খবরের কাগজে সে সময় এখনকার মতো পয়সাকড়ি ছিল না। প্রতিমাসে ৩০ টাকা দিত। কিন্তু তবু সংবাদপত্রজগৎ আমার সেই যে ভালো লাগল, এককথায় চমকপ্রদ পরিবেশ ছিল, আন্তরিকতা ছিল। আর পরে তো সংবাদপত্রই হয়ে গেল আমার ভবিতব্য।

আলতাফ:কবি ও সাংবাদিক—দুই পরিচয়েই আপনি দীর্ঘদিন সক্রিয়। সাহিত্য ও সাংবাদিকতা—এই দুইয়ের মধ্যে কি কোনো বিভেদ আছে? কখনো কি আপনার এমন মনে হয়েছে যে সাংবাদিকতায় না থাকলে আমি আরও বেশি লিখতে পারতাম?

নীরেন্দ্রনাথ: তিরিশের কবি বিষ্ণু দে, তাঁর একটা কাব্যগ্রন্থের নাম সংবাদ মূলত কাব্য। তাহলে এই বিরোধের কথাটা কোত্থেকে এল? আর লেখার কথা বলছ, আমার যা লেখার তা আমি লিখেছি—বেশি-কম নিয়ে ভাবিনি।

আলতাফ: জন্মেছিলেন বাংলাদেশের ফরিদপুরের চান্দ্রা গ্রামে। তারপর পাড়ি দিলেন দীর্ঘ জীবন। এখন আপনার প্রার্থনা কী?

নীরেন্দ্রনাথ: প্রার্থনা এই যে যদ্দিন লিখতে পারি, তদ্দিনই যেন বাঁচি। লিখতে না পারলে বেঁচে থাকা অর্থহীন। ঈশ্বরকে আমরা ‘দত্তাপহারী’ নামে ডাকি। এই শব্দের অর্থ হলো, তিনি যা দেন তা আবার কেড়ে নেন। দেখার ও শোনার ক্ষমতা, ঘ্রাণের ক্ষমতা, কাউকে ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি—এগুলো আমরা ঈশ্বরের কাছ থেকে পাই। একসময় তিনি আমাদের কাছ থেকে এসব ফিরিয়েও নেন। আমি এখন চোখে কম দেখি, কানে কম শুনি। মানে ঈশ্বর ফিরিয়ে নিচ্ছেন এখন। লেখার ক্ষমতাটা এখনো তিনি ফিরিয়ে নেননি। এটা যদ্দিন ফিরিয়ে না নিচ্ছেন, তদ্দিন যেন বাঁচি। তারপর আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই।