অন্তরমহলের আলো

লেখকের কথা /সম্পাদনা: পাপড়ি রহমান, জ্যাকী কবীর প্রকাশক: রাইটার্স ইনক
লেখকের কথা /সম্পাদনা: পাপড়ি রহমান, জ্যাকী কবীর প্রকাশক: রাইটার্স ইনক

লেখকের কথা

সম্পাদনা: পাপড়ি রহমান, জ্যাকী কবীর

প্রকাশক: রাইটার্স ইনক

প্রচ্ছদ: আবু হাসান 

দাম: ৩০০ টাকা

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী এখনো নানা বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার। প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই তাকে করে নিতে হয় তার নিজের পথ। বিদ্যমান সমাজবাস্তবতায় ‘মেয়েলি’ বা ‘নারীসুলভ’ শব্দবন্ধগুলো নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহূত হয় আজও। আমাদের দেশের বাস্তবতায় নারীরা প্রতিনিয়ত নানা নিগ্রহের শিকার হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেসব নিগ্রহ বা অপমানের প্রকাশ সমাজের চোখে নারীকে আরও হেয় করে তোলে। ফলে, নির্যাতন-নিপীড়ন ইত্যাদি প্রকাশে তারা আগ্রহী নয়, উপরন্তু সেগুলো গোপন করারই প্রাণান্ত চেষ্টা করে। সামগ্রিক সামাজিক পরিস্থিতি নারীকে আরও বেশি কোণঠাসা এবং নিজস্ব মর্মবেদনায় নিঃসঙ্গ করে তোলে। এসব প্রতিকূলতার মধ্যেই তবু নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদান রাখা খ্যাতিমান নারীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। রাজনীতি, জ্ঞানবিজ্ঞান, শিল্পসাহিত্য ও বিদ্যায়তনিক নানা ক্ষেত্রে রয়েছে তাদের গৌরবান্বিত পদচারণ। তেমনই দশজন নারী লেখকের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে লেখকের কথা। লেখক হিসেবে তাঁরা যেমন দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত, তেমনি রাজনীতিক এবং উন্নয়নকর্মী হিসেবেও কারও কারও রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান। সৃজনশীল সাহিত্যকর্মের জন্য আড্ডার গুরুত্ব অপরিসীম। পুরুষদের ক্ষেত্রে যেখানে-সেখানে হুটহাট আড্ডায় বসে যাওয়া খুব সহজ হলেও নারীর পক্ষে এখনো সেটা সম্ভব নয়। লেখালেখির জন্য সৃজনশীল আড্ডার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি এবং সেই তাগিদ থেকে ২০০৭ সালের মার্চে শিক্ষাবিদ ড. নিয়াজ জামান ‘গাঁথা’ নামক একটি সংগঠনের সূচনা করেন। মূলত বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে লেখা নারী লেখকদের একটি প্ল্যাটফর্ম এটি। প্রথম থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত হন বাংলাদেশের প্রভাবশালী নারী লেখকেরা। প্রতি মাসেই ‘গাঁথা’ একটি আড্ডার আয়োজন করে এবং বলাই বাহুল্য, এটি নিছক বিনোদনের জন্য নয় বরং সৃষ্টিশীল কাজের জন্য সহায়ক বিভিন্ন বিষয়ই মুখ্য। পারস্পরিক ভাবনা বিনিময়, পরিকল্পনা, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নারীর সার্বিক অবস্থার উন্নয়নকল্পে করণীয় প্রসঙ্গগুলো প্রাধান্য পায় এখানে।

সাক্ষাৎকারদাতার পাশাপাশি গ্রহীতাকেও হতে হয় মেধাবী, জ্ঞানী ও সৃজনশীল। এর মাধ্যমে সাক্ষাৎকারদাতা যেমন অকপট হন, তেমনি গ্রহীতাও তার কাঙ্ক্ষিত উত্তরটি বের করে আনেন। পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া সুষম হলে পাঠক এখান থেকে লাভবান হয়। লক্ষণীয় হলো, এই গ্রন্থে সাক্ষাৎকারগ্রহীতার অব্যক্ত কিন্তু অন্তর্লোকে থাকা কিছু প্রশ্নেরও উত্তর দিয়েছেন এই ধীমান লেখকেরা। এটি সম্ভব হয়েছে সম্ভবত তাঁদের পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সাক্ষাৎকারদাতাদের প্রখর জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার কারণে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যাপক অনুশীলনের ছাপ কয়েকজন সাক্ষাৎকার গ্রহীতার প্রশ্নে স্পষ্ট। আবার কারও কারও জিজ্ঞাসা নিতান্তই অনুজ্জ্বল হলেও সাক্ষাৎকারদাতারা তাঁদের নিজস্ব পদ্ধতিতে সেগুলোকে ভালোভাবে উতরে গেছেন। পাপড়ি রহমান এবং জ্যাকী কবীরের সম্পাদনায় এ গ্রন্থের সাক্ষাৎকারদাতারা হলেন জাহানারা নওশিন, নূরজাহান বোস, আনোয়ারা সৈয়দ হক, নিয়াজ জামান, সালেহা চৌধুরী, মালেকা বেগম, ঝর্ণাদাশ পুরকায়স্থ, সেলিনা হোসেন, ঝর্না রহমান ও পাপড়ি রহমান। নূরজাহান বোসের সাক্ষাৎকারটিতে তাঁর গবেষণার আলোকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারীর পারিবারিক জীবনের নিগ্রহের সাদৃশ্যের কথা তিনি আমাদের জানান। সব দেশেই নারীরা তাঁদের স্বামী কর্তৃক নিগ্রহের শিকার হয়। তাঁদের এই নির্যাতনের রূপটিতে দেশ-বিদেশে খুব বেশি ভিন্নতা নেই। তাঁর বিখ্যাত আত্মজৈবনিক গ্রন্থ আগুনমুখার মেয়েতেও তিনি অকপটে বলেছেন তাঁঁর নিজের জীবনের নির্যাতন নিগ্রহের কথা। সাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক ও সেলিনা হোসেন সৃজনশীল সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন। একজন নারী লেখকের বেড়ে ওঠা, তাঁর সমস্যা-সম্ভাবনা, দর্শন ইত্যাদি উঠে এসেছে তাঁদের কথায়। নিয়াজ জামানের সাক্ষাৎকারটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বসাহিত্যে আমাদের অবস্থান, পিছিয়ে পড়ার কারণ, বর্তমানে করণীয় ইত্যাদি নিয়ে সবিস্তারে কথা বলেছেন তিনি। বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করছেন। অনুবাদ করেছেন প্রচুর। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে নারী আন্দোলনের নেত্রী মালেকা বেগম তাঁর লেখালেখি বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন সাক্ষাৎকারে। একজন নারী উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে সমাজবাস্তবতায় নারী-সম্পর্কিত প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও মূল্যায়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন তিনি। সুনির্দিষ্ট যৌক্তিক কাঠামোতে তাঁর বিশ্লেষণ আমাদের চিন্তাকে উসকে দেয়।

সমাজ পরিবর্তনে প্রাগ্রসর ভূমিকা পালনকারী, চিন্তক ও সৃজনশীল দশজন নারী লেখকের সাক্ষাৎকার পাঠের মাধ্যমে আমরা ঈর্ষণীয় এক আলোকিত জগতে প্রবেশ করি। এই বইয়ের মাধ্যমে তাঁদের সান্নিধ্য লাভ এক বিরল ও অমূল্য অভিজ্ঞতা।