এই নূরী! আয় আয়, এদিকে আয়

কাজী নজরুল ইসলাম, নূরজাহান বেগম
কাজী নজরুল ইসলাম, নূরজাহান বেগম

ছোটবেলার ঈদের কথা ভাবলেই একটা দৃশ্য চোখে ভাসে। তখন আমি খুব ছোট। ঈদের আগের দিন। মা ঘরের কাজ শেষ করে আমার দুই হাতে মেহেদি দিয়েছেন। রাত বাড়ছে। ঘুমে পড়ে যাচ্ছি, অথচ দুই চোখের পাতা এক করার উপায় নেই। বেখেয়ালে যদি মেহেদি নষ্ট হয়ে যায়! মেহেদি শুকিয়ে গেলে মা হাত ধুইয়ে দেবেন, তবেই শান্তি! মনে আছে, ঈদের জামা বালিশের নিচে রেখে ঘুমাতাম। কাউকে দেখতে দিতাম না। সকালে মা গোসল করিয়ে নতুন জামা পরিয়ে দিতেন। বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন মাসিক সওগাত পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আমরা কলকাতায় সওগাত-এর অফিসের ওপরেই থাকতাম। আত্মীয়স্বজন সবাই থাকত বাংলাদেশে, গ্রামে। কলকাতায় আমাদের তেমন কোনো আত্মীয় ছিল না। সে সময় মেয়েদের একা বের হওয়া নিষেধ ছিল। বড়রা তো বের হতোই না, ছোটদেরও বের হতে হতো বাবার সঙ্গে। ঈদের দিন আমার খুব মন খারাপ হতো। নতুন জামা পরে এঘর-ওঘর ছোটাছুটি করতাম। জানালা দিয়ে দেখতাম, কত লোক টুপি মাথায় দিয়ে, নতুন জামা পরে হাঁটছে! ভাবতাম, আমি যে এত সুন্দর জামা পরলাম, আমার জামাটা দেখার কেউ নেই! যেহেতু কলকাতায় আত্মীয়স্বজন খুব বেশি ছিল না, ঈদের দিন বাড়িতে তেমন কোনো অতিথি আসত না।

তবে হ্যাঁ, একদিন এক অতিথি এসেছিল। সে অতিথি মনুষ্যপ্রজাতির কেউ নয়। বিশাল এক কালোমুখো হনুমান! ইয়া লম্বা তার লেজ!

ঘটনাটা খুলেই বলি। আমার বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। চেয়ার-টেবিলে বসে খাওয়ার চল তখন ছিল না। আম্মা দস্তরখানে সেমাই-টেমাই সাজিয়ে রেখেছিলেন, বাবা নামাজ থেকে এসে খাবেন বলে। আমাদের বাড়ির পাশে ছিল এক জমিদারবাড়ি। জমিদার কিছু জীবজন্তু পালতেন। দুটো হনুমানও ছিল। সেই দুটো হনুমানের একটাই সেদিন ঘরে ঢুকে গেল! জানালায় শিক ছিল না, হনুমানটার ঘরে ঢুকতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। আমার সামনেই সাজিয়ে রাখা সব খাবার হনুমানে খেয়ে ফেলল। পোষা জীব, ভয়ও পায় না। উল্টো আমি ভয়ে কেঁদে অজ্ঞান হওয়ার দশা! বাড়ি ফিরে সব শুনে বাবা জমিদারের সঙ্গে কথা বললেন। পরে শুনেছিলাম, হনুমান দুটোকে কলকাতা চিড়িয়াখানায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাবার পরিচিতির সুবাদে অনেক কবি-সাহিত্যিকই সে সময় আমাদের বাড়ি আসতেন। ছোট ছোট পা ফেলে আমি বড় বড় কবি-সাহিত্যিকের মাঝখানে ঘুরে বেড়াতাম! সেখানেই দেখেছিলাম এক সুদর্শন তরুণকে। বলিষ্ঠ গলায় কথা বলতেন, অন্য সব তরুণ তাঁর কথায় সায় জানাত। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। ছোট ছিলাম, কাজী সাহেবের কথা খুব বেশি মনে নেই। তাঁকে যখন জাতীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়, সে সময়টার কথা একটু একটু মনে আছে। লাল গোলাপ দিয়ে সাজানো গাড়িতে কবিকে বন্ধুরা আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়েছিল, জানালায় দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য আমি দেখেছি। সংবর্ধনা শেষেও কবি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। তাঁকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল সোনার কলম, দোয়াত আর ভেলভেটের কাপড়ে মোড়ানো কী যেন!

ওয়ালস্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর আমাদের বাড়িতে কবি-সাহিত্যিকেরা খুব একটা আসতেন না। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর একবার নজরুল এসেছিলেন, সে ঘটনা মনে আছে। কবি আমার মায়ের হাতের রান্না পছন্দ করতেন। সেবার এসে বললেন, তিনি কিছু খাবেন না। বাবা গেলেন কবির জন্য কিছু ফল আনতে। তখন আমি একটু বড় হয়েছি। কবির সামনে যেতে কেমন যেন সংকোচ হচ্ছিল। এক ফাঁকে আমাকে দেখেই কবি ডেকে উঠলেন, ‘এই নূরী! আয় আয়, এদিকে আয়! এখনকার মেয়েরা কত ইঁচড়ে পাকা হয়। আমাদের নূরী তো দেখি আগের মতোই আছে! বস, এখানে বস।’ পাশে বসিয়ে কবি বলেছিলেন, ‘একটা কথা শুনবি? বলি শোন। ধর, তুই দিল্লি যাবি। দিল্লি কতভাবে যাওয়া যায়! রেলগাড়িতে, বাসে, উড়োজাহাজে—গন্তব্য কিন্তু একটাই। জীবনের গন্তব্যও তেমনই!’ কথাটা আমার খুব মনে পড়ে।

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ গানের স্রষ্টা নজরুল। অথচ ঈদের দিন কখনো তেমন এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরেছেন বলে শুনিনি। বাড়িতেই থাকতেন। বন্ধুবান্ধবরা তাঁর বাড়ি যেতেন, সেখানেই গল্প করতেন।

অনুলিখিত