'আমি আমৃত্যু শিখতে চাই': সালাহ্উদ্দীন আহমদ

জন্মদিনে সালাহ্উদ্দীন আহমদের সঙ্গে কথা বলেছেন আজিজুল রাসেল 

সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

আজিজুল রাসেল: আজ আপনার ৯০তম জন্মদিন। এতগুলো বছর অতিবাহিত করলেন, দেখেছেন অনেক কিছু। বিপুল অভিজ্ঞতা আপনার। এ জীবনকে এখন কীভাবে উপভোগ করছেন?
সালাহ্উদ্দীন আহমদ: জীবন কীভাবে উপভোগ করছি বলা মুশকিল। আমার বন্ধুরা তো অনেকেই চলে গেছেন। ওঁদের কথা ভেবে খারাপ লাগে। তবে আমি নিঃসঙ্গ না। সারা দিন ব্যস্ত থাকি। সকালে ঘুম থেকে উঠে বিবিসি সংবাদ শুনি। সকাল সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত সিডি চালিয়ে শুয়ে শুয়ে শুনি ঠুমরি। তারপর উঠে নাশতা করে, ওষুধ খেয়ে সংবাদপত্র পড়ি। এরপর পড়াশোনা করি দুপুর পর্যন্ত। সপ্তাহে দুদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, এই তো...। অভিজ্ঞতা তো অনেক হলো। যে স্মৃতি আমাকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দেয় তা হলো, এই উপমহাদেশের ভাগ, লাখ লাখ মানুষের উদ্বাস্তু হওয়া, মানবতার লাঞ্ছনা। একটা কথা মনে রাখতে হবে, এ অঞ্চলের মানুষেরা একটি কমন সিভিলাইজেশনের উত্তরাধিকারী।
আজিজুল: আপনার জন্ম পশ্চিম বাংলায়, পূর্ব বাংলায় কখন এলেন?
সালাহ্উদ্দীন: দেশ বিভাগের সময়। আমি পাকিস্তান দর্শন বা টু নেশন থিউরিতে বিশ্বাস করে এ অংশে আসিনি। এখনো পশ্চিম বাংলায় অনেক বন্ধুর সঙ্গে আমার কথা হয়। ওদের অনেক মিস করি। আমার স্ত্রী সরকারি চাকরি করত, দেশভাগের সময় সে পাকিস্তান অপশন দিয়েছিল।
আজিজুল: আপনি তো একসময় শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন। কখন থেকে শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন?
সালাহ্উদ্দীন: আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন। আমি সাইকেল শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। খিদিরপুরে পোর্ট ট্রাস্টেও শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করেছি। তাদের বিশ্বাস অর্জন করার জন্য আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। পরবর্তীকালে এম এ পাস করার পর আলিপুরে পোস্টাল ইউনিয়নে কাজ করেছি।

আজিজুল: শুনেছি কমিউনিস্ট নেতা ও লেখক এম এন রায়ের সঙ্গে আপনার খুব ভালো যোগাযোগ ছিল...
সালাহ্উদ্দীন: হ্যাঁ। এম এন রায় একদিন আমাদের স্কুলে এসেছিলেন। আমি তখন কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউটের ছাত্র। আমরা কয়েকজন উৎসাহী তরুণ তাঁর সঙ্গে দেখা করি। স্কুলজীবন থেকেই কমিউনিজমের প্রতি আমার একটা আকর্ষণ ছিল। যখন বাকুড়া জেলা স্কুলে পড়ি, তখন রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি পড়ে মন খারাপ হয়ে যায়। নিপীড়িত মানুষদের জন্য কাজ করার একটা আগ্রহ তৈরি হয়। তো, এম এন রায় আসছেন, তিনি তখন বড় কমিউনিস্ট নেতা, লেনিনের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা, তর্ক-বিতর্ক হয়। তা ছাড়া তাঁর একটি বই পড়েও তাঁর প্রতি খুব আগ্রহী হই— হিস্টোরিকাল রোল অব ইসলাম। সব সময় তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। পাকিস্তান আমলেও তিনি একবার ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁর হিউম্যানিস্ট মেটেরিয়ালিজম দর্শন আমার জীবনে গভীর প্রভাব রেখেছে।
আজিজুল: ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী হলেন কীভাবে?
সালাহ্উদ্দীন: এটা ধরো, হঠাৎ করে। আমার ভেতরে একটা জানার আগ্রহ ছিল, সত্যকে আবিষ্কার করার আগ্রহ। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মানুষের বিবর্তন কীভাবে ঘটেছে, এটাই তো ইতিহাস। ইতিহাসের বিষয়বস্তু হলো মানুষ, মানুষের জীবনকাহিনি, উত্থান-পতন। এসবের প্রতি আগ্রহই আমাকে ইতিহাসে আগ্রহী করেছে। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সুশোভন সরকারের মতো বড় ইতিহাসবিদেরা ছিলেন আমার শিক্ষক। তাঁরা ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
আজিজুল: কিছু কিছু পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদ, যেমন অসীম রায় ও রিচার্ড ইটন দেখিয়েছেন, আমাদের ইসলামের মধ্যে একটি সমন্বয়বাদী ধারা রয়েছে। আপনিও আপনার ‘বাংলার সংস্কৃতিতে মানবতাবাদ’ প্রবন্ধে বলেছেন এ কথা। আপনি কি মনে করেন এই ‘সমন্বয়বাদী ধারা’ তত্ত্বটি ঠিক ছিল? সম্প্রতি কিছু ইতিহাসবিদ—বারবারা মেটকাফ, এ তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
সালাহ্উদ্দীন: হ্যাঁ, এখন দেখা যাচ্ছে আমাদের ইসলামের সমন্বয়বাদী ধারা ক্ষতিগ্রস্ত, হারিয়ে যেতে বসেছে। এটা হচ্ছে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের ফলে। রাজনীতিকে ধর্মে ব্যবহারের ধারা শুরু হয়েছিল উনিশ শতক থেকে। এখন এই ট্র্যাডিশন আরও বেড়েছে। তবে বাংলার ধর্মে সমন্বয়বাদী যে ধারা তা মোটেও ভুল নয়। আমরা যদি রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার থামাতে পারি তাহলে এ সমন্বয়বাদী ধারা, পরমতসহিষ্ণুতা ফিরিয়ে আনতে পারব।
আজিজুল: লেখালেখি করছেন এখনো?
সালাহ্উদ্দীন: এখন লেখালেখি বেশি করছি না। একটি বই নিয়ে কাজ করছি—নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি বেঙ্গল: পারসপেকটিভ ইন সোশ্যাল হিস্টিরি। তবে পড়ছিই বেশি। যেসব বই আগে পড়েছি সেগুলো আবার পড়ছি। সব ধরনের বই-ই পড়ি, যেমন এখন পড়ছি দাউদের ইংরেজিতে অনুবাদ করা কোরআন। বেশ ভালো লাগছে। আমার বেশি ভালো লাগে পড়তে। আমার শোবার ঘরে বই, বসার ঘরে বই। বুঝেছ, লারনিং ইজ আ লাইফ লং প্রসেস। জানার কোনো শেষ নেই। আমি আমৃত্যু শিখতে চাই।