বনপরি, বুনো হাতি, পালকের শাড়ি...এই সব

বনপরি, বুনো হাতি, পালকের শাড়ি
বনপরি, বুনো হাতি, পালকের শাড়ি

কদিন ভারী বৃষ্টির পর পাহাড়ে আজ অন্য রকম আলো। বাংলো টাইপ বাড়ির পেছন বারান্দায় এক কাপ কড়া চা আর সমুচা খেতে খেতে বিভা আপনা থেকেই গুনগুন করে, ‘বনবিবি আসিলো সখী চা-বাগানের ঢালে, সবুজ আলোক নাচে অই ছায়াবীথি ডালে’। এমন নিদানকালে ‘সখী পুড়ি সুখ-অনলে’র মতো দূরে পাহাড়ি বনে গজিয়ে উঠছে হিজল-তমাল, মেহগনি-চাপালিশের চারা। কেওড়াবনে খালে-বিলে ঘ্যাংরঘ্যাং স্বরে গগনবিদারী ডাক ডাকছে সোনাব্যাঙ।
আভা বেশ কিছুক্ষণ ধরে বারান্দায় আসার জন্য বিভার ঘরের দরজায় উঁকি দিয়েছে। সুযোগ না পেয়ে বাড়ির পেছনে গিয়ে সবুজ ঢালে বান্টিকে নিয়ে হুটোপুটি খেলছে। বান্টিটাও আজকাল ওর নেওটা হয়েছে ভারি। ও যখন স্কুলে যায়, ওর পেছন পেছন শায়েস্তাবাড়ি বাজার অবধি চলে যায়। ফেরে ওর সঙ্গেই।
বিভা অবশ্য দেখেও দেখছে না। যত পারুক ঢালে উঠুক। মা দেখলে অবশ্য চেঁচামেচি করে। চা-বাগানে জোঁকের উপদ্রব। এই তো গত সপ্তাহে বিন্দিয়ার রানের মধ্যে আলগোছে ঢুকে পড়েছিল। ফুটো করে রক্ত খেয়ে সে কী রক্তারক্তি। বিন্দিয়া মেয়েটা খুব ভালো। আভাকে ভালোবাসে। আর বিভা ওর কাছ থেকে জানতে পায়, আজকাল কেমন করে বুনো হাতি বাগানে চলে আসছে। না, তাণ্ডব করে না। কেবল আধা মাইল দূরে সরু ঝরনার মতো জায়গাটায় শুয়ে থাকে।
বিন্দিয়া অবশ্য বলে, ‘দিদিমণি, হাতি হাতিই। ও কলা খাবেই। ঘরের হোক আর বনের।’
‘কেন, তোমার হাতিও বুঝি তাই?’—জিজ্ঞেস করতে গিয়েও বিভা মুখে খিল দেয়।
কিন্তু বিন্দিয়াদের তো উদোম ঘর। দরজা-জানালার বালাই নাই। বলে, ‘কাল রাতে সোমেন যা ডলাপিষা দিল গো দিদিমণি; আজ আসতে ইচ্ছা করছিল না।’
হঠাৎ একটা ঝপাৎ শব্দে আনমনা ভাব কেটে যায় বিভার।
আপু! আপু!
ইশ! পড়ে গেল নাকি?
না। বিভা জানে, এখন তাকালেই ওকে ঘরে আসতে দিতে হবে। ও চায় না এই বারান্দাটা কেউ ভাগাভাগি করুক। এটা তার নিজস্ব দ্বীপ। দক্ষিণমুখী বাড়ির পেছনে, মানে উত্তরমুখী বলে ও এটার নাম দিয়েছে উত্তমাশা অন্তরীপ।
আজকাল মাথার ব্যান্ড খুলে ওপর থেকে ঢালে ছুড়ে দেয় সদ্য ক্লাস থ্রিতে ওঠা আভা। ‘বান্টি ক্যাচ’—অমনি দিগিবদিক জ্ঞানশূন্য বান্টি ওটা ধরতে লাফ দেয়। একটা সবুজ সারি পেরিয়ে গেলেই খাড়া ঢাল। ব্যস, ঝপাৎ! তবু সেখান থেকে ব্যান্ড নিয়ে ঘুরপথে ঘুরে ঘুরে আবার চলে আসে বান্টি। লেজ নাড়ায় আর কুঁইকুঁই শব্দ করে। যেন পুরস্কার দাবি করছে।
আভা অবশ্য ওকে তেমন পাত্তা দেয় না। বেশি ঘুরঘুর করলে সপাটে লাথি। তার পরও বান্টি আভাকে ছাড়ে না। যেন বাবা ওকে বডিগার্ড নিয়োগ দিয়েছে। পরে যখন কাদামাখা হতবিচ্ছিরি বান্টিকে পাপিক্লিন শ্যাম্পু দিয়ে গোসল দিয়ে আভা হোমওয়ার্ক করতে বসে, তখন বিভার ঘরের দরজায় চলে আসে বান্টি। ভুকভুক...
অনুমতি চায়। আজকাল এটাই নিয়ম। বিভা না বলে তার ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয় না। মাকেও না। ব্যতিক্রম শুধু শোভন কাকু। বাবার বন্ধু। বয়সে ছোট, তবু বন্ধু। তারা ছুটির দিনগুলোতে দূরে কাপালির বিলে মাছ ধরে, বার্ডওয়াচ করে, কখনো রেয়ার কোনো কিছু পেলে তার ছবি তুলে রাখে। জার্নালে পাঠায়।
ডায়েরির ওপরে বসে পড়া বান্টিকে সরিয়ে দেয় বিভা, ‘দূরে লেজ সোজা করে বসে থাক। নড়াচড়া না।’
একদিন একটা ভারী পাইপে লেজ ঠুসে দিয়ে লেজের আগায় তার দিয়ে গিট্টু লাগিয়ে দিয়েছিল বিভা। সে কি তড়পানো বান্টির। যেন লেজ সোজা হলে ওর জাত যাবে। বিভা তার ডায়েরিতে লেখে: ‘বনপরির চোখেও মাশকারা। অথবা আস্কারা। বলল; মধু খাবে মধু!’
আনমনে একটু হেসে লেখে ‘এস-এর সাথে...’। কী ভেবে যেন সেটা কেটে আবারও লিখল-‘ওর সাথে রোববার জেলে পাড়ায় গেলাম। কত ফুল আর বিলে কত নলখাগড়া।’
বিভা জানে ছোট বোন আভা আজকাল ওর ডায়েরি পড়ে। তারপর নিজের স্কুল-ডায়েরি বের করে লেখে, ‘আজ বান্টির সাথে নীল পাহাড়ে গেলাম। কত ফুল আর ক্যান্ডি; সব নলখাগড়াগুলো ক্যান্ডির। বাবা বলেছে, আমাকে একটা নলখাগড়ার বাঁশি এনে দেবে। বাঁশি বাজালেই বনপরি চলে আসবে।’
বিভা মনে মনে হাসে। আহা বেচারা মা। আজ পুরোটা বিকেল উসখুস করবে। এক কাপ চাও দেবে না। শেষমেশ সন্ধ্যার আগে আগে চা চাইলে বলবে, ‘বাড়িতে চা নেই। জেলেপল্লিতে খুব ভালো চা হয়। কাল নিয়ে এসো আমার জন্যও দুকাপ।’

২.
প্রায় দুই সপ্তাহ শোভনকে পাত্তা দিচ্ছে না বিভা। আগে কেন দিত সে-ও এক রহস্য। তার গাছপালা অন্তঃপ্রাণ আর পক্ষীসন্ধানী চোখে কী করে মাদারের কষ লাগল, ভেবেই পায় না সে।
‘আপনি তো অনেক পাখি দেখেন, বাবার সাথে খালে-বিলে ঘোরেন।’
‘হ্যাঁ।’
‘বাবার চোখ এড়িয়ে আমার জন্য সারলী পাখির পালকের একটা শাড়ি আনতে পারবেন?’
‘পা-ল-কে-র! কী হবে তাতে?’
‘ওটা পরে আমি বনপরিকে একটু রাগিয়ে আসব।’
‘কেন, রাগাবে কেন?’
‘আমি তো তার থেকেও সুন্দরী। আর যদি আপনি একটা পালকের পোশাক এনে দেন, তাহলে তো এই বনটা আমারই হয়ে যাবে।’

বিভার হাসি জোড়পদ্ম দিঘিতে তরঙ্গ তোলে। গঙ্গাফড়িংটা উড়ে গিয়ে বসে পাশের নলখাগড়ায়। আর বুড়ো নলডোঙ্গা পাখিটাকে বানাতে হয় শিকারের নতুন ছক।
‘ওটা কী?’
‘ওর নাম খোঁপাডুবুরি।’
‘খুব পচা নাম।’
‘পচা?’
‘হ্যাঁ’ বলে আবারও হাসে বিভা। জোড়পদ্ম দিঘির পানিতে শীতের বিকেল আরও ঘনীভূত হয়। তখন আর কনে দেখা আলো থাকে না। কালেম পাখিরা, সারলী পাখিরা পাতার আড়ালে সন্ধ্যা খোঁজে। আগে এসব পাখিকে তেমন গুরুত্ব দিত না শোভন। ওর আগ্রহ ছিল কমন্টল, নর্দান স্যাভোলার, ম্যালার্ড, গার্জেনি আর পচার্ড নিয়ে। কত রকমের পচার্ড যে দেখা যেত একটা সময়। রিয়ার্স পচার্ড, কমন পচার্ড, ফেরুজিনিয়াস পচার্ড, রেড ক্রিস্টড পচার্ড। মাঝে মাঝে শোভন চলে যেত টাঙ্গুয়ার হাওরে। পাখির টানে। সেখানেই পরিচয় বিভার বাবা রিয়াদ মাহমুদের সঙ্গে। ভীষণ মাছ ধরার নেশা। তা-ও ট্র্যাডিশনাল বড়শি দিয়ে। আর তার ধৈর্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে পারেন। এতটা পারে না শোভন। ওর মন পাখির মতোই চঞ্চল। ডাল থেকে ডালে লাফিয়ে বেড়ায়। রিয়াদ সাহেব চা নিয়ে গবেষণা করেন। একটা এস্টেটে কাজ করেন। আর গাছের সঙ্গে কথা বলেন। হেন কোনো গাছ নেই যা তার চেনা নয়। আপাত দুই বিপরীত স্বভাবের মানুষের দুই রকম ইন্টারেস্টের পরেও একটা যোগসূত্র ছিল। তা হলো তাঁদের আগ্রহের বিষয়বস্তু একে অন্যের পরিপূরক। বন্ধুত্ব জমতে সময় লাগেনি। যদিও তাঁদের বয়সের ফারাক প্রায় ১৪-১৫ বছর। সেই থেকে আজ প্রায় ১০-১২ বছর ওরা বন্ধু। বিভার মা জাহানারা ভাবি কী অমায়িক। মনে হয় এই মহিলাকে আল্লাহ নিজে সব গুণ দিয়ে পাঠিয়েছে। সংসার আগলে রাখেন, আলাভোলা বাউল স্বভাবের রিয়াদ মাহমুদ আর দুই মেয়ে বিভা-আভাকেও। এত যে টানাপোড়েন, তার পরেও শোভনকে একটা কটু কথাও বলেননি। এমনকি রিয়াদ সাহেবের বিষয়টাও। একদিন শুধু বলেছিলেন, ‘রিয়া বিভার বান্ধবী। শুনলাম আপনার বন্ধু ওকে চা চাষে ছায়াবৃক্ষর গুরুত্ব বোঝানোর জন্য তিন ঘণ্টা বৃষ্টিতে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। তা-ও আধা মাইল দূরের সরু ঝরনার মতো জায়গাটায়।’
এমনটা শুনেছে শোভনও। বাকিটা আঁচ করেছে রিয়াদ সাহেবের আচার-আচরণ থেকে। যে লোক বলে, একা থাকলেই বেশি ডামাডোল শোনা যায়; সেই মানুষ কেমন করে মেয়ের বান্ধবীর সঙ্গে...? না, বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু জগতে বিশ্বাস বলে কিছু নেই। মানুষ যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না, সেটাকেই সে ডার্করুমে ফেলে রাখে। বলে, বিশ্বাস। এই যেমন বিভার জন্য তার জলে-জঙ্গলে-পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো। এই যে একটা গ্রেট বিটার্ন তার চোখের সামনে। হ্যাঁ, মাদি পাখি। খুবই বিরল। বাংলায় বলে বাঘা বগলা। বাঘের মতো রঙের কম্বিনেশন। এর আগে মাত্র দু-তিনবার বাংলাদেশে দেখা গেছে। কিন্তু ক্যামেরায় ক্লিক করল না শোভন। কেবল তাকিয়ে থাকল তীক্ষ সুচালো ঠোঁট আর কালো সোনালি পালকের দিকে। আহা কী বিভা!
‘হুশ হুশ! পালাও।’
এটা তোমার নিবাস না। তুমি চলে যাও তুন্দ্রাঞ্চলে, সাইবেরিয়ায়। বাঘা বগলাটা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে শোভনের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যায় পাতার আড়ালে। নিচে খসে পড়তে লাগল দু-তিনটে পালক। পড়ছে। রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ায় শোভন। জলকাদা মাড়িয়ে পাতার ফোকর দিয়ে পালকটাকে লক্ষ করে। যেন খসে পড়া তারা। ধরবেই ধরবে।
একটা পালকের শাড়ি গড়ে দিতে বলেছে বিভা।
আহারে, গাছের চূড়ায় আলোর নাচন। কী আছে তোমার মনে?
শোভন ডাকে, ‘বিভা বিভা!’
দূরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে বৃক্ষস্বভাবী মেয়েটা। ছোটবেলায় মন খারাপ হলে নাকি ও চাঁপাগাছ জড়িয়ে ধরে কাঁদত। এখন কাঁদে না। খালি হাসে। যেন অনিচ্ছায় খুশির পাপড়ি খসে পড়ে। শোভন ধরতে যায়।
বিভাদের বাংলোবাড়ির পেছনে কত পাখি। পালক খসে পড়ে। ধরতে গেলে চা-বাগানের ঢালে আছড়ে পড়ে শোভন। বিভা দেখতে পায় না। আভা কেবল লুকাছুপি খেলতে খেলতে হঠাৎ সড়সড় ছেঁচড়ে পড়া শব্দে খানিক ভয় পেয়ে যায়। বান্টিকে বলে, ‘চলো বান্টি, মা আমাকে খুঁজছে। মনে হয় বাগানে পাগলা হাতি ঢুকে পড়েছে!’

৩.
দুই সপ্তাহ পর হঠাৎ করে পক্ষী নিবাসের সামনে রিয়াদ ভাইকে দেখে খুশি ও ভয় দুটোই পেয়ে বসে শোভন আহমেদকে।
‘চলো, শুনলাম অই দিকে নাকি নতুন পাখি এসেছে। দেখে আসি।’
‘কোন দিকে?’—জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে যায় শোভন। শুধু রিয়াদ ভাইয়ের পায়ের ছাপ ধরে এগিয়ে যায়। কত পাতা পড়েছে। একটু ঠান্ডা বাতাস। চাদরটা আনলেও হতো। সামনে রিয়াদ ভাই অনবরত সিগারেট ফুঁকছে। সাদা ধোঁয়া বাতাসে চলে আসছে পেছনে। যেন সাদা সাপ। সেই সাপের কুণ্ডলী ভেদ করে শুকিয়ে যাওয়া জলামাটির ওপর হালকা ঢুপ ঢুপ শব্দে অনুসরণ করে শোভন।
‘ওঠো।’
একটা ছোট নৌকায় বসে পড়ে শোভন। পানি কমে যাওয়ায় নৌকার লগি ঠেলে সচল জলে আসার পর একটা সিগারেট বাড়িয়ে দেয় রিয়াদ ভাই। আবারও কিছু বলতে গিয়ে জিব অসাড়। রিয়াদ ভাই একমনে আওড়ায়, ‘জেলে গাঙে মাছ ধরিতে যায়/ পদ্মা নদীর উজান বাঁকে ছোট্ট ডিঙি নায়/ পদ্মা নদীর কটাল ভারী, চাক্কুতে যায় কাটা/ তারি পরে জেলের তরি করে উজান-ভাটা।’
জেলে গাঙে মাছ ধরিতে যায়। জসীমউদ্দীন। রিয়াদ ভাইয়ের পছন্দ অবশ্য জীবনানন্দ। বলত, দ্যাখো বাংলার কাদাজলপাখি সব থাকলেও দুজনের কবিতা কত আলাদা।
কিছু বলার চেষ্টা করে আবারও ব্যর্থ হয় শোভন। কারণ আবারও গম্ভীর হয়ে গেছে রিয়াদ ভাই। যেমন, রায় পড়ার আগে খানিক বিরতি নেয় বিচারক। শুধু বইঠার মৃদু শব্দ। আর কোনো শব্দ নেই। সত্যিই তো, নৈঃশব্দ্যে কত ডামাডোল বাজে! জলার এক মানুষ সমান পানিতে খানিকটা এগিয়ে গাছগাছালি ছায়ায় দাঁড় বাওয়া বন্ধ করে রিয়াদ।
‘এই নাও। এটার ডানাগুলো ছিঁড়ে পানিতে বিসর্জন দাও।’
অবাক হয়ে দেখে শোভন, ‘এটা কী?’
চিৎকার করে ওঠে শান্ত স্বভাবের রিয়াদ ভাই, ‘এটা হলো শ্যামা পাখির কুশপুত্তলিকা।’
কথা বাড়ায় না শোভন। প্রতীকী পাখির পালক ছিঁড়তে গিয়ে তার দুচোখ থেকে ঝরঝর করে পানি ঝরে। দম আটকানো স্বরে বলার চেষ্টা করে, ‘রিয়াদ ভাই। আমি খুবই স্যরি...।’
থামিয়ে দেয় রিয়াদ মাহমুদ, ‘না, কোনো কথা না। শ্যামা খুব দজ্জাল পাখি, অন্য পাখিদের ঠুকরে মারে।’
রাগে কাঁপতে কাঁপতে রিয়াদ ডিকটেট করে, ‘হ্যাঁ, এই তো ওটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে অসুরের মতো জলসমাধি করো।’

চোখ ঝাপসা হয়ে যায় শোভনের। সব ছিঁড়েখুঁড়ে জলে ভাসিয়ে দিয়েছে সে। যেন পালকের ছিন্নভিন্ন শাড়ি।
বুঝতে পারে নৌকা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে ডাঙায় উঠে গাছগাছালির ভেতর দিয়ে চলে যাচ্ছে রিয়াদ ভাই। জলার উল্টো দিকে জাহানারা ভাবি। যেন সব দেখছেন। যিনি বলতেন, খুব ভালো জুটি হয়েছ তোমরা। তোমাদের অনেক মিল। যাক শেষমেশ একটা বন্ধু তো জুটল ওর।
সেই রিয়াদ ভাই, জাহানারা ভাবি মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ পর নৌকার দাঁড় বাওয়ার চেষ্টা করে শোভন। মনে মনে বলে, ‘তরি সেই সাগরে ভাসায় যাহার কূল সে নাহি জানে...’।

৪.
আকাশে তখন পড়ন্ত বেলার বিভা। কী যে শূন্যতা। রিক্ত। রিয়াদ মাহমুদ গাছগাছালির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে একটা মেহগনি গাছ জড়িয়ে ধরে ডুকরে ওঠে, ‘মা রে বিভা; আমাকে তুই মাফ করে দে।’
দূরে বাংলোবাড়ির পেছনে বান্টির ভুকভুক শোনা যায়। হয়তো রিয়াদের উপস্থিতি টের পেয়েছে। নয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা বিভা মাহমুদের একমনে ছায়াবৃক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকা দেখে মনোযোগ অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টা করছে বোবা প্রাণীটা।
মেয়ের সামনাসামনি হয়, অত সাহস নেই রিয়াদের। তবু বলে, ‘কী দেখিস মা?’
ফ্যালফ্যাল করে তাকায় বিভা। হঠাৎ বলে, ‘বাবা, তুমি রিয়াকে বিয়ে করো।’
রিয়াদ মাহমুদ জানে সবাইকে ফাঁকি দিলেও এই মেয়েটাকে মিথ্যা বলা অসম্ভব। এমন পাখির প্রাণ! এমন বোবা বৃক্ষ!
মেহগনি গাছটায় মাথা কুটে চিৎকার করে সে, ‘কী যে দোটানা মা! যতই বলিস; কিন্তু আমি তো জানি, শোভনকে তুই ভালোবাসিস না।’
বিভা শান্ত। অটল।
বলে, ‘ভেবো না বাবা, আমি তো বনপরি; বৃক্ষমেয়ে তোমার। একটুও কাঁদব না।’