আমাদের এই শহর ও কিছু রাতজাগা পাখি

অলংকরণ: লেখক
অলংকরণ: লেখক

হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় পুরো এলাকাটা অন্ধকার হয়ে গেল। যেমন–তেমন অন্ধকার নয়। শিল্পীরা যাকে বলেন ‘Mars Black’। মার্স ব্ল্যাক হওয়ার কয়েকটি কারণের মধ্যে একটি হলো আকাশে চন্দ্রের অনুপস্থিতি। দ্বিতীয়ত, এলাকায় ধনী মানুষের অভাব শুধু নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণিও তেমন নেই। এর সোজা অর্থ—ইনস্ট্যান্ট পাওয়ার সাপ্লাই বা জেনারেটর কেনার সামর্থ্য এদের নেই। কিছু কিছু বড় দোকানে অবশ্য প্রকাণ্ড শব্দ বাজিয়ে চলছে জেনারেটর। যেমন অসীম সাহার মা কালী ডেকোরেটর অ্যান্ড কোং দোকানে আলোর খেলা চলছে নীল মরিচবাতির। মনে হচ্ছে এটা পৃথিবী নয়। অন্য কোথাও অন্য কোনখানে। পাশের অনেকটা জায়গাজুড়ে সে আলো ছড়িয়েছে। কিছুটা নীলাভ ছটা এসে পড়েছে জামিলের স্যঁাতসেঁতে বাড়ির জানালার গ্রিলে। জামিল ইদানীং অন্ধকারেই বেশির ভাগ সময় পড়ে থাকে। শুধু রাতে নয়। দিনের আলোও সে সহ্য করতে পারে না। এসব শুরু হওয়ার প্রথম কদিন মানুষ ভাবত, তার বুঝি আলোক স্পর্শকাতরতা হচ্ছে। অনেকে চোখের ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিল। কিন্তু আসল ব্যাপারটা কারও যখন বুঝতে বাকি রইল না, তখন সবাই বেশ উদাসীনভাবে জামিলের পাশে ঘোরাঘুরি করতে লাগল, যেন জামিল মৃত কোনো সংগীতশিল্পীর গান ফিতার ক্যাসেটে সুরে সুরে প্রকাশ করছে তার অব্যক্ত বেদনা, যা নিয়ে প্রশ্ন করার আর অবকাশ নেই।

অলংকরণ: লেখক
অলংকরণ: লেখক

সে সময়টা জামিলেরও দম আটকে আসত। সেই যে উত্তাল পদ্মায় আষাঢ়ের মাঝামাঝি। প্রতিদিন খবরের কাগজের শিরোনাম হচ্ছিল তখন লঞ্চডুবির মৃত মানুষেরা। সে ফিরছিল শ্বশুরবাড়ি বরিশাল থেকে। সে এক অদ্ভুত ফেরা। জীবন কি এক বিষধর রূপ নিল তার কাছে। গভীর রাতে যখন তুমুল ঝড়–বৃষ্টি শুরু হলো, সুরভী-২ লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে ছিল সে একা। মাথার ভেতরে খেলা করছিল অসংখ্য সংলাপ-আর্তনাদ-চিত্কার। ভীষণ সে চিত্কারধ্বনি, বিস্মিত–ব্যথিত সে কান্নার ভাষা খেলা করছে জামিলের মাথার ভেতরে। তারা খেলা করছে আজ এই আত্মহননের আকণ্ঠ তৃষ্ণায় জড়িত ঘোরলাগা নেশায়।
‘নেশা’? ডেকের ওপর ঝুঁকে অতল অকূল নদীর সেই স্রোতে তলিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছায় যখন সে মত্ত, ‘নেশা’ শব্দটি তাকে থমকে দিল। দমকা বাতাসে বৃষ্টির ছাট যেন তাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে। তবু মাথার ভেতরের খেলা থামবে না। তারা দুর্দমনীয় প্রতাপে জামিলের মস্তিষ্কে বসবাসরত। ‘বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে’ জামিল থমকে তাকাল উত্তাল অথবা মাতাল নদীর দিকে। সেই সে রাতের জামিলের মতোই নদী আজ ঘোর মাতাল। শুধু পৃথিবী নয়, সে যেন নস্যাৎ করে দেবে সৃষ্টির প্রথম ক্ষণ। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে মহাবিশ্ব। মহাকাল যেন তলিয়ে যাবে নদীগর্ভে চিরদিনের মতো।
ছাত্রজীবন থেকে শুরু হয়েছিল তার নেশার সঙ্গে সখ্য। ইতিহাসের ছাত্র জামিলের সখ্য হয়েছিল রাজনীতির কালো ছায়ার সঙ্গেও। ক্লাস শেষে মিথ্যা দেশোদ্ধারের তর্কবিতর্কে মেতে উঠত তারা বিদ্রোহী কবির সমাধিকে সাক্ষী রেখে। সন্ধ্যাকাশ আরক্ত হলে জামিলদের চোখেও তার প্রতিফলন পাওয়া যেত। তারপর চন্দ্রালোকিত আকাশ যখন নেশায় বুঁদ হতো, জামিলরাও তা–ই। একদিন অদিতি এসে জামিলের গালে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে বলেছিল, ‘পদ্মা নদী সমান মদ পেলেও তোমাদের তৃষ্ণা মিটবে না।’
আর কোনো দিন ইউনিভার্সিটিতে দেখা যায়নি অদিতিকে। জামিলও হাহাকার করেনি। অনেক হয়েছে প্রেমের পরাধীনতা। এবার নিজের মতো, ঝোড়ো হাওয়ার মতোই বাঁচবে সে।
হয়তো বাঁচত। অথবা নানান নীতির কারসাজিতে মৃতদেহ হয়ে মিশে যেত কোনো পরিত্যক্ত কবরখানায়। ব্যাকটেরিয়াদের ভূরিভোজ হতো বহুদিনের। কিন্তু সব ওলট–পালট হয়ে গেল, বাবা যখন আলেয়াকে জোর করে ওর হাতে তুলে দিলেন।
জামিল বলল, ‘মেয়েটা কষ্ট পাবে বাজান।’ 
‘পাইলে পাউক। আমি সুখে থাকমু। তুইও।’
জামিল সুরভী-২ লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে ছিল স্থির। উত্তাল ঢেউ, বজ্রপাত, মুষল বৃষ্টি—কিছুই তাকে টলাতে পারল না। সুখীও করল না। মাথার ভেতরে আলেয়ার শেষ আর্তনাদ আর তার কন্যার ক্রন্দনরোল আরও শব্দ করে খেলা শুরু করেছে। সেই সে রাতের বিশেষ পার্টিতে জামিলের পেটে সত্যি ঢুকে পড়েছিল যেন পুরো পদ্মা নদী। উত্তাল হয়ে মাঝরাতে বাড়ি ফিরেছিল সে। এলিফ্যান্ট রোডে তখন পাঁচতলার ওপরে তার ছোট্ট ফ্ল্যাট। পাশেই দলের উপহারস্বরূপ তার রমরমা ফটোর দোকান। অদিতির পর আলেয়া আর সংসার আরও বড় পরাধীনতা। দলের হাত ধরে সে সূর্যকে স্পর্শ করতে চায়। টালমাটাল জামিল দোকানের সামনে থেকেই শুনছিল তার সদ্যোজাত কন্যার চিকন সুরে কান্নার শব্দ। কপাল কুঁচকালো সে। আলেয়া বড় অগোছাল মেয়ে। বাচ্চার ব্যবহৃত সারা দিনের কাঁথাগুলো সে জমিয়ে রেখে ভোরবেলা ধোয়। বিচ্ছিরি গন্ধে জামিলের বমি আসে। আজ সে রাস্তায় দাঁড়িয়েই বমি করল। তারপর পালকের মতো হালকা চালে উঠে গেল পাঁচতলার ফ্ল্যাটে। বাচ্চাটা এত জোরে কেঁদে কেঁদে কি জানান দিতে চাইছে? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তার অস্তিত্বের সংকট? জামিল কান্নার তীব্রতায় সামগ্রিক আক্রান্ত হলো। যেমন সে আক্রান্ত আলেয়ার প্রতি ভালোবাসাহীনতায়। আজ রাতে সে এর একটা চিরস্থায়ী সমাধানের দিকে যাবে।
গভীর রাতের উত্তাল পদ্মার অগুনতি মুখ হাঁ করে আছে শিকারের নেশায়। জামিলের রক্ত–মাংসের শরীরের ঘ্রাণে সে আরও উন্মত্ত আজ। পদ্মায় ঝাঁপ দেওয়ার আগে একবার লঞ্চের বড় হলঘরের মেঝেতে ঘুমন্ত মানুষগুলোর দিকে পেছন ফিরে চাইল জামিল। কত শত মুখ-ছোট বড় কত জীবনের সমাহার। মানুষগুলোর সমস্ত পাপ দোষ–ত্রুটি যেন ধুয়েমুছে গেছে ঘুমের আচ্ছাদনে। আজ বরিশাল সদরে বাদ জোহর তার মেয়ে আর আলেয়ার দাফনের আগে সাদা কাফনে যেমন সে দেখেছিল দুজনকে, তাদের মতো যেন এরাও মৃত। এরাও নিষ্পাপ।
এলিফেন্ট রোডের বাড়ি ছেড়ে এসেছিল জামিল এক কাপড়েই। কারণ, সেই সে রাতে কিছু রাতজাগা পাখি আলোকে পাঁচতলার বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়তে দেখেছিল বিছানায় শিশুকন্যার মৃত মুখ দেখার পরপরই। এখন আড়জত পাড়ায় তার নির্জন বাড়ি। দলও ছেড়েছিল স্বেচ্ছায়।
নীলাভ আলো এক নীল সমুদ্রের রূপ ধারণ করেছে। বহুদিন পর জামিল চোখ মেলে কিছু দেখতে চাইল। আর কিছু নয়। কিছু স্বপ্নময় আলো তার জানালার গ্রিলে। সে জীবিত না মৃত, সন্দেহ জাগছিল। হঠাৎ একটা দ্রুতগামী ইঁদুর তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সমাধান দিয়ে গেল। চমকে উঠে জামিল বুঝল হৃদ্যন্ত্র সচল। দূষিত রক্ত আর বিশুদ্ধ রক্তের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলছে তার অন্তর্গত দেহের শিরা–উপশিরায়।
গত চার মাসে সে প্রায় নিঃশব্দতায় যাপন করেছে জীবন। আজ নীল আলো তার মস্তিষ্কে কী এক ভীষণ খেলায় মেতে ওঠার আগ্রহ প্রকাশ করছে। এ খেলায় জিতলে সে হবে মৃত আলেয়া অথবা সুরভী–২-এর ঘুমন্ত মানুষগুলোর মতোই নিথর।
অনেকক্ষণ ধরে চলে জেনারেটরের সঞ্চিত শক্তি বোধ হয় নিঃশেষ। জামিল আলোর দিকে ধাবিত হতেই দুম করে নিভে গেল নীল মরিচবাতি। জেনারেটর বন্ধ। নিশ্চুপ–নিস্তব্ধ চারদিক।
জানালার গ্রিল দুই হাতে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে প্রচণ্ড এক আর্তচিত্কার দিল জামিল। পৃথিবীর বুকচিরে তা পৌঁছে গিয়েছিল জীবনের অপর প্রান্তে। আমাদের এই পুরো শহর কেঁপে উঠল। সমস্ত নদী উন্মত্ত হলো। শুধু একটি অতি শান্ত শিশু-কণ্ঠস্বর দূর থেকে বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি বাবা।’