পালকের বালিশ

ওর হানিমুনের পুরো সময়টা ছিল শীত আর উষ্ণতায় থরথর। উজ্জ্বল চুলের দেবদূত-প্রতিম মুখচোরা যুবতী। শৈশব থেকে পুষে রাখা ওর বউ হওয়ার স্বপ্নটা স্বামীর রুক্ষ্ম স্বভাবে কিছুটা ঠান্ডা মেরে গেছে। তবু সে তাকে ভারি ভালোবাসে। মাঝেমধ্যে ওর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা প্রস্রবণ নেমে যায়—যখন রাত্রিবেলা ওরা একত্রে রাস্তা ধরে বাড়ি ফেরে, জর্ডানের লম্বা নজরকাড়া শরীরটা ও চোরা-চাহনিতে দেখে—খেয়াল হয়, প্রায় এক ঘণ্টা হলো সে একটা কথাও বলেনি। তার তরফে সেও গভীরভাবে প্রেমাসক্ত, কিন্তু বেখেয়ালে প্রকাশ পেতে দেয় না।ওদের বিয়ে হয়েছে এপ্রিলে—তিন মাস হয়ে গেল। এই সময়টা ওরা পরম সুখে পার করেছে। ওর কোমলতার জন্য কাঙাল মন প্রেমের এই উত্তুঙ্গ আকাশের কিছুটা ছেড়ে দিত নিশ্চয়ই, যদি সেই অমূল্য কোমলতার জন্য তার হুঁশিয়ারি একটু ছাড় পেত। কিন্তু ওর স্বামীর নির্বিকার স্বভাব ওকে সব সময় নিবৃত্ত করে রাখে।ও যে বাড়িটায় থাকে, সেই বাড়িটাও ওর দ্বিধা-থরথর ভাবের জন্য কিছু কম দায়ী নয়। নিথর সাদাটে উঠান, দেয়ালের নকশা, উঁচু থাম, মর্মরের মূর্তি—সব মিলিয়ে এক মন্ত্রমুগ্ধ প্রাসাদের শীত-শীত আভাস। অন্দরে পলেস্তারার ঠান্ডা আঁচ, সম্পূর্ণ নিরাভরণ দেয়াল জানান দেয় উসখুসে ঠান্ডা অনুভূতি। এক ঘর থেকে কেউ অন্য ঘরে গেলে পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনি হয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে। যেন পরিত্যক্ত কিছু নিজের অনুরণনকে ছুঁয়ে গেল।এই আশ্চর্য ভালোবাসার নীড়ে এলিসিয়ার পুরো হেমন্তকাল কাটল। সে স্থির করে ফেলেছে, তার পুরোনো স্বপ্নের ওপর একটা পর্দা টেনে দেবে, এই বৈরী বাড়িটায় বাস করবে রূপকথার ঘুমন্ত রাজকন্যার মতো আর সন্ধ্যায় ওর স্বামী ফেরার আগ পর্যন্ত কোনো কিছু নিয়ে একদম ভাববে না।এটা মোটেও আশ্চর্য নয়, সে শুকিয়ে যাচ্ছিল। হালকা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো হয়েছিল ওর, অলক্ষ্যে দিনকে দিন সেটা বাড়ছিল। এলিসিয়ার ভগ্নস্বাস্থ্য আর কখনোই ভালো হয়নি। একদিন সে স্বামীর বাহুতে ভর রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে বাগান পর্যন্ত গেল। অনীহার সঙ্গে ও তাকাচ্ছিল চারপাশে। হঠাৎ জর্ডান খুব মমতা নিয়ে হাত বুলিয়ে দিল ওর মাথায়। এলিসিয়া সঙ্গে সঙ্গে ওর স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। অনেকক্ষণ ধরে সে কাঁদল, নিজের ওপর চেপে থাকা ভয়টাকে ও চোখের জলে ধুয়ে ফেলবে। জর্ডান ভালোবেসে ওকে একটু ছুঁয়ে দিলেই হাউমাউ করে কাঁদছিল সে। তারপর আস্তে আস্তে ওর কান্নার দমক কমে এল। নিঃশব্দে ঘাড়ের মধ্যে মাথা গুঁজে সে দাঁড়িয়ে রইল অনড়, অনেকক্ষণ।

এই দিনটাই ছিল শেষ দিন এলিসিয়া যখন উঠে দাঁড়ানোর মতো সুস্থ। পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন ও পুরোপুরি নিস্তেজ। জর্ডানের ডাক্তার এসে ওকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল। ডাক্তারের পরামর্শ—শান্ত হয়ে পূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে।

‘আমি জানি না’ রাস্তায় বেরিয়ে জর্ডানকে বলল ডাক্তার, ‘উনি ভয়ানক দুর্বলতায় ভুগছেন। খুবই দুর্বোধ্য ব্যাপার, তার বমি হয়নি, কিছু হয়নি... কালকেও ঘুম ভাঙার পর যদি আজকের অবস্থা দেখেন, আমাকে সঙ্গে সঙ্গে খবর দেবেন।’

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর এলিসিয়ার অবস্থার আরও অবনতি হলো। আবার পরীক্ষা করা হলো। ডাক্তার মত দিল, অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে ওর রক্তস্বল্পতা হচ্ছে, এটা পুরোপুরি ব্যাখ্যার অতীত। এলিসিয়ার ম্রিয়মাণ থাকার পর্যায়টা আর নেই, এখন সে দৃশ্যত মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছিল। ওর শোবার ঘরে অহোরাত্র আলো জ্বলছে, সেই সঙ্গে পিনপতন নীরবতা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছিল টুঁ-শব্দটি ছাড়া। এলিসিয়া তন্দ্রাচ্ছন্ন। জর্ডান এখন প্রায় ড্রয়িংরুমেই থাকছে, সেখানে এক মুহূর্তের জন্য আলো নিভছে না। সে ক্লান্তিহীনভাবে একটানা ঘরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পায়চারি করছিল। তার চলাফেলা প্রায় শুষে নিচ্ছিল কার্পেট। মাঝেমধ্যে শোবার ঘরে ঢুকে সে বিছানার চারপাশে শব্দহীন ঘুরছিল, ঘরের প্রান্তে ঠেকে প্রতিবারই সে একবার নিজের স্ত্রীকে দেখছিল।

এরপর হঠাৎ একদিন এলিসিয়ার হ্যালুসিনেশন শুরু হলো। ভাসা-ভাসা কিছু দৃশ্য দেখত। প্রথম প্রথম মনে হতো সে বোধ হয় হাওয়ায় ভাসছে, তারপর মেঝেতে নেমে এল। ওর চোখ অপরিমিতভাবে বড় হয়ে গেছে, বস্ফািরিত চোখে সে বিছানার দুই পাশে কার্পেটের দিকে তাকিয়ে থাকত। তারপর এক রাতে ওর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে গেল এক জায়গায়। সে ধীরে ধীরে মুখ হাঁ করল আর্তনাদ করবে বলে, ওর নাকে-ঠোঁটে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল।

‘জর্ডান, জর্ডান!’ সে চেঁচিয়ে উঠল। আতঙ্কে প্রায় জমে গেছে ও, তখনো একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে কার্পেটের দিকে। তার দিকে ফিরে তাকাল সে—আরও একবার। দীর্ঘ সময় ধরে হতচেতন থাকার পর সে লুপ্ত চেতনা পুনরুদ্ধার করল। একটুখানি হাসল। স্বামীর হাতখানা নিয়ে পরম মমতায় থরথর কম্পিত হাতে প্রায় আধঘণ্টা ধরে রাখল।

তার যেসব হ্যালুসিনেশন হতো, তার মধ্যে একটা দৃশ্য ঘুরেফিরে আসত। সে দেখত, একটি নরাকার জীব ওর স্বামীর আঙুল ধরে কার্পেটে ঝুলে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে।

দলবেঁধে ডাক্তাররা এল আবারও। কিন্তু তাতে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হলো না। তারা দেখল, চোখের সামনে একটি জীবন ধীরে ধীরে নিভে আসছে, প্রতিটি দিন, প্রতি ঘণ্টায় সে জীবন রক্ত হয়ে ঝরে যাচ্ছে, অথচ কেন এমন হচ্ছে কেউ তার বিন্দু-বিসর্গ জানে না। শেষ যেবার ওকে পরীক্ষা করা হলো, ওর নাড়ি মাপল ডাক্তাররা, এলিসিয়া তখন অচেতন; ওর নিষ্প্রাণ কবজি একজন একজন ধরছিল। দীর্ঘসময় ধরে তারা ওকে নিঃশব্দে দেখল, তারপর চলে এল ডাইনিংরুমে।

‘তাজ্জব ব্যাপার...’ হতোদ্যম প্রধান চিকিৎসক নিজের কাঁধ শ্রাগ করল। ‘একটা বুদ্ধির অগম্য ব্যাপার। আমাদের করার আছে অতি সামান্যই...।’

‘সেটাই আমার শেষ ভরসা।’ প্রায় গোঙানির মতো বলল জর্ডান। হতবুদ্ধের মতো টেবিলের চারপাশে ঘুরছে সে।

এলিসিয়ার জীবন রক্তাল্পতার প্রকোপে একটু একটু করে মুছে যাচ্ছিল। রোগের প্রকোপটা বাড়ত বিশেষত সন্ধ্যার কয়েক ঘণ্টা, সূর্যের আলো ফোটার পর কিছুটা দমে আসত। দিনের বেলা ওর অসুখটা কখনোই খুব পেখম মেলত না, কিন্তু প্রতি ভোরে সে জেগে উঠত মৃতের মতো ফ্যাকাশে, প্রায় মূর্ছা যাওয়ার দশার মধ্যে। কেবল রাতেই মনে হতো, নতুন রক্তের স্রোতে ওর জীবন নালা বেয়ে ভেসে যাচ্ছে। প্রতিদিন ও যখন জেগে উঠত, ওর মনে হতো বিছানার মধ্যে প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে, ওর গায়ের ওপর মিলিয়ন পাউন্ডের ভার চাপা দিয়ে আছে। রোগের ফিরতি আক্রমণের তিন দিন পর সে আবার তার বিছানা ছাড়ল। ও কোনোমতে মাথা নাড়াতে পারত। তার বিছানা কেউ স্পর্শ করুক সে চাইত না, কেউ বিছানার চাদর বদলে দিক এটাও সহ্য করত না। তার গোধূলিকালীন আতঙ্ক বাড়তে বাড়তে কতগুলো দানবের রূপ পেয়েছে। দানবগুলো বিছানার চারপাশে আঁচড়াত, আর প্রাণপণে চেষ্টা করত বিছানা বেয়ে উঠে আসতে।

এরপর সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলল। অন্তিম দুই দিন সে একটানা চাপা স্বরে বিড়বিড় করতে থাকল। বাতিগুলো শোবার ঘরে, ড্রয়িংরুমে আলো ছড়াচ্ছিল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মতো। বাড়িতে মৃত্যুর মতো নৈঃশব্দের মধ্যে একমাত্র শব্দ হচ্ছিল শোবার ঘরের একঘেয়ে ডিলিরিয়ামের শব্দ। আর জর্ডানের অন্তহীন পায়চারির চাপা প্রতিধ্বনি।

শেষতক এলিসিয়ার মৃত্যু হলো। এখন শূন্য হয়ে যাওয়া এলিসিয়ার বিছানা ঝাড়পোঁছ করতে এল পরিচারিকা। সে এক মুহূর্ত মহাবিস্ময়ে বালিশটার দিকে তাকিয়ে থাকল।

‘স্যার!’ চাপা গলায় জর্ডানকে ডাক দিল সে। ‘বালিশে পুরোনো দাগ, রক্তের মতো লাগছে।’

জর্ডান ছুটে এসে বালিশের ওপর ঝুঁকে পড়ল। সত্যিই, বালিশের ওয়াড়ে এলিসিয়ার মাথায় দুই পাশের ফাঁকা জায়গায় ছোট্ট দুটো কালো দাগ বসে গেছে।

‘এগুলো তো মনে হচ্ছে সুই দিয়ে ফুটো করা হয়েছে।’ হতবিহ্বলভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর বিড়বিড় করল পরিচারিকা।

‘দেখি, আলোর কাছে নিয়ে ধরো তো।’ জর্ডান পরিচারিকাকে বলল।

পরিচারিকা বালিশটা তুলল। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ধপাস করে ফেলে দিল। তারপর সোজা তাকিয়ে থাকল কাঁপা-কাঁপা ধূসর দৃষ্টিতে। জর্ডানের অদ্ভুতভাবে মনে হচ্ছিল, ওর ঘাড়ের ওপর দিয়ে নেমে যাচ্ছে চুল।

‘কী হলো?’ ভগ্ন স্বরে বিড়বিড় করে উঠল সে।

‘এটা খুবই ভারী।’ প্রায় ফিসফিস করল পরিচারিকা। তখনো সে থরথর করে কাঁপছে।

জর্ডান এগিয়ে এসে বালিশটা তুলল। অস্বাভাবিক রকমের ভারী। শোবার ঘর থেকে সে বালিশটা বাইরে নিয়ে এল। ডাইনিংরুমে এসে টেবিলের ওপর রেখে সে বালিশের ওয়াড় ছিঁড়ে ফেলল একটানে। তারপর বালিশের খোলটা ফালা-ফালা করে ছিঁড়ল। আলগা পালকগুলো হাওয়ায় ভাসছে। পরিচারিকার মুখটা হাঁ হয়ে গেছে। প্রচণ্ড আতঙ্কে সে আর্তনাদ করে উঠল, দুই হাত দিয়ে ঢেকে ফেলল মুখ: বালিশের ওয়াড়ের নিচে পালকগুলোর মধ্যে জীবটা, তার চুলবুলে পাগুলো নাড়ছিল—একটি অদ্ভুত বিকৃত জীব, দেখতে জ্যান্ত আঠালো বলের মতো। ফুলে এমন ঢোল হয়েছে জীবটা যে তার মুখ ঠাওর করা মুশকিল।

এলিসিয়া বিছানা নেওয়ার পর থেকে রাতের পর রাত এই বিভীষিকাটি সন্তর্পণে মেয়েটার কপালের দুপাশে মুখ লাগিয়ে—আরও ভালো হয় যদি বলি শুঁড় লাগিয়ে—তার রক্ত খাচ্ছিল। ছিদ্রটা এমনভাবে করা হয়েছিল প্রায় চোখেই পড়ে না। বালিশটার রোজ রোজ হূষ্টপুষ্ট হওয়াটা প্রথম দিকে নিশ্চয়ই বাধা পাচ্ছিল, কিন্তু মেয়েটা যখন নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলল, তখন রক্ত চোষার কাজটা ঝিম ধরানোর মতো চলতে থাকল। পাঁচ দিন পাঁচ রাত ধরে এই রাক্ষসটা চুষে চুষে এলিসিয়ার জীবনটা শেষ করে ফেলেছে।

এসব পরজীবীগুলো পালকের মধ্যে বাঁচে। অভ্যস্ত পরিবেশে একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় অতি ক্ষুদ্র এই জীবগুলো বেহিসাবি বাড়তে থাকে। মানুষের রক্ত এদের বিশেষ প্রিয় বলেই মনে হয় এবং পালকের বালিশের মধ্যে এদের দেখা পাওয়া একেবারে বিরল ব্যাপার নয়।

হোরাশিও কিরোগা

জন্ম ১৮৭৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর, উরুগুয়ের সলটো শহরে। তিনি একাধারে নাট্যকার, কবি ও ছোটগল্পকার। তাঁর বেশির ভাগ গল্প জঙ্গলের পটভূমিতে লেখা। লেখালেখির মাধ্যমে তিনি মূলত ফুটিয়ে তুলেছেন বেঁচে থাকার সুতীব্র লড়াই। মানসিক অসুস্থতা বা হ্যালুসিনেশনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভা অনবদ্য। কিরোগার সাহিত্যকর্ম দিয়ে প্রভাবিত হয়েছেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এবং হোলিও কোর্তাসারের মতো বিশ্ববিখ্যাত লেখক। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে আছে: দি ফিদার পিলো (১৯০৭); স্টোরিস অব লাভ, ম্যাডনেস, অ্যান্ড ডেথ (১৯১৭); জাঙ্গল টেলস (১৯১৮); আনাকোন্ডা (১৯২১); দি ডিক্যাপিটেটেড চিকেন অ্যান্ড আদার স্টোরিস (১৯২৫)।

১৯৩৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়।