যুদ্ধের প্রতি ঘৃণা

এ মাসেই পেরিয়ে গেল হিরোশিমা-নাগাসাকি দিবস। ১৯৪৫ সালে বোমা বিস্ফোরণের সেই বীভৎস স্মৃতি এখনো বয়ে বেড়ান আক্রান্ত জাপানিরা। শোনা যাক তাদের গল্প...
নাগাসাকির পিস মেমোরিয়াল পার্কের এই অনুপম ভাস্কর্যের মধ্যে আছে শান্তির বার্তা
নাগাসাকির পিস মেমোরিয়াল পার্কের এই অনুপম ভাস্কর্যের মধ্যে আছে শান্তির বার্তা

২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে একটা ফেলোশিপ নিয়ে জাপান গিয়েছিলাম দুই মাসের জন্য। নভেম্বরে কিয়ুশু বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়া সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক রেইকো ওগাওয়া দাওয়াত পাঠালেন ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়ন’ নিয়ে একটা বক্তব্য দেওয়ার জন্য। আমার সতীর্থ, ফিলিপাইনের অ্যাতেনিও দ্য দাভাও বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক রেভারেন্ড আলবার্ট আলেহো সঙ্গী হলেন। যাওয়ার আগে অধ্যাপক রেইকোকে অনুরোধ জানালাম, এক দিনের জন্য হলেও নাগাসাকি যেতে চাই। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, কিয়ুশুর প্রধান শহর ফুকোওকা থেকে নাগাসাকির সড়কপথে দুই ঘণ্টার দূরত্ব।
এশিয়া সেন্টারে আমাদের সেমিনার ছিল ১৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে। ৪০ জনের মতো ছাত্র-শিক্ষক জড়ো হয়েছিলেন। জাপানের জন্য এটাই একটা বড় জমায়েত। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশিও আছেন। তাঁরা এর আগে জাপানে পড়াশোনা করে এখন ফুকোওকা শহরেই থিতু হয়েছেন।
পরদিন আলবার্ট আর আমি সকালের বাসে নাগাসাকি রওনা হলাম। রেইকো যথারীতি আমাদের সাথি হলেন। পৌঁছে গেলাম দুই ঘণ্টার মধ্যেই। প্রথমেই গেলাম একটা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের অফিসে। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মী মিচিকো ফুকুদা জাপানি ভাষায় লেখা একটা বই দিলেন। বাংলায় শিরোনাম, নাগাসাকিতে স্বাগতম। ভেতরে শিশুদের আঁকা অনেক ছবি। নাগাসাকি ভ্রমণের পুরো সময়টা মিচিকো আমাদের সঙ্গে ছিলেন।

এই সেই গির্জা যেখানে বোমা ফেলা হয়েছিল। পরে গির্জাটি আবার তৈরি করা হয়
এই সেই গির্জা যেখানে বোমা ফেলা হয়েছিল। পরে গির্জাটি আবার তৈরি করা হয়

দুপুরে খাওয়ার পর শুরু হলো আসল কাজ, অর্থাৎ যে জন্য নাগাসাকি আসা। প্রথমেই গেলাম পিস মেমোরিয়াল পার্ক দেখতে। যে জায়গাটিতে ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট মার্কিন বিমানবাহিনীর একটা বিমান থেকে ‘ফ্যাটম্যান’ নামের পরমাণু বোমাটি ফেলা হয়েছিল, ঠিক সেখানেই তৈরি করা হয়েছে এই পার্ক। একটা বিশাল চত্বরে বেদির ওপর স্থাপিত হয়েছে এক অনুপম ভাস্কর্য। সুঠামদেহী এক তরুণ এক হাত উঁচু করে বসে আছে। হয়তো সন্ধান করছে শান্তির। কাছাকাছি একটা গির্জা। বোমাটি পড়েছিল গির্জার ওপরেই। পরে নতুন করে এটা তৈরি করা হয়েছে। সব দেখেশুনে মনটা ভারী হয়ে গেল।
সন্ধ্যায় গেলাম শহরের মধ্যেই ছোট একটা অফিসে। একটা ঘরে বসে আছেন কয়েকজন প্রবীণ। সবার বয়স সত্তরের ওপরে। জাপানি ভাষায় তাঁদের বলা হয় ‘হিরাকুশা’। তাঁরা সবাই পরমাণু তেজস্ক্রিয়তার শিকার। এখনো বেঁচে আছেন। তাঁরা ‘পরমাণু অস্ত্র বিলোপের লক্ষ্যে বৈশ্বিক নাগরিক সম্মিলন’-এর নাগাসাকি কমিটির সদস্য। এই কমিটির মহাসচিব হলেন মাসাহিতো হিরোশি। নাগাসাকিতে যখন বোমা ফেলা হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল ১৫। তিনি আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। শুনলাম তাঁর করুণ এবং ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা। এই কথাগুলো তিনি হয়তো এর আগে অনেকবার বলেছেন, যাঁরা তাঁদের দেখতে এসেছিলেন। আমি ভাবছিলাম, কত ধৈর্য, সাহস এবং জীবনের প্রতি ভালোবাসা থাকলে এই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে এতগুলো বছর বেঁচে থাকা যায়। আমার মনে হলো একাত্তরের কথা, আমার দেশের স্বজন হারানো লাখ লাখ পরিবারের কথা।
১৯৪৫ সালের জুন-জুলাই মাসে জাপান যুদ্ধে পুরোপুরি পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল। আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতাটুকুই বাকি ছিল। কোনো প্রয়োজন ছিল না ওখানে পরমাণু বোমা ফেলার। ৬ আগস্ট বোমা ফেলা হলো হিরোশিমা শহরে। বোমার নাম ‘লিটল বয়’। ১৫ কিলোটন ওজনের এই বোমায় ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়েছিল। ৯ আগস্ট ‘ফ্যাটম্যান’ ফেলা হলো নাগাসাকিতে। ২১ কিলোটনের এই বোমায় ব্যবহার করা হয়েছিল প্লুটোনিয়াম। মার্কিনরা দুটো বোমারই কার্যকারিতা দেখতে চেয়েছিল।
মার্কিন পরিকল্পনায় নাগাসাকিতে বোমা ফেলার কথা ছিল না। নাগাসাকি তখন অখ্যাত একটা শহর। হাজার হাজার কোরিয়ান শ্রমিক সেখানে কাজ করতেন। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে আসল লক্ষ্যস্থল ঠাহর করতে না পেরে ফেরার পথে পাইলট নাগাসাকিতে বোমাটি ফেলে যান। বোমা ফেলার জায়গাটির আশপাশে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের লোক ছিল অনেক। ফলে স্থানীয়ভাবে এটা প্রচার পায় যে এটা আল্লাহর গজব (উইল অব গড)। জাপানে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের নেতা ড. নাগাই এ নিয়ে একটা বইও লিখেছেন। বইটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা নেই। নাগাসাকিতে পরমাণু অস্ত্রবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় অনেক পরে।

‘হিবাকুশ’দের একজন হলেন ফুখুরা। বোমাবর্ষণের সময় তাঁর বয়স ছিল ১২। তিনি জানালেন, কীভাবে হারিয়েছেন তাঁর প্রিয়জনদের। তিনি তাঁর চোখের সামনে মরতে দেখেছেন তাঁর বড় ভাই, ছোট ভাই, ছোট বোন, মা এবং কাকাকে, একজনের পর একজন, মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে।
বোমাটি যেখানে পড়ে, ফুখুরা ছিলেন তার এক মাইল দূরে। তিনি প্রচণ্ড একটা শব্দ শুনলেন। যে ঘরে তিনি ছিলেন, তা ভেঙে পড়ল তার ওপর। তিনি জ্ঞান হারালেন। যখন সংবিৎ ফিরে পেলেন, দেখলেন আশপাশে অনেকেই জখম হয়ে পড়ে আছে। বৃষ্টি পড়ছে, কালো রঙের বৃষ্টির জল। তিনি কাছাকাছি একটা কুয়োর ধারে গেলেন জল আনতে। দুজনকে জলপান করালেন, দুজনই ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। তৃতীয় ব্যক্তিকে জল খাওয়াতে গেলে তিনি নিষেধ করলেন, তিনি জল খাবেন না। তিনি বেঁচে গেলেন। জল বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল।
ফুখুরা পরদিন সকালে তাঁর বাড়িতে পৌঁছালেন, কোনোমতে হেঁটে হেঁটে। চারদিকে আগুন জ্বলছে, লাশ পড়ে আছে অগুনতি। দেখলেন, তাঁর মা ও দাদির ছিন্নভিন্ন লাশ। তাঁদের হাড়-মাংস একসঙ্গে করে দাহ করবেন এমন শক্তিও ছিল না তাঁর গায়ে। পরদিন কোনোমতে একটা গর্ত খুঁড়ে তাঁর মা এবং দাদিকে কবর দিলেন। শিশুকালেই তিনি তাঁর বাবাকে হারিয়েছিলেন।
মানুষেরা বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিল। আঠারোটা ‘আশ্রয়কেন্দ্র’ ঘুরে তিনি তাঁর ছোট ভাইকে পেলেন। তাঁর বোনের দেখা পেলেন, তাঁর মাথা রক্তাক্ত। ১৯ আগস্ট বোনটি মারা গেলেন। সেপ্টেম্বরের একদিন মারা গেলেন তাঁর কাকি। পরদিন তাঁর ছোট ভাই চলে গেল না ফেরার দেশে। ছোট আরেকটি বোন নিরুদ্দেশ ছিল এত দিন। এবার তাকেও তিনি পেলেন। মৃত। গায়ে হাত দিতেই খুলে খুলে উঠে এল হাড়। চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখলেন, লাশগুলো শুয়ে আছে পাহাড়ের দিকে মুখ করে। সবাই পালিয়ে পাহাড়ে উঠে বাঁচতে চেয়েছিল।
মাসাহিতো হিরোশি আমাকে একটা বই দিলেন। বইটির নাম জার্নি টু নাগাসাকি। ইংরেজিতে লেখা। তাঁদের কমিটি এটা ছেপেছে। এতে মাতসুয়ো আতসোইউকি-এর লেখা দিনপঞ্জির অংশবিশেষ আছে, যা লেখা হয়েছে কবিতার ছন্দে। নাগাসাকিতে বোমা পড়ার পরের দিনের বর্ণনাটি এ রকম:
১০ আগস্ট: দেখলাম আমার স্ত্রী রাস্তায় পড়ে আছে। ক্ষত-বিক্ষত। সঙ্গে আমাদের চার সন্তানের দুজনের লাশ। একজনের বয়স চার, অন্যজনের দুই। আমার স্ত্রী বলতে থাকল, ওরা কীভাবে মারা গেছে:
মায়ের কোলে শেষবারের মতো হেসেছিল সে
এই হাসিটা এইমাত্র যে শিখেছিল
এখন একাকী পড়ে আছে মাটিতে
শিশুটির চারদিকে ভনভন করছে মাছি
মৃত্যুর আগে সে একটা কিছু চিবোচ্ছিল
‘এটা তো খুব মজার, এটা নিশ্চয়ই আখ’।
মাসাহিতো জানালেন, মার্কিন কর্তৃপক্ষ এখনো তাঁদের কাছ থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে নিয়মিত বিরতিতে। ১৯৪৫ সাল থেকেই এটা চলে আসছে। এই রক্ত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে গবেষণা হয়। কিন্তু তাঁদের চিকিৎসার ব্যাপারে মার্কিনদের মাথাব্যথা নেই।
আমরা সে রাতে নাগাসাকিতেই ছিলাম। ঘুম আসছিল না। তিনটি শব্দের ওপর আমার প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ঘৃণা তৈরি হলো। শব্দগুলো হলো: অস্ত্র, সেনাবাহিনী এবং যুদ্ধ। এই তিনটি যত দিন থাকবে, পৃথিবীতে তত দিন শান্তি আসবে না।