যুদ্ধের চেহারা মেয়েলি নয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মিনস্ক শহরের প্রান্তে একটি তিনতলা বাড়ি। দেখেই মনে হয়েছিল যুদ্ধের পরপরই তৈরি হয়েছে সেটা। বহুদিন ধরে বেলি ফুলের গাছ বেড়ে উঠেছিল বাড়ি বেয়ে। এখান থেকেই আমার খোঁজার শুরু। খুঁজতে গিয়ে যন্ত্রণা, ঘৃণা, আবেগ আর বিহ্বলতা অনুভব করেছি।...বুঝতে চেষ্টা করেছি, মৃত্যু আর খুন, মানবতা আর অমানবিকতার মধ্যকার পার্থক্য; কী করে একজন মানুষ অন্য একজন মানুষকে হত্যা করার মতো একাকী বদ্ধ-উন্মাদ সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। এমনকি হত্যা করতে বাধ্য হয়! আর আবিষ্কার করেছি, যুদ্ধে হত্যা করা ছাড়াও আরও অনেক ব্যাপার আছে, সেখানে আছে আমাদের স্বাভাবিক জীবনধারার মতো অনেক কিছুই। যুদ্ধ মানেও জীবন। অসংখ্য মানবিক সত্যের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছি, গোপনীয়তার সঙ্গেও। এমন সব প্রশ্নের সামনে পড়েছি, যেগুলো সম্পর্কে আগে কোনো ধারণাই ছিল না। উদাহরণ দিই, কেন আমরা হিংস্রতা দেখে অবাক হই না, আমাদের কি হিংস্রতার ব্যাপারে অবাক না হওয়াটাই স্বাভাবিক?
...পাঁচ শ মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়, তারপর মানুষ গোনা বন্ধ করে দিই, স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায় মুখগুলো, থেকে যায় শুধু তাঁদের কণ্ঠস্বর। আমার স্মৃতিতে তারা কোরাস হয়ে ভেসে ওঠে, কখনো সেই স্বর প্রায় শোনাই যায় না, শুধু পাওয়া যায় কান্নার আওয়াজ। স্বীকার করে নিচ্ছি, কাজটা করে উঠতে পারব বলে সব সময় নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারিনি আমি, বিশ্বাস করতে পারিনি পথের শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব। কখনো সংশয় আর ভয় চেপে ধরেছে আমাকে। সবকিছু ছেড়েছুড়ে সরে দাঁড়ানোর ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু তা পারিনি। হিংস্রতা আমাকে বন্দী করেছে, উঁকি মেরেছি অতলে—যদি কিছু বুঝে উঠতে পারি! এখন মনে হয়, আমি কিছুটা জ্ঞান আহরণ করতে পেরেছি, কিন্তু তাতে বেড়ে গেছে প্রশ্নের সংখ্যা, উত্তর পেয়েছি আরও কম। কিন্তু পথচলা শুরু করার সময় আমি এটা একেবারে টেরই পাইনি...
এই বাড়িটির দিকে আমাকে টেনে এনেছিল শহরের সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছোট্ট একটি সংবাদ। সেখানে লেখা হয়েছিল, মিনস্কের মোটরগাড়ি কারখানা ‘উদারনিক’ পেনশনে যাওয়ার আগে তাঁদের কর্মচারী জ্যেষ্ঠ হিসাবরক্ষক মারিয়া ইভানোভ্না মারোজভাকে সংবর্ধনা দিয়েছে। পত্রিকায় লেখা হয়েছে, যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন স্নাইপার। ১১টি পদক পেয়েছেন, স্নাইপার হিসেবে ৭৫ জনকে হত্যা করেছেন।
...ছোটখাটো নারী, বাচ্চা মেয়েদের মতো বেণি করে বড় একটা চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর মুখ হাত দিয়ে ঢাকা: ‘না না, আমি কিছু বলব না। আবার ফিরে যেতে হবে সেই অতীতে? পারব না আমি...আজ পর্যন্ত আমি যুদ্ধ নিয়ে তৈরি সিনেমাই দেখিনি। তখন তো আমার একেবারে বালক-বয়স। স্বপ্ন দেখছিলাম আর বেড়ে উঠছিলাম, বেড়ে উঠছিলাম আর স্বপ্ন দেখছিলাম। আর ঠিক তখন—যুদ্ধ! তোমার জন্যই তো আমার কষ্ট হচ্ছে, জানি না কী বলছি! তুমি সত্যিই এসব জানতে চাও? আমার কাছে কেন? জানতে চাইলে আমার স্বামীর কাছে যাও। ও স্মৃতিকথা বলতে পছন্দ করে। কমান্ডারের, জেনারেলের নাম কী ছিল—সব ওর মনে আছে। আমার কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে, তখন কেবল ২২ বছর হয়েছে আমার। নিজের যুদ্ধ। চারদিকে অসংখ্য মানুষ, কিন্তু আমি একা। কারণ, মৃত্যুর কাছে মানুষ একাকী। আমার মনে আছে কী ভীষণ একাকিত্ব চেপে ধরেছিল আমাকে।
ক্যাসেট প্লেয়ার সরিয়ে নিতে বললেন, ‘কথা বলতে হলে তোমার চোখের দিকে তাকানো দরকার আমার, আর এই ক্যাসেট প্লেয়ারটা সমস্যা করছে।’
তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ওটার অস্তিত্বের কথা ভুলে গেলেন। মারিয়া ইভানোভ্না মারোজভা (ইভানুশকিনা), ল্যান্স করপোরাল, স্নাইপার: ‘এটা খুবই সাধারণ একটা গল্প...একজন অতি সাধারণ রুশ তরুণীর গল্প, সে সময় এমন তরুণী অনেক ছিল...তখন আমার নিজের বাড়ি ছিল দিয়াকোভ্স্কোয়ে গ্রামে, এখন সেটি মস্কোর প্রলেতারস্কি রাইওন (অঞ্চল বা জেলা)। যুদ্ধ শুরু হলো, আমার তখন ১৮ বছর বয়সও পূর্ণ হয়নি, চুল ছিল একেবারে হাঁটু পর্যন্ত...কেউই তখন ভাবেনি, যুদ্ধ এত দীর্ঘ সময় ধরে চলবে, সবাই অপেক্ষা করছিল, এই বুঝি শেষ হবে। শত্রুদের তাড়িয়ে দেব একেবারে। আমি যৌথ খামারে কাজ করতাম। এরপর হিসাববিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করলাম, কাজ শুরু করলাম। যুদ্ধ চলছেই...আমার মেয়ে বন্ধুরা...সেই তরুণীরা বলাবলি করছিল, “যুদ্ধে যাওয়া দরকার।” এই শব্দগুলো ভাসছিল বাতাসে। নিয়োগ-সংক্রান্ত অফিসে সবাই কোর্স করার জন্য নাম লেখালাম। কেউ হয়তো লেখাল শুধু বন্ধুদের সঙ্গ পাওয়ার জন্যই। সেখানে আমাদের যুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য রাইফেল থেকে গুলি করা, গ্রেনেড ছোড়া শেখানো হলো। স্বীকার করছি, শুরুর দিকে রাইফেল হাতে নিতেই ভয় লাগত। ভাবতেই পারতাম না, রাইফেল হাতে নিয়ে কাউকে খুন করতে যাব, আসলে ফ্রন্টে যাওয়া ছাড়া আর কোনো ভাবনা ছিল না। আমরা কোর্স করছিলাম ৪০ জন। আমাদের গ্রাম থেকে ছিল চারজন, আমরা বন্ধু ছিলাম। পাশের গ্রাম থেকে ছিল পাঁচজন, মানে সব গ্রাম থেকেই ছিল কেউ না কেউ। তারা সবাই মেয়ে। যার যাওয়ার সুযোগ আছে, সে রকম পুরুষেরা তো বহু আগেই যুদ্ধে চলে গেছে।
‘কখনো কখনো যুদ্ধে যাওয়ার ডাক আসত গভীর রাতে, তৈরি হওয়ার জন্য সময় দেওয়া হতো দুই ঘণ্টা এবং তারপর তাদের নিয়ে চলে যাওয়া হতো। কখনো চাষের মাঠ থেকেও তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। (নীরবতা)। মনে করতে পারছি না, তখন আমরা নাচতাম কি না। যদি নাচতাম, তাহলে মেয়েরাই মেয়েদের সঙ্গে নাচতাম, পুরুষেরা তো কেউ ছিলই না। আমাদের গ্রামে নীরবতা নেমে এল। কমসোমল থেকে খুব দ্রুত আদেশ এল। জার্মানরা মস্কোর খুব কাছে চলে এসেছে। দেশমাতৃকাকে রক্ষা করার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। হিটলার মস্কো দখল করে নেবে—তা কী করে হয়! কখনোই তা হতে দেব না। আমি একা নই...সব মেয়েই ফ্রন্টে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল। আমার বাবা তখন দেশের জন্য লড়ছিলেন। ভেবেছিলাম, আমরা কয়েকজনই এসেছি নিয়োগ অফিসে, কিন্তু দেখি, সেখানে অনেক অনেক মেয়ে এসে হাজির হয়েছে। আমি বিস্মিত হলাম! আমার হৃদয় জ্বলে যাচ্ছিল। নিয়োগের বিষয়টি ছিল ভীষণ রকম কঠোর। প্রথমত, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। আমি ভয় পাচ্ছিলাম, আমাকে না-ও নিতে পারে বলে। ছোটবেলায় অসুখে খুব ভুগেছি। মা বলতেন, আমার শরীরের হাড়গুলো দুর্বল। ছোটকালে এ নিয়ে বন্ধুরা আমাকে খ্যাপাত। যদি কোনো মেয়ে যুদ্ধে যাওয়ার পর সেই পরিবারে আর কোনো সন্তান না থাকে, তাহলেও তাকে নিয়োগ দেওয়া হতো না। কারণ, মাকে একা ফেলে যাওয়া ঠিক নয়। হায়, আমাদের মায়েরা! তাদের চোখের জল শুকাতোই না...তারা রাগ করত, অনুরোধ করত...তবে আমার আরও দুই বোন আর দুই ভাই ছিল...অবশ্য তারা ছিল আমার চেয়ে একটু ছোট, কিন্তু সেটাও বিবেচনায় নেওয়া হলো। আরও একটা ব্যাপার, যৌথ খামার থেকে সবাই চলে গেছে ফ্রন্টে, কাজ করার লোক নেই, যৌথ খামারের সভাপতি আমাদের ছাড়তে চাইলেন না। এক কথায়, আমাদের তিনি ফ্রন্টে যেতে নিষেধ করলেন।
‘আমরা কমসোমলের স্থানীয় অফিসে গেলাম, সেখানেও আমাদের “না” বলে দেওয়া হলো। তখন আমরা দল বেঁধে চলে গেলাম আঞ্চলিক অফিসে। আমাদের সবার মন সে সময় উত্তেজনায় টগবগ করছে, সবার হৃদয় জ্বলছে। এখান থেকেও আমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হলো বাড়িতে। তখন আমরা ঠিক করলাম, মস্কোতে কমসোমলের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকের কাছে যাব, শেষ দেখে ছাড়ব...কে কথা বলবে, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী কে?
‘ভাবলাম, সেখানে নিশ্চয় ভিড় থাকবে না, কিন্তু সম্পাদকের ঘরের দিকে যাওয়ার পথে এমন ভিড় যে দরজার কাছাকাছিই যাওয়া যাচ্ছিল না। সারা দেশ থেকে সেখানে যুবকেরা জড়ো হয়েছে, এমন অনেক মানুষ সেখানে, যাদের অবরোধ করে রাখা হয়েছিল। এমন অনেক মানুষ সেখানে, যারা স্বজন হারিয়ে প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে এসেছে। পুরো সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকেই তারা এসেছিল। হ্যাঁ, হ্যাঁ...অল্পকথায়...কিছু সময়ের জন্য আমরা বিভ্রান্ত হলাম...রাত ১১টায় কোনো রকমে সম্পাদকের কাছে যেতে পারলাম।
আমাদের জিজ্ঞেস করা হলো, “গুলি করতে শেখোনি, তোমরা কীভাবে ফ্রন্টে যেতে চাও?”
আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম, “এরই মধ্যে তা শিখে নিয়েছি।”
“কোথায়, কীভাবে? ব্যান্ডেজ বাঁধতে পারো?”
“শুনুন, আমাদের এলাকার নিয়োগ অফিসে এলাকার ডাক্তার সাহেব আমাদের ব্যান্ডেজ বাঁধা শিখিয়েছেন।” তারা তখন চুপ করল, আমাদের দিকে বেশ মনোযোগ দিয়ে তাকাল। আমাদের হাতে আরেকটা ট্রাম্পকার্ড ছিল—আমরা একা নই, একসঙ্গে ৪০ জন মেয়ে, প্রত্যেকেই গুলি করতে পারি, প্রত্যেকেই প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারি।
আমাদের বলা হলো, “এখন যাও। তোমাদের বিষয়টির ইতিবাচক সমাধানই হবে।”

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘কী যে খুশি হয়ে আমরা ফিরে এলাম...হ্যাঁ, হ্যাঁ...ঠিক দুই দিন পরই আমাদের হাতে নিয়োগের চিঠি এল...নিয়োগ অফিসে এলাম। সেখানে এক দরজা দিয়ে ঢোকাল, আরেক দরজা দিয়ে বের করল—এত সুন্দর বেণি নিয়ে ঢুকেছিলাম, বের হলাম বেণিছাড়া...একেবারে সৈনিকের মতো খাটো করে দেওয়া চুল নিয়ে...ফ্রকটাও রেখে দিল। মায়ের কাছে চুল আর ফ্রক—কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না। মা খুব করে চাইছিলেন, আমার কাছ থেকে কিছু, আমার নিজের কিছু যেন তাঁর জন্য রেখে যাই। আমাদের পরিয়ে দেওয়া হলো ট্র্যাকসুট, আমাদের দেওয়া হলো ব্যাগ, যাতে ভরে দেওয়া হলো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র—ঢেকে দেওয়া হলো খড় দিয়ে। খড়গুলোতে তখনো মাঠের ঘ্রাণ! দারুণ রোমাঞ্চিত হয়ে ট্রেনে উঠলাম আমরা। সবাই মিলে হাসি-ঠাট্টা করতে লাগলাম। মনে আছে, খুব হাসাহাসি করেছিলাম। যাচ্ছি কোথায়? জানা ছিল না। আমাদের তো জানাই ছিল না, কেমন মানুষ হব। কেবল লক্ষ্য ছিল একটাই—ফ্রন্ট! সবাই যুদ্ধের মাঠে—আমরাও। সেলকোভা স্টেশনে পৌঁছালাম, স্টেশনের খুব কাছেই ছিল মেয়েদের জন্য স্নাইপার স্কুল। বুঝতে পারলাম, এটাই আপাতত গন্তব্য। তাহলে স্নাইপার হচ্ছি! সবার মন আনন্দে ভরে উঠল। দারুণ ব্যাপার। গুলি চালাব! এ বিষয়ে পড়াশোনা করব। শিখে নিচ্ছিলাম নিয়মকানুন, রাসায়নিক সুরক্ষা। সব মেয়েই খুব মগ্ন হয়ে সবকিছু শিখে নিচ্ছিল। চোখ বন্ধ করেই লক্ষ্য ভেদ করার কৌশল, বাতাসের গতি, লক্ষ্যবস্তুর দূরত্ব, ট্রেঞ্চ কাটা, হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাওয়া—এই সবই আমরা ইতিমধ্যে শিখে নিয়েছিলাম। ফ্রন্টে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলাম আমরা। আগুনে...হ্যাঁ হ্যাঁ, কোর্স শেষে ফায়ার ড্রিলে আমি পাঁচে পাঁচ পেয়েছিলাম। সবচেয়ে কঠিন মনে হয়েছিল জরুরি হুইসেলে উঠে পড়া আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নেওয়ার কাজটি।
‘বুট জুতোগুলো আমরা নিলাম সাইজের চেয়ে দুই বা তিন নম্বর বড়। কারণ, জরুরি সময়ে যেন দ্রুত তা পায়ে গলিয়ে নেওয়া যায়। পোশাক পরা, জুতো পরা আর লাইনে দাঁড়ানোর জন্য সাকল্যে দেওয়া হতো পাঁচ মিনিট। কখনো দ্রুত তৈরি হওয়ার জন্য মোজা না পরে শুধু বুট জুতো পায়ে গলিয়ে লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছি। একটি মেয়ের পা তো প্রায় জমেই গিয়েছিল। সার্জেন্ট সেটা লক্ষ করলেন, তারপর শিখিয়ে দিলেন কীভাবে এই অবস্থা থেকে মুক্ত হতে হয়। তারপর বাজখাঁই গলায় আমাদের উদ্দেশে বললেন, “মেয়েরা, তোমাদের আমি সৈনিক হিসেবে গড়ে তুলব নাকি তোমরা নাৎসিদের শিকারে পরিণত হতে চাও? মেয়েরা, আহ্ মেয়েরা...।”
‘সবাই আমাদের ভালোবাসে, সবাই আমাদের জন্য আফসোস করে। আমরা বরং রেগে যাই, কেন আমাদের জন্য আফসোস করতে হবে? আমরা কি সবার মতো সৈনিক নই?
শেষে আমরা ফ্রন্টে এলাম, আরশার কাছে...৬২তম পদাতিক ডিভিশনের সদস্য হয়ে...যতটুকু মনে আছে, আমাদের কমান্ডার—নাম ছিল কর্নেল বারোদকিন, আমাদের দেখে রেগে উঠলেন: “বাচ্চা মেয়েগুলোকে হাওলা করে দিল আমাদের! এই নারী সাংস্কৃতিক কোরাস দল নিয়ে আমি কী করব? কোরাস গান! এটা যুদ্ধ—নাচের মঞ্চ নয়, ভয়ংকর যুদ্ধ।” ...পরে অবশ্য আমাদের ডেকে নিলেন, দুপুরের খাবার খাওয়ালেন। তারপর তাঁর অ্যাডজুট্যান্টকে জিজ্ঞেস করলেন, “চায়ের সঙ্গে খাওয়ার মতো মিষ্টিজাতীয় কিছু নেই আমাদের?”
আমরা ভীষণ ক্ষিপ্ত হলাম। লোকটা মনে করেছেন কী? আমরা যুদ্ধ করতে এসেছি। আর তিনি কি না আমাদের সৈনিক হিসেবে নয়, বাচ্চা মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করছেন! বয়স হিসাব করলে আমরা ছিলাম তাঁর মেয়ের বয়সী। তিনি বললেন, “তোমাদের নিয়ে আমি কী করব, বলো তো! তোমাদের পেল কোথায়?”
এভাবেই তিনি আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। আর আমরা কিন্তু তখন নিজেদের যোদ্ধা হিসেবে কল্পনা করতে শুরু করেছি। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা যুদ্ধে যোগ দিয়েছি। কেমন গুলি করতে পারি, কেমোফ্লাজ করতে পারি, পরদিন সকালেই তার পরীক্ষা নেওয়া হলো। আমরা অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণে খুব ভালো করলাম। ফ্রন্ট থেকে দুই দিনের জন্য পুরুষ স্নাইপারদের আনা হয়েছিল আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। দেখা গেল, আমরা তাদের চেয়ে ভালো গুলি চালাতে পারি। তারা মনে হয় জীবনে প্রথম নারী স্নাইপারদের দেখল। লক্ষ্যভেদের পর কেমোফ্লাজ...কর্নেল এলেন, প্রথমে মাঠের দিকে রাখলেন তীক্ষ্ণ নজর। না, কাউকে দেখতে পেলেন না, এরপর তাকালেন ঝোপের দিকে, কিছুই দেখতে পেলেন না। তারপর তাঁর পায়ের নিচে আচমকা কী যেন নড়েচড়ে উঠল, বলে উঠল, “কমরেড কর্নেল, আর পারি না, আপনি খুব ভারী।” চারদিকে উঠল হাসির তুফান। কর্নেল ভাবতেই পারেননি, আমরা এত ভালো কেমোফ্লাজ করতে পারি। কর্নেল বললেন, “এখন, এই মেয়েগুলো সম্পর্কে আমার আগে বলা কথাগুলো ফিরিয়ে নিচ্ছি।” কিন্তু তারপরও লোকটা আমাদের কম কষ্ট দেননি...বহুদিন পর্যন্ত আমাদের বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেননি তিনি।
আমরা প্রথমবারের মতো “শিকার”-এ গেলাম (স্নাইপাররা এই শব্দটাই ব্যবহার করে)। আমার জুটি মাশা কাজলোভা। কেমোফ্লাজ করেছি। শুয়ে আছি। আমি আছি পর্যবেক্ষণে, মাশার হাতে রাইফেল। হঠাৎ মাশা আমাকে বলে, “গুলি কর, গুলি কর! দেখছিস, জার্মান...।” আমি ওকে উত্তর দিই, “আমি পর্যবেক্ষণ করছি, তুই গুলি কর!” “আমরা যতক্ষণ এ নিয়ে আলোচনা করব, ততক্ষণে ও পগার পার হয়ে যাবে।” বলল মাশা। আমি আবার ওকে আমার কথাই বলি, “সবার আগে কোথায় গুলি করছি, তার একটা ম্যাপ দরকার, তারপর দেখা দরকার কোথায় আছে সরাইখানা, কোথায় বার্চগাছ...স্কুলের বাচ্চার মতো এই করতে থাকবি নাকি? আমি কাগজের যুদ্ধে নামিনি, গুলি করতে নেমেছি।” দেখলাম, মাশা আমার ওপর রেগে উঠছে, “তাহলে গুলি কর, করছিস না কেন?”
আমরা তুচ্ছ বিষয়ে অকারণ তর্ক করে যেতে লাগলাম। আর এই সময়ের মধ্যেই জার্মান অফিসার সৈনিকদের নির্দেশনা দিলেন। একটা গাড়ি এল আর সৈনিকেরা তাতে তুলতে থাকল মালামাল। অফিসার দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানে। আবার কী নির্দেশ দিলেন। তারপর দৃষ্টিসীমা থেকে গেলেন উধাও হয়ে। আমরা তর্ক করলাম। আমি দেখলাম, এরই মধ্যে অফিসার দুবার দেখা দিয়েছেন। তৃতীয়বার দেখা দেওয়ার পরও যদি আমরা তর্ক করতে থাকি, তাহলে আর ওকে মারা যাবে না। তৃতীয়বারের মতো যখন তিনি বের হলেন আবার, মানে এই সামনে আসে, এই উধাও হয়—এমন এক মুহূর্তে আমি ঠিক করলাম, গুলি করব। ঠিক তখনই মাথার মধ্যে ভাবনা ছলকে উঠল, এ তো মানুষ! হোক না শত্রু, কিন্তু এ তো মানুষ! আর ভাবনাটা মাথায় আসতেই হাত কাঁপতে থাকল আমার, ঘাম ঝরতে শুরু করল শরীর বেয়ে, শরীর হিম হয়ে উঠল। কেমন যন এক ভয় চেপে ধরল আমাকে, এখনো এই ঘটনাটা আমার স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে...প্লাইউডের টার্গেটে গুলি করার পর সত্যিকারের মানুষের প্রতি গুলি করা খুবই কঠিন। আমি রাইফেলে লাগানো অপটিক্যাল সাইটে চোখ রেখেছি। শরীরের ভেতর থেকে কী এক প্রতিবন্ধকতা আমাকে গুলি করতে দিচ্ছে না। আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। তবে মন শক্ত করে আমি ট্রিগার টিপলাম...লোকটা হাত নাড়ল আর মাটিতে পড়ে গেল। লোকটা মারা গেছে কি বেঁচে আছে, তা জানি না। কিন্তু এরপর আমার শরীর ঘেমে উঠল, কেমন এক ভয় আমাকে ঘিরে ধরল। আমি—একজন মানুষকে মেরে ফেলেছি! এই অনুভূতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার দরকার ছিল। মানে—ভয়ংকর ব্যাপার! ভোলা যায় না।
‘আমরা ফিরে আসার পর সবাইকে জানালাম কী ঘটেছে, আমার অনুভূতির কথা শুনে বৈঠক ডাকা হলো। ক্লাভা ইভানোভ্না ছিলেন আমাদের কমান্ডার। তিনি বললেন, “ওদের জন্য দয়া দেখানোর কিছু নেই, ওদের ঘৃণা করতে হবে।” ক্লাভা ইভানোভ্নার বাবাকে ফ্যাসিস্টরা হত্যা করেছিল। এমন হতো, আমরা গান গাইছি, আর তিনি বলছেন, “মেয়েরা, এখন নয়, ওই বদমাশদের সঙ্গে আগে যুদ্ধে জয়ী হই, তারপর না হয় গান গাওয়া যাবে।” কিন্তু খুব দ্রুত আমরা এই অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারিনি। ঘৃণা করা আর হত্যা করা—এটা নারীর কাজ নয়, আমাদের কাজ নয়...নিজের মনকে প্রস্তুত করার ব্যাপার ছিল।
..........
‘রাতে আমরা আড্ডা দিতাম। কী নিয়ে কথা বলতাম? অবশ্যই বাড়ির কথা বলতাম। অবশ্যই মায়ের কথা বলতাম, যার স্বামী বা ছেলে যুদ্ধে গেছে, তার কথা বলতাম। যুদ্ধ শেষ হলে আমরা কী করব, তা নিয়ে কথা বলতাম। বিয়ে করব, আমাদের স্বামীরা কি আমাদের ভালোবাসবে, এ-ও ছিল আলোচনার বিষয়। এসব শুনে কমান্ডার হাসতেন, “আরে মেয়েরা, তোমাদের সবাই ভালোবাসবে, কিন্তু যুদ্ধের পর তোমাদের কেউ বিয়ে করতে চাইবে না। তোমাদের হাতের নিশানা নিখুঁত, কপালে প্লেট ছুড়ে মারবে আর মরে যাবে।” আমি যুদ্ধেই স্বামী খুঁজে পেয়েছি, একই ব্রিগেডে ছিলাম আমরা। ও দুবার আহত হয়েছিল। কালশিটে পড়ে গিয়েছিল চেহারায়। যুদ্ধের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত ও ফ্রন্টে ছিল। এরপর সারা জীবনই সেনাবাহিনীতে কাজ করেছে। ওকে বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই, যুদ্ধ কাকে বলে, কোত্থেকে ফিরেছি আমি। আমি যদি তার সঙ্গে একটু গলা চড়িয়ে কথা বলি, তবে ও হয় শোনে না অথবা শুনে চুপ করে থাকে। আমি ওকে ক্ষমা করে দিই। ক্ষমা করতে শিখেছি। দুই সন্তানকে বড় করেছি, ওরা পড়ালেখা শেষ করেছে। ছেলে আর মেয়ে।
‘আপনাদের আরও বলছি, শুনুন...যুদ্ধ শেষে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হলো। আমি মস্কো ফিরে এলাম। মস্কো থেকে আমাদের বাড়ি কয়েক কিলোমিটার দূরে। হেঁটেই যাওয়া যায়। এখন তো সেখানে মেট্রো আছে, তখন ছিল শুধু পুরোনো চেরি অর্কিড। গিরিখাতের ওপারে। সেই গিরিখাতের মধ্য দিয়ে আমাকে হেঁটে যেতে হবে। আমি গিরিখাত পার হয়ে বাড়ি ফিরতে ভয় পাচ্ছিলাম। তখন চারদিক আঁধার করে এসেছে। দাঁড়িয়ে আছি, বুঝতে পারছি না, কী করা উচিত। আমার কি এখন ফিরে যেতে হবে, কাল সকালে আবার আসব এদিকে, নাকি বুকে সাহস সঞ্চয় করে ঝুঁকি নিয়ে এখনই পাড়ি দেব বাড়ির পথ? এখন মনে হচ্ছে, কি হাসিরই না ব্যাপার ছিল সেটা, ফ্রন্ট এখন অতীতের বিষয়, কী দেখিনি সেখানে? লাশ আর কত কি! আর এখন কি না এই গিরিখাতকে ভয় পাচ্ছি!
‘এখনো বাতাসে লাশের গন্ধ পাই, তাতে মিশে থাকে পোড়া চুলের গন্ধ...কিন্তু এখনো তো সেই কিশোরীই থেকে গেছি। রেলের ওয়াগনে, যখন আসছিলাম...জার্মানি থেকে ফিরছিলাম বাড়িতে...কার যেন রুকজ্যাক থেকে একটা ইঁদুর লাফিয়ে উঠল, তাতে আমরা সব মেয়েই যে কী লাফালাফি শুরু করলাম...কেউ উঠে যাচ্ছে ওপরের বার্থে, কারও মাথায় ছুঁলো কারও পা। আমাদের সঙ্গে যাচ্ছিলেন এক ক্যাপ্টেন। তিনি বললেন, “তোমাদের সবাই পদক পাওয়া সৈনিক আর ইঁদুরকে ভয় পাচ্ছো!”
এ সময় একটি মালবাহী গাড়ি এগিয়ে এল। ভাবলাম, দাঁড় করাই। গাড়িটা থেমে গেল।
আমি চিৎকার করি, “দিয়াকোভ্স্কোয়ের দিকে যাবে?”
“আমি তো দিয়াকোভ্স্কোয়েতেই যাচ্ছি।” বলে এক যুবক গাড়ির দরজা খুলে দেয়। আমি উঠে পড়ি। ছেলেটি আমার সুটকেস উঠিয়ে দেয় গাড়িতে। তারপর গাড়ি ছাড়ে। আমার শরীরে সৈনিকের পোশাক, পদক দেখে ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, “কয়টা জার্মান মেরেছ?”
আমি ওকে উত্তর দিই, “পঁচাত্তরটা।”
ও হাসে, বলে, “মিথ্যে বলছ। একটা জার্মানকেও কি নিজের চোখে দেখেছ?”
আর আমি তখনই বললাম, “কোলকা চিঝোভ? তুই কোলকা না? তোর মনে আছে, আমি একদিন তোর গলায় লাল টাই বেঁধে দিয়েছিলাম?” যুদ্ধের আগে আমি একসময় পাইওনিয়ারদের নেতা ছিলাম।
“মারুস্কা! তুই!”
“আরে হ্যাঁ, আমি!”
“সত্যি বলছিস!” বলেই ও ব্রেক কষে।
আমার চোখে পানি। দেখি, ওর চোখও জলে ভেসে যাচ্ছে। সাক্ষাৎ বটে! বাড়ি এলাম, ও আমার সুটকেস হাতে নিয়ে দৌড়ে যায় আমার মায়ের কাছে, সুটকেস হাতে নিয়েই নাচতে থাকে। বলে, “শিগগির এসো, আমি তোমার মেয়েকে নিয়ে এসেছি।”
ভুলতে পারি না। কী করে ভুলব? ফিরলাম। সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হলো। আবার জুতো পরায় অভ্যস্ত হলাম। যুদ্ধের তিন বছর তো বুট জুতো পরে কাটাতে হয়েছে।...।’
রুশ ভাষার মারিয়ার আদুরে নাম মারুস্কা

>
.
.
প্রসঙ্গত
উ ভাইনি নি ঝেনস্কোয়ে লিৎসো—বাংলায় যুদ্ধের চেহারা মেয়েলি নয় সদ্য নোবেলজয়ী স্ভেতলানা আলেক্সিয়েভিচের প্রথম বই। ১৯৭০-এর দশকে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া নারীদের কাছ থেকে তিনি শুনেছিলেন প্রত্যক্ষ যুদ্ধের বৃত্তান্ত। সে যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে লিখেছেন বইটি। সেই বই থেকে অতি সংক্ষিপ্ত আকারে মারিয়া ইভানোভ্না মারোজভা নামে একজন নারী স্নাইপারের যুদ্ধ-অভিজ্ঞতার খণ্ডাংশ এখানে ছাপা হলো। প্রচলিত অর্থে এটি গল্প নয়, বাস্তব মানুষের কণ্ঠে বর্ণিত সত্য কাহিনি।