মানুষের ঐক্য ও বাকস্বাধীনতার লড়াই

ঢাকা সাহিত্য উৎসবের আয়োজন ছিল গত ১৯ থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত। এসেছিলেন দেশ-বিদেশের কবি, লেখক, সাংবাদিক ও প্রকাশকেরা। এ আয়োজনে থাকছে একটি লেখা ও দুটি সাক্ষাৎকার
ভারতে মুহম্মদ ইকলাখের গো-মাংস খাওয়ার গুজবে তাঁকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে নয়নতারা সেহগালসহ অনেক লেখক ফেরত দেন তাঁদের সরকারি–বেসরকারি সম্মাননা। ছবি: সংগৃহীত
ভারতে মুহম্মদ ইকলাখের গো-মাংস খাওয়ার গুজবে তাঁকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে নয়নতারা সেহগালসহ অনেক লেখক ফেরত দেন তাঁদের সরকারি–বেসরকারি সম্মাননা। ছবি: সংগৃহীত

এটাই আমার প্রথম বাংলাদেশে সফর হলেও দেশটির জন্মের সময় থেকেই এর সঙ্গে রয়েছে আমার আবেগের সম্পর্ক। আর সাহিত্য উদ্যাপনের জন্য আমি এখানে এসেছি, এর চেয়ে সুখকর আর তো কিছু হতে পারে না। ফলে, এই অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। আমাদের সাহিত্য উদ্যাপন করতে হবে। এই ঝামেলাপূর্ণ অস্থির সময়ে কাজটি করা আরও জরুরি এ কারণে যে পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই সাহিত্যের ওপর আক্রমণ হচ্ছে, আর নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ভারতেও এই হামলা হচ্ছে। তারপরও আজ আপনাদের সামনে কী বলব, সেটা চিন্তা করার সময়ই জানতাম, সাহিত্য নিয়ে সুন্দর বক্তব্য দিতে পারব না আমি। এর বদলে আমরা ভারতে কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি, বলব সে বিষয়ে। কারণ, ভারত বা বিশ্বের যেখানেই লেখকদের জীবনে যা ঘটে, তার জন্য উদ্বিগ্ন হন সব জায়গার লেখকেরাই। জাতিতে আমরা ভিন্ন হতে পারি, কিন্তু আমরা কল্পনার দেশের মানুষ। আর কল্পনার জগতের ওপর যখন লৌহপর্দা নেমে আসে, তখন আমাদের লেখক হিসেবেই মাঠে নামতে হবে, ভিন্ন ভিন্ন জাতি হিসেবে নয়। এই সত্যের স্বীকৃতি দিয়ে ১৫০টি দেশের লেখকেরা আমাদের সমর্থন দিয়েছেন, আর সম্প্রতি ২০০ জন ব্রিটিশ লেখক আমাদের সমর্থনে লন্ডনের রাস্তায় মিছিল করেছেন।

ভারতে আমরা মুক্তবাকের ওপর হামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছি, চিন্তা ও লেখার স্বাধীনতার ওপর হামলার বিরুদ্ধে লড়াই করছি। কিন্তু সাহিত্যকে যেহেতু জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে আলাদা করে খুপরিতে ঢোকানো যাবে না, তাই আমাদের এই মুক্তবাকের লড়াই আরও বিস্তৃত হয়েছে। আমরা ভারতকে একটি বহুত্ববাদী, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে রক্ষার লড়াই করছি, যেখানে সংবিধান প্রত্যেক ভারতীয়কে ইচ্ছামতো বসবাসের, খাওয়ার ও ভক্তি করার স্বাধীনতা দিয়েছে। হ্যাঁ, আমরা এখন এই লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছি। আমি বলতে চাই যে এই প্রতিবাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, এটা পরিকল্পিত ও সংগঠিত নয়, এটা আন্দোলন নয়। এটা আরও বেশি চিত্তাকর্ষক এই কারণে যে এতে বিভিন্ন খাতের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পাওয়া গেছে। এর ফলে লেখক, শিল্পী, অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা, ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানীরা একত্র হয়েছেন। ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা ইতিহাসের জায়গায় রূপকথা এস্তেমাল করার প্রতিবাদ করছেন, যার মাধ্যমে এই একুশ শতকে আমাদের বৈদিক যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওদিকে বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানমনস্কতা ও অনুসন্ধানের চেতনা নষ্ট করার বিপক্ষে আন্দোলন করছেন, যেটা ছাড়া কোনো জাতি নিজেকে আধুনিক দাবি করতে পারে না। এই প্রতিবাদের সাধারণ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এটাকে যুক্তিহীনতার বিপক্ষে যুক্তির লড়াই বলতে পারি। এটা হচ্ছে জ্ঞান ও সৃজনশীলতার দরজা উন্মুক্ত রাখার দাবি, আর নতুন চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনধারা যেন আমাদের উজ্জীবিত করতে পারে, তার দাবি। বিগত কয়েক শতকে এ সবকিছু যেভাবে আমাদের সঞ্জীবিত করেছে, ঠিক সেভাবেই এগুলো আমাদের সঞ্জীবিত করুক—আমাদের দাবি এটাই।

নয়নতারা সেহগাল। ছবি: আবদুস সালামনয়নতারা সেহগাল। ছবি: আবদুস সালাম
নয়নতারা সেহগাল। ছবি: আবদুস সালামনয়নতারা সেহগাল। ছবি: আবদুস সালাম

আমাদের অনেকেই সাহিত্য আকাদেমির পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন, যাঁরা সেখানে চাকরি করতেন, তাঁরা অনেকেই পদত্যাগ করেছেন। কয়েক দিন আগে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী রাষ্ট্রপতির কাছে পদ্মভূষণ পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘বর্তমান সরকার আমার প্রিয় মাতৃভূমিকে যে পথে পরিচালিত করছে, তাতে আমাদের দেশ হিন্দুধর্মীয় একনায়কতন্ত্রে পরিণত হবে।’ তিনি মনে করেন, ‘হিন্দুত্ববাদী আদর্শ বিভাজনমূলক, অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক’। এই বিজ্ঞানী কিন্তু একজন হিন্দুই। আরেকজন ব্যক্তি এ ব্যাপারে আবেগঘন প্রতিবাদ করেছেন, যদিও তাঁর কাছ থেকে এটা ঠিক প্রত্যাশিত ছিল না। তিনি ভারতীয় নৌবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিরাল, যিনি নিজেও একজন হিন্দু। তিনি হিন্দুত্ববাদী আদর্শ বাতিল করেছেন, যা কি না ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে চায়। অ্যাডমিরাল সাহেব আস্থা রেখেছেন বহুত্ববাদী ভারতের ওপর। আমরা সবাই এই বিশ্বাসে একত্র হয়েছি যে দেশের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না। মানুষের ধর্ম আছে, প্রত্যেক মানুষই ভারতের সমনাগরিক হিসেবে ধর্মের চর্চা করতে পারে। ভারতে নানা ধর্মের সমাহার ঘটেছিল। এসব ধর্ম ও সংস্কৃতি আমাদের জীবন, ভাষা, সাহিত্য, স্থাপত্যবিদ্যা, সংগীত, গান, নাচ, খাদ্যাভ্যাস, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচার-ব্যবহারের ওপর যে ছাপ ফেলেছিল, তার কারণে আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি। আর উত্তর ভারতের মানুষ হিসেবে আমি সংস্কৃতিগতভাবে নিজেকে আধা মুসলমান মনে করি।
চূড়ান্ত বিচারে ভারতের ব্যঞ্জনার জন্য লড়াই করছি আমরা, যা আমি আগেই বলেছি। অভিনেতা ও পতৌদির নবাবের ছেলে সাইফ আলী খান বলেছেন, ‘আমাদের এই মহান দেশ আসলে এক সংকর, আমাদের ভিন্নতাই আসলে আমাদের এমনটা বানিয়েছে। আমি গির্জায় প্রার্থনা করেছি, আবার আমার স্ত্রী কারিনার সঙ্গে মন্দিরে গিয়েছি। কারিনাও দরগায় গিয়ে মাথা নত করেছে, মসজিদে নামাজ পড়েছে। আমরা যখন বাড়ি পরিশুদ্ধ করেছি, তখন হাভান আয়োজন করেছি, পবিত্র কোরআন পাঠের আয়োজন করেছি। আর একজন পুরোহিত পবিত্র পানি ছিটিয়েছেন। আসলে ভারত যেন নানা রঙের সুতোয় বোনা এক কাপড়ের মতো।’
এখন কথা হচ্ছে, আমাদের বিদ্রোহী কণ্ঠস্বরগুলো এই নানা রঙের সুতোয় বোনা কাপড়টা রক্ষা করতে চায়। আমরা ভারতের ঐতিহাসিক, বহুধর্মীয়, বহুসাংস্কৃতিক পরিচয়ের সঙ্গে আপস করতে চাই না। হিন্দু মৌলবাদীরা আমাদের ভিন্নতাকে মুছে ফেলতে চায়, একক হিন্দু পরিচয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলতে চায় আমাদের। তাদের সেই প্রচেষ্টার কাছে আমরা মাথা নত করতে চাই না। রাষ্ট্রপতিই নিজেই ক্রমবর্ধমান ঘৃণার ঢেউ, সহিংসতা ও ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, যা ভারতের ব্যঞ্জনাকেই ফেলেছে ধ্বংসের হুমকিতে।
হ্যাঁ, আপনারা জিজ্ঞেস করতে পারেন, এসব রাজনীতিঘেঁষা তৎপরতার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক কী? লেখালেখি একধরনের রাজনৈতিক কাজ, কারণ আমাদের কল্পনা সময়ের সঙ্গে একধরনের বোঝাপড়া করে, হয় তার প্রতি সাড়া দেয়, না হয় প্রতিক্রিয়া জানায়। নাটক, কবিতা ও উপন্যাস রাজনীতির বিষয় নয়, কিন্তু এসব কোনো না কোনো সময়ের ফসল, আর প্রায়ই তা যেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন কল্পনামুখর মননের সৃজন। হয়তো অতীতকালে ব্যাপারটা ঠিক এমন ছিল না। যেমন: জেন অস্টিনের উপন্যাসের সঙ্গে নেপোলিয়নের যুদ্ধের সম্পর্ক নেই, কিন্তু বিশ ও একুশ শতকে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেও—অতীতে কখনোই এভাবে হয়নি। আর এখন পৃথিবীজুড়ে সবচেয়ে শক্তিশালী গল্প-উপন্যাস তো এর ফলাফল হিসেবেই রচিত হচ্ছে। সময়ের প্রতি লেখকদের এই অঙ্গীকারের কারণেই সৃষ্টি হচ্ছে অবিস্মরণীয় সাহিত্য।
আজ আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলেছি ভারতীয় হিসেবে; কিন্তু আমি একজন এশীয়ও বটে, সব এশীয় মানুষের সঙ্গে আমিও এই অঞ্চলের গর্ব ও উদ্বেগের ভাগীদার। আমি এ কারণে আনন্দিত যে নেপাল এখন একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, সেখানে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণীত হয়েছে, আর একজন নারী সেই রাষ্ট্রের প্রধান।
অং সান সু চি গণতন্ত্রের জন্য এককভাবে সাহসিকতার সঙ্গে যে লড়াই করে নির্বাচিত হয়েছেন, সে জন্য আমি গর্বিত। এই অঞ্চল ও পৃথিবী যে ভীতির সম্মুখীন হয়েছে, আমি নিজেও তার ভাগীদার। যারা চায় না সহিষ্ণুতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক, তারাই এই ঝামেলা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। সর্বোপরি, এ অঞ্চলে লেখালেখি ও সৃজনশীল শিল্প বিকশিত হওয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য আমরা এশীয়রা যথাসাধ্য চেষ্টা করব। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, চিন্তা ও লেখার এবং জীবন ও সমৃদ্ধি সৃজনের স্বাধীনতা না থাকলে সাহিত্যের উদ্যাপন করা কীভাবে সম্ভব?
আমি আশা করি, লেখকেরা অনুবাদের মাধ্যমে একে অপরের লেখার সঙ্গে পরিচিত হবেন, আর এ রকম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ঘটবে।
আমি একজন ভারতীয়, আর আপনাদের মতো আমি একজন এশীয়, কিন্তু আর সবার মতো আমি এই বিশ্বের নাগরিকও। তো, এই পৃথিবীর সমরূপতা-বিষয়ক আমার বাবার একটি গল্প দিয়ে আজ কথা শেষ করব:
তিহনি ছিলেন একজন সংস্কৃত পণ্ডিত ও দেশপ্রেমিক, তিনি মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতার আন্দোলনের জন্য নিজের গোটা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় চারবার কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, শেষবার কারারুদ্ধ হওয়ার পর ১৯৪৪ সালে কারাগারেই তিনি মারা যান। কিন্তু ব্রিটিশ নাগরিকদের ওপর হিটলারের বোমা বর্ষণের পর তিনি চোখের জল ফেলেছেন, হিটলারের সেনাবাহিনী প্যারিসে ঢোকার পরও তিনি কেঁদেছেন। তাঁকে যখন কেউ জিজ্ঞেস করত, ‘আপনি কোন জাতির মানুষ?’ তিনি উত্তর দিতেন, ‘আমি মানবজাতির মানুষ।’ সময় এসেছে, নিজেদের এখন স্মরণ করিয়ে দিতে হবে, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, বাক্স্বাধীনতা, মানবাধিকার বা পৃথিবীর যেকোনো স্থানে মানুষের কষ্টভোগ—সব ক্ষেত্রেই আমাদের একত্রে ডুবতে হবে, না হয় বাঁচতেও হবে একসঙ্গে। এই ঐক্য এখন আগের চেয়ে আরও বেশি মাত্রায় জরুরি।
আপনাদের সঙ্গে নিজের চিন্তা ভাগাভাগি করার সুযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
১৯ নভেম্বর উৎসবের উদ্বোধনী পর্বে দেওয়া নয়নতারা সেহগালের বক্তব্যটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন প্রতীক বর্ধন
আরও পড়ুন: