আত্মবিশ্লেষণ ও ব্যক্তিসত্তার পর্যালোচনা

৯ ডিসেম্বর ছিল বেগম রোকেয়া দিবস। এ দিনটি স্মরণ করে এই সময়ে রোকেয়ার প্রাসঙ্গিকতা ও বর্তমান সমাজে নারীর অবস্থানের স্বরূপ খুঁজেছেন এক তরুণ কথাশিল্পী

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (৯ ডিসেম্বর ১৮৮০—৯ ডিসেম্বর ১৯৩২), অলংকরণ: মাসুক হেলাল
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (৯ ডিসেম্বর ১৮৮০—৯ ডিসেম্বর ১৯৩২), অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে স্মরণ করার পেছনের ইতিহাস কারও অজানা নয়। কিন্তু সেই জানা আর তাঁর কর্মভাবনাকে বুঝতে পারার মধ্যে পার্থক্য থেকে যাবে, যদি আজও আমরা শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য কেবল স্তবক বাক্য উচ্চারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকি। আত্মপর্যালোচনায় না যাই। আমরা কেবল বলতে থাকি যে, তিনি নারীশিক্ষার অগ্রদূত, তিনি তখন এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন, তিনি সুলতানার স্বপ্ন, অবরোধবাসিনী, পদ্মরাগ বা মতিচূর-এর মতো বই লিখেছেন; তবে তা পুরোনো কথার পুনরাবৃত্তিই হবে। বরং একুশ শতকে নিজেদের অবস্থান থেকে নির্ধারণ করতে হবে রোকেয়াকে; এবং তা সময় ও বিশ্ব প্রেক্ষাপটের সাপেক্ষে। পশ্চিমা বিশ্বের ‘নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব আন্দোলন’ সমন্বিত একটি ধারা হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে প্রকাশ পায়। যে আন্দোলনের প্রথম তীর হিসেবে ধরা হয়ে থাকে ভার্জিনিয়া উল্ফের আ রুম অব ওয়ানস্ ওউন বইটি, যা ১৯২৯ সালে প্রকাশিত। অথচ তার অনেক আগে এরূপ ভাবাদর্শে তৃতীয় বিশ্বের রোকেয়া লিখে ফেলেছেন সুলতানার স্বপ্ন, যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৮ সালে। অতএব আজ আমাদের ভেবে দেখতে হবে তারপর আমরা কী করছি? নিজেদের অবস্থানটিকে কোথায় নিতে পেরেছি? সে ক্ষেত্রে প্রথমেই নিজের কাছে যে বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার তা হলো আমাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সম্পর্কে আমরা নিজেরা সচেতন কি না। মনে রাখা প্রয়োজন, সমাজ হচ্ছে পারিপার্শ্বিক প্রতিটি ব্যক্তিসত্তার সমষ্টিগত অবস্থানের দ্বারা সৃষ্ট। যখন এই ধারণার স্বচ্ছতা নিজের কাছে স্পষ্ট হবে, তখন প্রকৃত অর্থেই রোকেয়া নামের প্রতীকটির প্রতি যথার্থ মূল্যায়ন সম্ভব।
১৯৯৩ সালে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ‘ইতিহাসের ইঙ্গিত: বেগম রোকেয়া’ প্রবন্ধটি যে প্রশ্ন রেখে শেষ করেছিলেন তা হলো, ‘বেগম রোকেয়ার সারা জীবনের সাধনা পুরোপুরি বিফলে গেল কি?’ আমরা যদি এখনো ভাবি, দীর্ঘ এতটা বছরের বিরূপ পুরুষতান্ত্রিকতার তত্ত্বীয় ট্যাবুর বিপক্ষে বিজয় সম্ভব? তাহলে তা হবে ভুল ধারণা। অবশ্যই তা নিজেকে পেছনে টেনে নেওয়ার শামিল। এই ট্যাবু তো কবেই ভাঙা হয়েছে। এখন কেবল সামগ্রিক প্রতিযোগিতায় নিজেকে নানা লক্ষ্যের দিকে ছুটিয়ে নেওয়ার পালা। নিজের ব্যক্তিসত্তাকে প্রথমে নিজে সম্মান দিতে পারাটাই আসল। কিন্তু এখনো সেই আত্মসম্মান ও মানসিক শক্তির সর্বজনীনতা নারীদের মধ্যে কম। তাই অনেকে হয়তো বুঝতেও পারছেন না যে তাঁরা সেই জালে আবদ্ধই আছেন। আজকের দিনে নারীরা শিক্ষিত হচ্ছেন এবং নানা পেশায় প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন। আপনাকে শিক্ষিত হতে সমাজ আর বাধা দিতে পারচ্ছে না, যা রোকেয়ার সমকালে পেরেছিল। পেশাগতভাবে আপনি একটি ‘আইডেনটিটি’ বা পরিচয় পাচ্ছেন, যা পরিবার ও সমাজ দেখছে অর্থনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির জায়গা থেকে। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে, আসলে আপনি কী চাইছেন? সেভাবে আপনি কাজ করতে পারছেন কি না? নাকি সমাজ আপনাকে রেখে দিচ্ছে—এই অবস্থানে থেকে তুমি যেটুকু পেয়েছ তা-ই অনেক—এই বৃত্তে? অর্থাৎ বর্তমানে নতুন এক সংস্কৃতির প্রচলন ঘটেছে: আপনার মতামত নেওয়া হচ্ছে। আপনি স্বাধীনচেতা হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছেন কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তা আর আপনার ইচ্ছায় থাকছে না। এ প্রসঙ্গে নোয়াম চমস্কির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি তাঁর ‘ম্যানুফ্যাকচারি কনস্যান্ট’ তত্ত্বে মানুষের সমর্থন বা সম্মতি প্রকাশ প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা করেছেন। এখান থেকে এটিও স্পষ্ট বোঝা যায় যে এই সম্মতি আসলে একটা ‘সিস্টেম’ বা পদ্ধতির ফলস্বরূপ স্বতঃসিদ্ধ হয়ে ওঠে এবং মূলত তা কোনো স্বতঃস্ফূর্ততার তোয়াক্কা না করা এক আরোপিত সম্মতিরই বহিঃপ্রকাশ। আর এ বিষয়টিই ঘটছে যে, এখনো মেয়েদের সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করা হচ্ছে না।
যদি আপনি মনে করেন যে এটা ঠিক আছে তবে তা-ই হতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে আপনি আজ রোকেয়ার অবদানের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে যা বোঝাতে চাইছেন, তা আসলে অন্তঃসারশূন্য এক বুলি হয়ে থাকছে মাত্র। রোকেয়া অনেক আগেই সমাজের এ অবস্থানটিকে ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন। শুধু তিনি একা নন, পরবর্তী সময়ের আরও অনেকেই ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ঘটিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে দেশের এমন এক নারীর কথা বলতে চাই, যিনি নারীমুক্তির ভাবনা শুধু নয়, সামগ্রিক মুক্তির ভাবনায় জীবনকে দেখেছিলেন; এবং নারীমুক্তি এখন বিচ্ছিন্ন কোনো ভাবনা হতে পারে না, তা সামগ্রিক ভাবনারই অংশ—আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এমনই ব্যক্তিসত্তার স্বাধীন বুদ্ধিজীবিতার সাক্ষ্য রেখেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, তাঁর সামাজিক ও কর্মময় জীবনে। তাঁর বিবাহিত জীবন স্বস্তির ছিল না। প্রখর আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন সেলিনা পারভীন বিবাহিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে সন্তানকে নিয়ে নতুন সংগ্রামী জীবন শুরু করেন। অন্য রকম ব্যক্তিসত্তার পরিচায়ক হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর সম্পাদিত শিলালিপি পত্রিকায় লিখেছেন দেশবরেণ্য সব লেখক-সাহিত্যিক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শিলালিপি প্রকাশিত হয়, যার প্রচ্ছদে ছিল বাংলাদেশের পতাকা। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে থাকা ও মুক্তচিন্তার চর্চার জন্য সেলিনা পারভীন এ দেশের আলবদর-রাজাকার বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে শহীদ হন। কিন্তু আজকের আমরা রোকেয়া বা শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীনের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের অর্জন বলতে কী দেখতে পাচ্ছি? তাঁরা দুজনই তাঁদের ভেতরের মানসকে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন।
এখনো এ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গেলে স্বামী কর্তৃক চোখের আলো হারান! নিজ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো লিঙ্গভিত্তিক বাধা থাকতে পারে না। কারণ, একজন পুরুষ ও একজন নারী পরস্পর স্ব স্ব ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ঘটাবে—এটাই স্বাভাবিক। নারী ও পুরুষের কাঠামোগত ভিন্নতা আধিপত্য বিস্তারের কোনো নিয়ামক হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে লেখক সিমন দ্য বোভোয়ার কিছু কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি দেখেছেন সমাজতন্ত্রেও নারী-পুরুষ সমতা পায়নি। তাঁর মতে, আমরা শুধু ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়ব; তবে পাশাপাশি পুরুষের বিরুদ্ধেও লড়াই করা প্রয়োজন, কেননা পুরুষ এই ব্যবস্থার সহযোগী ও সুবিধাভোগী।
আপনাকে স্মরণ রাখতে হবে সব পুরুষ কাঠামোগতভাবে সমান পেশিশক্তির অধিকারী নয়, তেমনি সব নারীর ক্ষেত্রেও বিষয়টি সত্যি। পৃথিবী মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে বৈপ্লবিক সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু আমাদের বর্তমান সময়ের প্রধান প্রতিবন্ধকতা মূলত দুটি। প্রথমত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার ও সম্পত্তির ওপর অধিকার অর্জন। সামগ্রিকভাবে সমাজ থেকে বৈষম্য, নানা সামাজিক অনাচার অনেকাংশেই কমে যাবে যদি এই অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠা পায়। আমরা তো অনেক আগেই জেনেছি কেন নারীরা ‘শেক্সপিয়র’ লিখতে পারে না। আপনি কেন পরিবার থেকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার সমানভাবে পাবেন না?—এ কথা আজ ভেবে দেখা জরুরি। নিজেকে ভোগের ও উৎপাদনের সমার্থক হিসেবে না দেখে বরং ভোক্তার অধিকার অর্জনের জায়গা থেকে দেখতে হবে। কারণ, এসব কিছুই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সাম্রাজ্যিক প্রভাবের ফলে সৃষ্ট। অতএব, এ অবস্থান থেকে উত্তরণ চাইলে নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ঘটাতে হবে। মানসিকভাবে নিজেকে অধীনস্থতার মোহ থেকে বের করে প্রাপ্য স্বাধীন ব্যক্তিসত্তার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে যে অর্জনগুলো জরুরি তা হলো, শুধু মতামত প্রদানে সীমাবদ্ধ না থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা অর্জন করা এবং সম্পদের সম-অধিকারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। এই মনোভঙ্গি একুশ শতকের সব নারী ও পুরুষের মুখ্য বিষয় হওয়া উচিত, তা না হলে নিজেদের আধুনিকতার বিকাশে সম্পৃক্ত করা সম্ভব নয়। নারীর অর্থনৈতিক আর ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশই পারবে যুক্তিসংগত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থানকে উন্নত করতে। এখন যদি আমরা সময়কে দোষারোপ করি, ভাবি, মুক্তচিন্তার দ্বারকেই যেখানে আঘাত করা হচ্ছে সেখানে আর কী করব; তাহলে মনে রাখতে হবে, সময় সব সময় খারাপই থাকে—এই ব্যাখ্যা একটা আপেক্ষিক ধারণা, তাকে নিজের উপযুক্ত করাই হচ্ছে আপনার পরিচয়। নিজেকে উপলব্ধি না করতে পারলে নাহয় বেগম রোকেয়া থেকেই পড়ে নেবেন। তিনি তাঁর প্রবন্ধ ‘আমাদের অবনতি’তে সে-ই এক শ বছর আগেই লিখেছেন, ‘শিশুকে মাতা বলপূর্বক ঘুম পাড়াইতে বসিলে ঘুম না পাওয়ায় শিশু যখন মাথা তুলিয়া ইতস্ততঃ দেখে, তখনই মাতা বলেন, “ঘুমা শিগ্গীর ঘুমা। ওই দেখ জুজু।”’
রোকেয়া ৪৭টি অবরোধ-সম্পর্কিত দুর্ঘটনার কাহিনি অতুলনীয় শ্লেষভরে শিল্পিত উপস্থাপন করে গেছেন অবরোধবাসিনী বইয়ে। আর আমাদের এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা নিশ্চয়ই সামনের দিকে যাওয়ার জন্যই পা বাড়িয়ে দেব, পেছনে নয়।
অতএব মুক্তভাবে চিন্তা করুন। জুজুর ভয়ে শিশুদের মতো ঘুমিয়ে যাবেন না।