'মনের ভেতরে আমি নিঃসঙ্গ ও যাযাবর'

সৈয়দ শামসুল হক। ছবি: খালেদ সরকার
সৈয়দ শামসুল হক। ছবি: খালেদ সরকার
৮০তম জন্মবার্ষিকী সামনে রেখে তাঁর লেখার জগৎ, সমকালীন সাহিত্য ও নিজের জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়েছেন সৈয়দ শামসুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পারভেজ হোসেন

পারভেজ হোসেন: আর কদিন পরেই ৮০ বছর পূর্ণ করে ৮১–তে পা রাখছেন আপনি। গোটা জীবনটাই শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন অকল্পনীয় নিষ্ঠা নিয়ে। নিজের জীবনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

সৈয়দ শামসুল হক: ‘অকল্পনীয়’ শব্দিট কেন? সবটাই তো কল্পনার ভেতরে। কল্পনাই আসল কথা। আর দীর্ঘ জীবন? আমি দীর্ঘ মনে করি না। কারণ, আমাদের সামনে লালন ১১৬ বছর বেঁচে ছিলেন। সেখানে পৌঁছুতে এখনো আমার ৩৬ বছর বাকি। আমি মনে করি যে, শিল্প-সৃজনের ক্ষেত্রে যাঁরা আছেন, তাঁদের একটা ট্র্যাজেডি হচ্ছে, যখন কাজ করতে করতে হাতটা এসে যায়, আরও ভালো করার একটি দক্ষতা পেয়ে যান লেখক, ঠিক সেই সময়টিতেই তাঁর চলে যাওয়ার সময় হয়। রবীন্দ্রনাথের কথা ধরা যাক। তাঁর জীবনের শেষ কবিতা: ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে,/ হে ছলনাময়ী।’ আমি এই ‘ছলনাময়ী’ শব্দটি তাঁকে এর আগে ব্যবহার করতে দেখিনি। মনে হচ্ছিল, তিনি একটি নতুন দিকে তাঁর দৃষ্টি ফিরিয়েছেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই তিনি প্রয়াত হলেন আর আমরা বঞ্চিত হলাম। এই সব যখন ভাবি, তখন এ ভাবনাও আসে যে, এই জীবনে যা কিছু করেছি, আমার নিজের কাছে কখনোই সেগুলো খুব তৃপ্তি বা স্বস্তি আনেনি। মনে হয়েছে আরও ভালো করে, আরও মর্মস্পর্শীভাবে আমার কথাগুলো হয়তো বলা যেত। বিভিন্ন মাধ্যমে কথা বলার চেষ্টা করেছি আমি—কখনো কবিতায়, গল্পে, কখনোবা উপন্যাসে, নাটকে, প্রবন্ধে; এবং যা কিছুই করি না কেন, ভাষার ভেতরেই আমি থাকতে চেয়েছি। আমার কাছে এই মাধ্যমগুলো মোটেই আলাদা নয়। সবগুলোর মূলে আমার হাতে একটিই অস্ত্র—ভাষা। আমার মনে হয়, কেউই তার শ্রেষ্ঠ লেখাটি লিখে যেতে পারে না। শেক্সপিয়ার পারেননি, কালিদাস, তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথও না। তার কারণ হচ্ছে, হাত যতই দক্ষ হোক, আমরা যা কল্পনা করি, শেষ পর্যন্ত তার একটা ছায়াতেই মাত্র সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিংবা পাঠকের সামনে ওই ছায়াটুকুই তুলে ধরতে হয়!
ছবি আঁকার সময় একবার পাবলো পিকাসোকে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, আচ্ছা, এই যে ছবিটা আপনি আঁকছেন, আমার কাছে তো মনে হচ্ছে আঁকা শেষ। তারপরও আপনি তুলি দিয়ে কী করছেন? পিকাসো বললেন, আমি জানি না কী করছি! তবে আমার মনে হচ্ছে, আমার করোটির ভেতরে যে ছবি আছে, সেটা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি এবং সম্পূর্ণ কখনোই হয় না। একসময় ক্রুদ্ধ কিংবা হতাশ হয়ে, কিংবা একেবারেই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে বলি, দ্যাটস ইট! এই রইল!
পারভেজ: লেখালেখির তাড়নাটি কীভাবে পেয়েছিলেন? আপনার পরিবারে কি লেখাজোখার কোনো আবহাওয়া ছিল?
সৈয়দ হক: সৃজনশীল সাহিত্যে ছিল না। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হোসাইন হোমিও ডাক্তার ছিলেন। তিনি বৃহৎ বাংলার তত্কালীন প্রথম মুসলিম, যিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিত্সা পদ্ধতি সম্পর্কে সাতখানি বই লিখেছিলেন। তাঁর প্রথম বই বের হয় আমার জন্মের এক বছর আগে। তারপর আমার চার বছর বয়সে বের হয় তাঁর দ্বিতীয় বই। এরপর অন্য বইগুলো বের হয়। বাবা সারা দিন ডাক্তারি করতেন; হোমিও কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন—পড়াতেন। খুব ব্যস্ত সময়। উনি বই লিখতেন রাতের বেলায়। আমি বাবার সঙ্গেই ঘুমাতাম। কোনো কোনো রাতে ঘুম থেকে উঠে দেখছি, বিছানার পাশেই যে টেবিল, সেখানে লন্ঠনের আলোয় লিখে চলেছেন বাবা। হয়তো এই ছবিটা কোনোভাবে আমার ভেতরে কাজ করে থাকতে পারে। আর আমার বাবার বা আমার বাবার পরিবারে, কিংবা আমাদের বাড়িতে মাত্র দুটিই সাহিত্যের বই ছিল। একটি নজিবর রহমানের আনোয়ারা উপন্যাস। আরেকটি কবি কায়কোবাদের কাব্যগ্রন্থ অমিয়ধারা। এই দুটো বইয়ের বাইরে ছিল বাংলা কোরআন শরিফ ও বাংলা বাইবেল। বলতে গেলে এই চারটি বই-ই আমি আমার সাত-আট বছর বয়স থেকে নেড়েচেড়ে দেখছি। কিছু কিছু পড়ছি। এটা আমার বারো বছর বয়স পর্যন্ত—সবটা মিলিয়ে মনে হলো, এই কাজটাই আমি করব, আমি নিজে লিখব। এই ধারণাটি আমার ভেতরে এতটাই বদ্ধমূল হলো যে আমি আর কিছুই হতে চাইলাম না। এখন পর্যন্ত আর কোনো কিছুই আমাকে আকর্ষণ করেনি। যদি দ্বিতীয়বার জন্ম নিতে হয়, তাহলে আমি বলব, আমি যেন এই বাংলা ভাষারই লেখক হই।
পারভেজ: ১৯৫৪ তে আপনার ছোটগল্পের বই তাস এবং বিখ্যাত বড় গল্পের বই রক্তগোলাপ বেরিয়েছে। এরপর দীর্ঘ চার বছরের বিরতি দিয়ে ১৯৫৯-এ আবার হাজির হলেন একসঙ্গে গল্প, কবিতা আর উপন্যাস নিয়ে। এ রকম আরেকটি দীর্ঘ বিরতি দেখতে পাই ১৯৬২ তে উপন্যাস অনুপম দিন বেরোনোর পর থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত আনন্দের মৃত্যু গল্পগ্রন্থ বের হওয়া অবধি। এই বিরতির পেছনে কোনো কারণ ছিল কি?
সৈয়দ হক: এই যে ফাঁক গেছে চার বছরের, এটা ভালোই আবিষ্কার করেছ। হিসাব করে নয় ঠিক। তবে সময়টা লক্ষ করো, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলেন, সেই থেকে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত একটা ভীষণ নাটকীয় সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছি। সে সময়ে এটি আমাদের তরুণ মনের ওপরে নিশ্চয়ই কোনো না কোনোভাবে প্রভাব ফেলেছে। সেই ভাঙচুরের সময়, বাঙালির সেই আত্ম-আবিষ্কারের সময়, বাঙালির স্বাধিকারচেতনা আর পাকিস্তান যে একটি ভুয়া রাষ্ট্র—এই চেতনা নানানভাবে আমাদের মধ্যে কাজ করেছে। আমরা ওর ভেতরেই মেতে ছিলাম।
পারভেজ: আপনার লেখালেখি নানা দিকে বিস্তৃত—কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, কাব্যনাটক, গান; এমনকি সিনেমা পর্যন্ত করতে গিয়েছেন আপনি; ছবি আঁকেন, শিশুসাহিত্য করেছেন। একই সঙ্গে সবকিছুতে আপনি নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করছেন। সবটাই কি পরিকল্পিত?
সৈয়দ হক: লেখা কী করে নতুন হয় বলো তো? সেটি হচ্ছে, এই যা দেখছি, এমন দেখাটা আমি আর কারও লেখায় পাইনি। যদি পেতাম, তাহলে আমার আর লেখার দরকার পড়ত না। যখন মনে হয়, আমি যেভাবে ভাবছি, দেখছি, ঠিক এ রকমটি আমার পঠন-পাঠনের ভেতরে আর কখনো পাইনি, তখনই লিখি। একজন লেখককে কিন্তু অবিরাম পড়তে হয়, জানতে হয়—কী হচ্ছে তার সমসময়ে কিংবা তার আগেও। এবং এই লেখার ক্ষেত্রে পুরোনো কথা নতুন করে বলতে হয়। এখানেই আঙ্গিকের ব্যাপারটি চলে আসে—ঠিক এইভাবে কেউ বলেননি, এই রকম করে কেউ দেখেননি। আরেকটি ঐতিহাসিক ব্যাপার আছে—আমার ষোলো বছর বয়স থেকেই বিষয়টি অনুভব করেছি—নিজেকে আমি বায়ান্নর সন্তান বলি। সেই সময়ে আমাদের এখানে সাহিত্যিক রুচি ও সৃজন সব দিক থেকেই মধ্যযুগীয় পর্যায়ে ছিল। আধুনিকতার সঙ্গে, সমসাময়িকতার সঙ্গে যুক্ত করার একটি কাজ কিন্তু আমাদের মতো কোমল প্রায়-যুবকদের কাঁধে এসে পড়েছিল। পঞ্চাশের দশকে শুধু আমি একা নই, আমাদের অনেককেই চেষ্টা করতে হয়েছে যে আধুনিক চেতনা, রুচি ও সমসাময়িকতা যেন আমাদের সাহিত্যে পাওয়া যায়। আর এটি করতে গিয়ে আমি যেটি করেছি—জানালার পর জানালা খুলে দিতে চেয়েছি—কবিতায়, গল্পে, নাটকে। কবিতা-গল্প-নাটক—যা-ই লিখি না কেন, সব সময় আমি ভাষাশিল্পী হতে চেয়েছি। এই যে নিরীক্ষার কথা বলা হলো, মনে রাখতে হবে, যে সময়ে আমরা শুরু করেছি, সে সময়ে জানালার পর জানালা খুলে দেওয়া, বিভিন্ন মাধ্যমে বিচরণের প্রয়োজন ছিল। আমার গল্পে নগরজীবন যেভাবে এসেছে, এর আগে কারও গল্পেই সেটি পাই না। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, গল্পে আমি একটা কালেক্টিভ ভয়েস আনার চেষ্টা করেছি। আমরা গেলাম, আমরা দেখলাম, আমরা ঘুরলাম—এটাকে আমি অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। প্রবন্ধের মতো বুনটসম্পন্ন গল্প লিখেছি। এখন আমি আবার গল্প লেখার দিকে মন ফিরিয়েছি—গল্প নেই, কিন্তু গল্প। অর্থাৎ ওটি পড়ার পর পাঠকের মনে হবে যে, এই সূত্রে আমি নিজেই নির্মাণ করতে পারি নিজের ভেতরে গল্প। এমন নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি, এখনো করছি।
পারভেজ: বাংলাদেশের সমসাময়িক সাহিত্যের খুব ভালো পাঠকও আপনি। কী বলবেন এখনকার তরুণদের কবিতা ও কথাসাহিত্য নিয়ে?
সৈয়দ হক: তরুণদের কবিতায় প্রচুর প্রাণশক্তি দেখি, নতুন করে বলার চেষ্টাও লক্ষ করি; কিন্তু অধিকাংশ কবিতাই মনে হয় অসমাপ্ত বা অতিকথিত। আবার ছন্দ সম্পর্কে যেটা দেখি, এখন যাঁরা লিখছেন, যেন হাতের কাছে যেটা পাচ্ছেন সেই ছন্দেই কাজ করে যাচ্ছেন। কথা হলো, একটা ছন্দ কিন্তু কবির নিজস্ব হয়ে যায়, তার নিজস্ব ভঙ্গি থেকেই। একই পয়ারে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, জীবনানন্দও লিখেছেন। দুটোকে এখন যদি আমি পাশাপাশি রেখে আবৃত্তি করি, বোঝা যাবে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের। এই যে ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নতুনভাবে ব্যবহার করা—এগুলো একেবারেই দেখতে পাই না এখনকার তরুণদের কবিতায়। শুধু যেটি আমার কাছে প্রশংসনীয় মনে হয়, লিখে চলেছেন অনেকেই। ভীষণ একটা আকুতি রয়েছে যে, নিজেকে আমি প্রকাশ করব। কিন্তু সেই আকুতির সঙ্গে প্রায়োগিক দিকটাও তো আসতে হবে। নতুন কথা বলার কিছু নেই, আবার আঙ্গিক যদি আয়ত্তে না থাকে, তাহলে ওই পুরোনো কথা পুরোনো চালেই পড়ে থাকবে।
আর কথাসাহিত্যের বিষয়ে যদি বলি, আজকাল দেখি প্রকল্প উপন্যাস লেখা শুরু হয়েছে। যেমন আজ আমি পটুয়াদের ওপরে লিখব, তাঁতিদের জীবন নিয়ে লিখব, ছিটমহল নিয়ে লিখব—এভাবে হয় না! এটা আমার একেবারেই পছন্দ নয়। সাহিত্যের প্রধান যেটি কাজ, তা হচ্ছে ব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে ভাষায় ধরে রাখা। গল্প-উপন্যাসের ব্যাপারে একটি জিনিস বোধ হয় মাথায় রাখা ভালো যে, শুধু গল্প বলে যাওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়। মানুষের অন্তর্গত যে মানচিত্র আছে, সেটির খুব অভাব দেখি এখনকার কথাসাহিত্যে।
তবে তরুণ লিখিয়েদের যে ব্যাপারটি আমার ভালো লাগে, আগেও বলেছি, প্রচুর প্রাণশক্তি দেখতে পাই এদের ভেতরে। লক্ষ করি, তারা নিজের কথাকে, ভেতরের কথাকে নিজের মতো করে বলার জন্য পথ খুঁজছে। এই সন্ধানটি আমাকে খুব মুগ্ধ করে; এবং এই সন্ধান আমিও গোড়া থেকে নিজের ভেতরে ধরে রেখেছি। তবে একই সঙ্গে আরও একটি বিষয় লক্ষ করার মতো, তরুণদের চর্চার অভাব, লেগে থাকার অভাব। সাহিত্য কিন্তু খণ্ডকালীন বা অবসরের কাজ নয়। সবকিছু এর ভেতরে নিবেদন করতে হবে—সময়, শারীরিক পরিশ্রম। বিছানা থেকে লেখার টেবিল—আমার মতে, এটা হচ্ছে পৃথিবীর দুরূহতম যাত্রা! মানে আমি একটু আরাম করব, ঘুমাব, আসরে বসব, নাকি লেখার টেবিলে যাব, দিস ইজ দ্য মোস্ট ডিফিকাল্ট জার্নি। যেটাকে আমি বলি স্ট্রং টেক্সট, এখন চারদিকে যা লেখা হচ্ছে সেখানে আমি এই জিনিসটার খুব অভাব দেখছি। তরুণেরা নানা রকম গিমিক, চমক দেওয়া লেখার দিকে ধাবিত হচ্ছে; নাটকের বেলায়ও তাই—স্ট্রং টেক্সটটা যেন অবহেলিতই থাকছে।
পারভেজ: শিল্প সৃষ্টির বিচিত্র মাধ্যমে আপনার বিচরণ। আমরা আপনাকে ভালোবেসে বলি ‘সব্যসাচী লেখক’। আপনি কি মনে করেন, এই উপাধি আপনাকে পুরোপুরিভাবে ধরতে পারে?
সৈয়দ হক: হা হা হা। আমার তো কোনো দায় নেই এতে। আমি নিজে কখনো নিজেকে সব্যসাচী বলিনি। আবার যাঁরা বলেন তাঁরা হয়তো এটা ভেবে বলেন যে, অনেক রকম লেখা লিখি, দুহাতে লিখি। দুহাতে যুদ্ধ করে যে তাকে সব্যসাচী বলে। হয়তো সেই অর্থেই আমাকে সবাই ‘সব্যসাচী লেখক’ বলে। এতে খুব একটা কিছু আসে যায় না।
পারভেজ: জীবনের এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে এখন যদি ফেলে আসা জীবনের দিকে ফিরে তাকান, কী উপলব্ধি হয় আপনার?
সৈয়দ হক: একটিই উপলব্ধি। সেটি হচ্ছে বেঁচে থাকাটা খুব ভালো ছিল। তার চেয়ে আরও ভালো ছিল এই বেঁচে থাকা সম্পর্কে কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে কিছু বলার চেষ্টা করা। এই চেষ্টা এখন পর্যন্ত করে যাচ্ছি। কারণ, শেষ পর্যন্ত আমার লেখা যদি কিছু হয়, সে দু-পঙ্ক্তিই হোক, কি দু-পৃষ্ঠাই হোক, সেটিই সত্য। সেটিই থাকবে। ‘উপলব্ধি’র মতো এত গুরুতর শব্দ আমি ব্যবহার করব না। বলব, আমি ঠিক কীভাবে নিজেকে দেখছি। আমি দেখছি, মনের ভেতরে আমি নিঃসঙ্গ ও যাযাবর—বাইরে থেকে আমাকে যতই গোছালো মনে হোক। আশি বছর—এটা তো কম সময় নয়! আমার জন্মের পরেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, তার পরে দেশভাগ, ইংরেজ চলে গেল, ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনককে হত্যা, এরপর গণতন্ত্র বিলুপ্ত হলো, সেই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হলো—ঘটনার পর ঘটনা! আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় চারজন জেনারেল তাঁদের বুটের তলায় নিয়ে গেছেন। এগুলো বিচার করে যখন দেখি যে, এখনো পায়ের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি, এখনো ঘাসের ওপরে আছি, তখন ভাগ্যদাতাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। সবার কাছে এই শুভেচ্ছাটুকু চাই, যেন আর কিছুদিন থেকে যেতে পারি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীটা যেন পালন করে যেতে পারি; এবং আর কিছু না হোক, লালনের মতো যেন দীর্ঘ একটি জীবন পাই।