দেশসেরা জগৎসেরা শিল্পীকথা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল
পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন : বই বই গন্ধ চারদিকে। শুরু হয়েছে বইমেলা। মাসব্যাপী এই বইয়ের উৎসবে প্রকাশিত হচ্ছে বিচিত্র বিষয়ের অসংখ্য নতুন বই। সেসবের মধ্য থেকে নির্বাচিত দুইটি বইয়ের পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ নিয়ে এ আয়োজন।

কাইয়ুম চৌধুরী কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী

রফিকুন নবী
রফিকুন নবী

শিল্পকলাজগতের কর্মচঞ্চল, সদা হাস্যোজ্জ্বল, নিষ্ঠাবান, রুচিশীল, সমাজের প্রায় সব স্তরের মানুষের প্রিয় ও বুদ্ধিদীপ্ত এই ব্যক্তিত্ব আচমকা হারিয়ে গেলেন। সবাইকে শোকসন্তপ্ত করে, বিমূঢ় আর বিস্মিত করে বিদায় নিলেন জগৎ-সংসার থেকে। তিনি শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। আমরা শুধু একজন পরিশীলিত দক্ষ সৃষ্টিশীল শিল্পীকে হারালাম, তা-ই নয়, একজন অভিভাবককেও হারালাম।
কাইয়ুম চৌধুরী, যিনি বিদগ্ধ মহলে ‘কাইয়ুম ভাই’ নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন, মনেপ্রাণে এই পরিচিতিটাকেই পছন্দ করতেন, তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো, তা পূরণ হওয়ার নয়। তিনি যে শুধু খ্যাতিমান বরেণ্য শিল্পী বা শিল্পকলাজগতের একজন অপরিহার্য সদস্য ছিলেন, তা তো নয়, দেশের পুস্তক প্রকাশনা জগতের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল নিবিড়। পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনসহ বহু সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেল। এখন শুধু থেকে গেল তাঁর কীর্তি আর স্মৃতির জগৎ।
তাঁর সান্নিধ্যে যাঁদের যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে আমিও একজন। শুধু সান্নিধ্যই নয়, তাঁর সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আর গর্বিত হওয়ার মতো একটা অবস্থান ছিল আমার। শিল্পকলাবিষয়ক কর্মকাণ্ডে, একত্রে দেশ-বিদেশ ভ্রমণে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহকর্মী হওয়ার সুবাদে, বই-পুস্তক-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সংগীত ইত্যাদি বহুবিধ ক্ষেত্রে বিচরণের কারণে তাঁর কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ ঘটেছে সেই ষাটের দশকের শুরু থেকে। এসব কারণে শুধু ঘনিষ্ঠতা নয়, স্নেহধন্য একজন শিল্পী হওয়ার গৌরবও অর্জন করতে পেরেছিলাম।
তাঁর স্বভাবে এমন একধরনের আনন্দ-উদ্রেককর আকর্ষণ ছিল যে সবাইকে অভিভূত করে সহজেই তিনি কাছে টেনে নিতে পারতেন। আমিও ছিলাম তাঁর তেমনই একজন গুণগ্রাহী। তবে তাঁর এই আকর্ষক স্বভাবই যে মুখ্য ছিল, তা নয়, আমি ভক্ত হয়েছি তাঁর নিজস্বতায়, তাঁর আঁকার ধরন, ছবির জগৎ নিয়ে তাঁর একান্ত আপন ভাবনা ও দেশের লোকশিল্পের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসার টানে। সেই সঙ্গে শিল্পের প্রকরণটিকে উচ্চাসনে আসীন করার প্রয়াসে তাঁর অনেক অনেক দিককে মনেপ্রাণে ধারণ করতে দেখে।
দেশাত্মবোধ ছিল তাঁর অনবরত সৃষ্টিশীল কাজে নিয়োজিত থাকার প্রধান উৎস ও প্রেরণা। তাঁর সঙ্গে বহু দেশ ভ্রমণ করেছি। কিন্তু অত সব দেখার পরও নিজের দেশকে, দেশের মানুষকে, দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে অতুলনীয় বলে সবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরতেন। এ ব্যাপারে তিনি পূর্বসূরি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অনুসারী ছিলেন। তাঁর প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। বলতে তিনি দ্বিধা করতেন না যে ছবি আঁকা শেখানোর পাশাপাশি দেশকে, দেশের সৌন্দর্যকে দেখার চোখ তৈরি করে দিয়ে গেছেন আবেদিন স্যার। তবে আমি দেখেছি বা উপলব্ধি করেছি যে তিনি তাঁর চিত্রকলায় দেশকে উপস্থিত করেছেন আরও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির ধারাবাহী হয়ে।
এই আধুনিক চোখের অবলোকনটি ছিল তাঁর একান্তই নিজস্ব উদ্ভাবন। চেনা বিষয়কে আপন আঙ্গিকে রূপান্তরিত করে তিনি সাজাতেন এমন রসোত্তীর্ণতার মিশেলে যে তাতে লোকজ মোটিফ, বাস্তব আকার-আকৃতি, রং, স্পেস, রেখায় অনন্য এক বৈশিষ্ট্যের চিত্রভাষা তৈরি হতো। এবং তিনি তা করতে পারতেন অবলীলায়, অকপটে, সহজিয়া ঢঙে। মূলত রং ও বলিষ্ঠ ড্রয়িংকেই তিনি প্রাধান্য দিতেন। তবে এভাবে অসাধারণ দক্ষতায় নিত্যনতুন চিত্রমালা রচনা করার পরও সহজে তৃপ্ত হতেন না। বলতেন, ‘দূর, হইতাছে না। যা করতে চাই তা আসল না।’ শেষ দিকে এসে আক্ষেপ করে বলতেন, ‘সারা জীবন কম তো কাজ করলাম না। করতেই আছি। কিন্তু যা করতে চাই, তা তো হইতাছে না। সময় তো শেষ হইয়া আসতাছে।’
আমরা জানি এবং দেখেওছি যে কয়েক বছর ধরে তিনি লোকজ নকশার ফর্মকে ভেঙে ডিটেইলসের মাত্রাতিরিক্ততাকে পরিহার করে, অঢেল স্পেসের বিস্তৃতিতে বিন্যস্ত করে চওড়া তুলির কাজে মনোযোগী হয়েছেন। পর্যায়টি নিরীক্ষাধর্মিতার। বলতেন, ‘একটু হাত খুইলা কাজ করি। দেখি কী হয়, কেমন দাঁড়ায়।’ কখনো কখনো কাজটা কেমন হলো তা জানার জন্য জিগ্যেসও করতেন। বলতেন, ‘সিনসিয়ারলি বলবা কিন্তু। মনে হয় জমল না। মনে হয় শেষ হইল না। আরও একটু কাজ করলে মনে হয় শেষ হইত!’
তাঁর কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলাম, ‘ফার্স্ট থট ইজ অলওয়েলজ দ্য বেস্ট—এই প্রচলিত কথায় বিশ্বাস করলে তো মনে হয় এই স্টেজে শেষ ভাবাই যায়। আমার তো ধারণা, খুব সুন্দরভাবে শেষ হইছে।’
তিনি ছবিটার কাজ ছেড়ে দিয়েও আবার কিছুক্ষণ পর টেনে এনে বলেছিলেন, ‘এই জায়গায় আর একটু কাজ বাকি। করি একটু।’
এই অতৃপ্তির সঙ্গে মিল খুঁজে পাই তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যুরও। তিনি বেঙ্গল আয়োজিত উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে সেদিন প্রধান বক্তা ছিলেন। নির্ধারিত সময়ে চমৎকার বক্তব্য শেষ করে নিজের আসনে বসে আবার অনুমতি নিয়ে ফিরে এসে মাইক হাতে নিয়ে বলেন, ‘আর একটি বলা...।’ তিনি কী কথা বলতে চেয়েও আর শেষ করতে পারেননি। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। ছবির মতোই বক্তৃতার বেলায়ও যেন অতৃপ্তিই বোধ করেছিলেন।
জীবনাচারে অত্যন্ত শৌখিন ছিলেন। রুচিশীল পোশাক-আশাক পরতে পছন্দ করতেন। শুদ্ধ সংগীত শোনা ছিল তাঁর নিত্যদিনের অভ্যাস। এসব সংগ্রহ করার পাশাপাশি সাহিত্য ও ভালো চলচ্চিত্রের প্রতিও ছিল তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ। ফলে সেসবেরও ছিল তাঁর অবিশ্বাস্য সংগ্রহ। কবিতা পড়তেন, নিজে লিখতেনও। দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করতে ভালোবাসতেন। এবং তা করতে গিয়ে যখন যেখানে যেতেন, সেখানকার মানুষ, প্রকৃতি, দর্শনীয় স্থানগুলোর স্কেচ করতেন খাতায়। এ রকম ছবির খাতার সংখ্যা ছিল তাঁর প্রায় অগুনতি। এ নিয়ে বলতে গিয়ে বলতেন, ‘মাঝে মাঝে খাতায় স্কেচগুলো দেখতে ভালো লাগে। ভ্রমণের, বিভিন্ন জায়গার, মানুষের কথা মনে পড়ে, এমনকি বহু ঘটনাও।’ বলতেন, ‘এগুলো তো খাতার পাতা না, স্মৃতির পৃষ্ঠা। দেখতে থাকলে চোখের সামনে সবকিছু ভাসে। ওই সব জায়গায় আর কোনো দিন যাওয়া হবে কি না, জানি না। কিন্তু খাতাবন্দী হয়ে থাকছে তো।’

দেশসেরা জগৎসেরা শিল্পীকথা
দেশসেরা জগৎসেরা শিল্পীকথা
দেশসেরা জগৎসেরা শিল্পীকথা
প্রচ্ছদ: রফিকুন নবী
প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬,
২০৮ পৃষ্ঠা ,
দাম: ৪০০ টাকা

তাঁর এসব ড্রয়িংয়ের অপূর্বতায় মুগ্ধ হতাম। আমার সঙ্গে বসেও যে কত কিছু এঁকেছেন! এ এক দারুণ অভ্যাস ছিল তাঁর। স্কেচ খাতা সব সময় সঙ্গেই রাখতেন আর অনবরত এঁকে যেতেন। এ অভ্যাস বা চর্চা চলে আসছিল তাঁর ছাত্রজীবন থেকে।
এই অভ্যাসের বশেই পঞ্চাশের দশকের শেষ নাগাদ ঢাকার সদরঘাট, মুন্সিগঞ্জ ইত্যাদি জায়গায় গিয়ে নদী ও নৌকা স্টাডি করেছিলেন। এ কাজ করার সময় বিশাল গয়না-নৌকার ছবি আঁকতে গিয়ে গলুইয়ের সুদৃশ্য নকশা দেখে চমৎকৃত হন। বিস্ময়ে তাঁর দুই চোখ বিস্ফারিত। গলুইয়ের চারপাশে পিতল আর রঙের লোকজ নকশায় গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। তিনি নৌকার ফর্মকে ভেঙে গলুইয়ের নকশাকে প্রাধান্য দিয়ে কিছু ছবি আঁকেন নদীর বিস্তৃতিকে স্পেস হিসেবে ব্যবহার করে। আবিষ্কৃত হয় একটি স্টাইলের। এই সিরিজের ছবি অচিরেই স্বীকৃতি পেয়ে যায় অসাধারণ সেই স্টাইলের কারণে। শিল্পীর ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তি ঘটে। শুরু হয় তাঁর আধুনিক চিত্রকলাচর্চার অধ্যায়। ষাটের দশকের মধ্যভাগে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় আন্তর্জাতিক আরসিডি প্রদর্শনীতেও লাভ করেন শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।
১৯৫৯ সালে আমি যখন আর্ট কলেজে ভর্তি হই, তখন তিনি আমার শিক্ষক। সবাই বলত, এই ছবি আঁকাআঁকি নিয়ে লেখাপড়া করা মানেই জীবনকে অনিশ্চয়তার সঙ্গী করে ফেলা। রোজগারের ব্যাপারে ভূত-ভবিষ্যৎ বলতে কিছু নেই। বিভ্রান্ত ও নিরুৎসাহিত বোধ করার মতো এ-জাতীয় নানা কথা শুনতে হতো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই জেনে গিয়েছিলাম, অনেক শিল্পীই পুস্তক প্রকাশনা ও পত্রপত্রিকার সঙ্গে জড়িত। প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশনে সুনাম ছিল শিল্পী কামরুল হাসান, মোহাম্মদ ইদ্রিস, আবদুর রউফ প্রমুখের। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ব্যস্ততম শিল্পী ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। শুধু তা-ই নয়, তাঁর প্রচ্ছদের ক্যালিগ্রাফি, নকশা ও রং বিন্যাসের গ্রাফিকশৈলী এতটাই ব্যতিক্রমী যে দেশের সব প্রকাশক-লেখকের পক্ষে তাঁকে উপেক্ষা বা অবহেলা করে কিছু ভাবা কঠিন ছিল। সব মিলিয়ে তখন তিনি শুধু ব্যস্ততমই নন, নামে-সুনামে, আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত একজন সফল শিল্পী। তিনি তখন আমার সামনে ভূত-ভবিষ্যতের ব্যাপারে দুশ্চিন্তাহীন থাকার অনুপ্রেরণার উৎস। একসময় তাঁর অনুসারীও হয়ে যাই। ওই একই সময় তিনি ‘চৌকা’ নামের কার্টুনের স্রষ্টা হিসেবেও খ্যাতিমান। মোটকথা, তাঁর বহুবিধ কর্মকাণ্ডে ও জনপ্রিয় পত্রপত্রিকার সঙ্গে জড়িত থাকা, দেশের খ্যাতিমান কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতাকে প্রত্যক্ষ করে নিজেকে সেভাবে গড়ে তোলার ব্যাপারটি স্থির করেছিলাম। এবং বলতে দ্বিধা নেই, এ ব্যাপারে তাঁর অনুসৃত পথই অনুসরণ করে চলি।