অভয়কন্যার শিলালিপি
মেয়ের অপরাধ সে সাঁতারু হতে চায়। অপরাধই তো! বাড়ির মেয়েরাই গোসল সারে পর্দার ঘেরাটোপে। আর উড়নচণ্ডী মেয়েটা আঁটসাঁট হাফপ্যান্ট-গেঞ্জি পরে হদ্দমদ্দ হয়ে সাঁতার কাটে পুকুরে! গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল গুঞ্জন। মেয়ের মা-বাবাকে বোঝানো হলো, এভাবে চলতে থাকলে তো এই মেয়েকে বিয়ে দেওয়া যাবে না। এত সাঁতারের নেশাই-বা কেন? গরিবের ডলফিন রোগ!
এ রকম একটা পরিবেশেও ছোটবেলা থেকে সাঁতারুই হতে চেয়েছিলেন মাহফুজা খাতুন, যাঁকে সবাই চেনে শিলা নামে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী সাঁতারু হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে সোনা জয় করেছেন। তা-ও একটি নয়, দু-দুটি। গত বছর ভারতে অনুষ্ঠিত এই গেমসে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, ইচ্ছাশক্তির কাছে কিছুই বাধা নয়। নাড়িপোঁতা অভয়নগরের নামটি সার্থক করেছেন মাহফুজা। ভয় শব্দটাই যে তাঁর অভিধানে নেই!
যশোরের অভয়নগরে কৃষক পরিবারে মাহফুজার জন্ম। মা-বাবা, পাঁচ ভাই-বোনসহ সাতজনের বড় পরিবার। নয়টি মুখের আহার জোগাড় করতেই বর্গাচাষি বাবা আলী আহমেদ গাজীর ঘাম ছুটে যায়। সেখানে বড় মেয়েটা হতে চায় সাঁতারু, গ্রামবাসীর চোখে যা ‘গরিবের আহ্লাদ’!
সেটাই মাহফুজার কাছে শিকল ভাঙার গান। সামাজিক বঞ্চনা ও দারিদ্র্যের মহাসাগর পাড়ি দিয়ে তাঁকে হতে হবে সাঁতারু। এর জন্য অভয়নগর থেকে প্রতিদিন ১৮ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে নওয়াপাড়া শহরে এসে শুরু হলো নতুন অভিযান। শুরুটা হলো লুকোছাপা করেই। খেলাধুলার পোশাক ট্রাউজার-টিশার্ট গায়ে জড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর উপায় নেই। তাই সাধারণ জামাকাপড় পরেই চলতে থাকল অভয়নগর টু নওয়াপাড়া সাঁতার অভিযান। তবুও কি থামে গ্রামের মানুষের কটু কথা?
মেয়ে কোথায় যায় না যায়। ছেলেদের মতো চুল ছোট করে ঘোরে। হাতের পেশি ছেলেদের মতো হয়ে যাচ্ছে। এই মেয়েকে কে বিয়ে করবে? কিন্তু এ কানের কথা ও কান দিয়ে বের করে দিলেন তাঁর বাবা। যৌবনে হা-ডু-ডু খেলা আহমেদ গাজী লড়াকু মেয়ের দুই চোখের স্বপ্নটা যে ঠিক পড়তে পেরেছিলেন। খুঁজতে হলো অন্য পথ। এভাবে আর বাড়ি থেকে যাওয়া-আসা সম্ভব নয়।
এবার আশ্রয় হলো এতিমখানায়! বেঁচেবর্তে থাকা মা-বাবাকে ছেড়ে জায়গা করে নিতে হলো অনাথ আশ্রমে! নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য মানুষ কত ত্যাগই না করে! যে নারী অন্দরমহল ছেড়ে পথে নামে, সে-ই জানে, তাকে ঠিক কতটা বাঁধন ছিঁড়তে হয়!
এত ত্যাগ বৃথা গেল না। আসতে থাকল সাফল্য। ঢাকায় শিশু একাডেমী আয়োজিত আন্তজেলা মহিলা সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন মাহফুজা। সালটা ১৯৯৯, বয়স তখন ৯ বছর। জীবনের প্রথম বড় পুরস্কার, একটা সোনার মেডেল। সেই মেডেলটাই পরে মাহফুজাকে বিক্রি করে দিতে হয়েছিল বাবার চিকিৎসার খরচ মেটাবেন বলে। সেই গল্প বলেন আর হাসেন। অবাক হয়ে ভাবি, এত কষ্টের গল্প মাহফুজা এত অকপটে কীভাবে বলেন! গল্পের বাকিটা শুনতেই সেই ভ্রম কেটে যায়। আমরা বুঝে নিই, কষ্টে জীবন গড়েছেন বলে এর মধ্যেই সুখ খুঁজে নেওয়ার কৌশলটাও রপ্ত করেছেন। মাহফুজার কাছে তাঁর বাবাই যে সবচেয়ে বড় ‘গোল্ড মেডেল’!
মাহফুজার জীবনে এই প্রতিযোগিতা আরও একটি কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই জয় তাঁকে পরে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) সাঁতার প্রশিক্ষণে ভর্তির সুযোগ করে দেয়।
কিন্তু জীবন জলশূন্য এক ঝঞ্ঝার সাগর বলেই সেখানে সাঁতরানো বেশি কঠিন। এবারও বাদ সাধে অভাব। বিকেএসপিতে ভর্তির টাকাটাই জোগাড় হচ্ছিল না কিছুতেই। এলাকার এক বড় ভাই এগিয়ে এলেন। ২০০২ সালে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পা ফেলেন খেলোয়াড় তৈরির প্রতিষ্ঠানটিতে। কিন্তু যে মাহফুজাকে বারবার পেছনে টেনে ধরতে চেয়েছে পাছে লোকের কিছু কথা, সেই নোংরা আবারও পায়ে কয়েক মণের ওজন বেঁধে দিতে চায় তাঁর। ‘বিকেএসপিতে ভর্তি হয়ে ঢাকায় চলে এলাম। এলাকার মানুষ তখন বলাবলি শুরু করল, মেয়ে ঢাকায় কী করে, কাজটা কী তার?’ এখনো সে কথা বলতে গিয়ে কেঁপে ওঠেন মাহফুজা।
বিকেএসপিতে ভর্তির পরের বছরই পুরো বাংলাদেশ জেনে যায় তাঁর আগমনধ্বনি। ২০০৩ জাতীয় বয়সভিত্তিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জেতার পর জাতীয় প্রতিযোগিতায়ও জ্যেষ্ঠ সাঁতারুদের পেছনে ফেলে জেতেন স্বর্ণ ও রৌপ্যপদক।
গলায় মেডেল ঝোলানো ছবি ছাপা হয় পত্রিকায়। টিভি চ্যানেলগুলোতে ভাসে মাহফুজার হাসিমুখ। গ্রামের মানুষের এবার ভুল ভাঙল। অপবাদের লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকা মাহফুজা হয়ে উঠলেন গ্রামের গর্ব। এক যুগ পেছনের গল্প বলতে গিয়ে মাহফুজার চোখে-মুখে এই প্রথম গর্বের হাসি খুঁজে পাই আমরা, ‘যারা আমার সঙ্গে কোনো দিনই কথা বলেনি, তারাই সেধে এসে কথা বলতে শুরু করল। তারাও তাদের মেয়েদের কীভাবে সাঁতারু বানাতে পারবে, সেগুলো জানতে চাইল।’
এটাই তো তাঁর আসল জয়। চাইলে মাহফুজা থেমে যেতে পারতেন এখানেই। কিন্তু তিনি তখন আরও বড় স্বপ্নের বীজ বুনে বসে আছেন। ২০০৬ কলম্বো সাফ গেমসে প্রথমবার পুলে নেমেই জিতে নিলেন দুটি ব্রোঞ্জ। আন্তর্জাতিক মঞ্চে মাহফুজার প্রথম প্রতিভার ঝলক। ব্রোঞ্জকে বানাতে হবে খাঁটি সোনা। এ জন্য কঠোর পরিশ্রম শুরু করলেন মাহফুজা। সে সময় নেমে এল জীবনের আরেক সংকটের পর্দা।
বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন খুলনার হাসপাতালে। একদিকে মেয়ের সেরা হওয়ার লড়াই, অন্যদিকে বাবার জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ। মেডেলের মতো আর দামি কিছু নেই সংসারে। মা করিমুন্নেসা বাধ্য হলেন একটা সোনার মেডেল বিক্রি করে দিতে। সেই সোনার মেডেল, যা দিয়ে জীবনের মোড় ঘোরানো শুরু হয়েছিল মাহফুজার। ‘১৯৯৯ সালে শিশু একাডেমী প্রতিযোগিতায় পদকটি জিতেছিলাম। জীবনের প্রথম বড় মেডেল। যখন প্রথম শুনলাম মেডেলটা মা বিক্রি করে দিয়েছেন, কষ্ট তো হয়েছিলই। কেঁদেওছিলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম, বাবার চিকিৎসাই তো আগে। বাবা না থাকলে এ পর্যন্ত কি আর আসতে পারতাম!’
এর মধ্যে পড়াশোনা কিন্তু থেমে থাকেনি। ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে শুরু হলো নতুন অধ্যায়। জীবন, সাঁতারের পুল আর পড়াশোনা—কেমন ছিল একসঙ্গে তিনটি লড়াই চালিয়ে যাওয়া? মাহফুজা বললেন, ‘বিকেলে প্রতিযোগিতা করে রাতের বাসে চট্টগ্রাম গিয়েছি। আবার সকালে পরীক্ষা দিয়েই ঢাকায় ফিরে আবার প্রতিযোগিতায় নেমেছি। কিন্তু টাইমিংয়ে প্রভাব পড়তে দিইনি।’
দেশের মাটিতে ২০১০ এসএ গেমসে নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ পেলেন। ২০০৬ এসএ গেমসে দুটি ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন। এবার জিতলেন দুটি সোনা। উন্নতির গ্রাফটা ঠিক পথেই আছে, বুঝতে পারলেন মাহফুজা। কিন্তু তৃপ্ত হননি তাতেও। বড় কোনো আন্তর্জাতিক আসরে সোনা জেতার আকাঙ্ক্ষা বরং বেড়েছে আরও। একটি ইভেন্টে ফটোফিনিশিংয়ে সোনা হাতছাড়া হয়েছে। এই দুঃখবোধ মাহফুজাকে যেন আরও তাতিয়ে দিল। কানে ভেসে এল, কে জানি বলছে, ‘মেয়েটার উচ্চতাটা কম। অত খাটো না হলে ফটোফিনিশিংয়ে সে-ই এগিয়ে থাকত।’ সহমর্মিতা? খোঁটা? নাকি তাঁর সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন? এই উচ্চতা দিয়ে কত বড় বাধার দেয়াল টপকেছেন। মাহফুজার জেদ বেড়ে গেল। শুধু অপেক্ষা করতে থাকলেন আরও একটা সুযোগের। অবশেষে দীর্ঘ ছয় বছর পর আবারও এসে গেল সুযোগ।
৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, সেদিনও গুয়াহাটির পূর্বের আকাশে একই সূর্য। সারুসাজাই স্পোর্টস কমপ্লেক্সের জাকির হুসেন সুইমিংপুলে বাংলাদেশের সাঁতারুদের নিয়ে কারও কোনো আগ্রহ নেই। ওরা তো এসেছে অংশগ্রহণই বড় কথার স্লোগান নিয়ে! বাকি সবার ভাবটা এমনই। কিন্তু মাইকে একটা নাম সবাইকে স্তব্ধ করে দিল। ‘১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে সোনা জিতেছেন বাংলাদেশের মাহফুজা খাতুন।’ সময় নিয়েছিলেন ১ মিনিট ১৭ দশমিক ৮৬ সেকেন্ড। গেমসে সোনাজয়ী বাংলাদেশের প্রথম নারী সাঁতারু! এক দিন পরেই সেই সুইমিংপুলে ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ৩৪ দশমিক ৮৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে রেকর্ড গড়ে সোনা জিতলেন। ২০০৬ শ্রীলঙ্কা গেমসে এই ইভেন্টে ৩৪ দশমিক ৯৭ সেকেন্ড সময় নিয়ে সোনা জেতেন শ্রীলঙ্কার রাহিম মায়ুমি। ভাঙলেন ১০ বছর পুরোনো গেমস রেকর্ডও।
অথচ মাহফুজাকে এই গেমসে পাঠানো নিয়েও কম জল ঘোলা হয়নি। মাহফুজা বুড়িয়ে গেছেন বলেই মনে হচ্ছিল ফেডারেশনের। নিয়মিত ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় সাফল্য পেয়ে এলেও তাঁকে বাদ দিয়ে অলিম্পিকে পাঠানো হয় অন্যদের। বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণে গেছেন অন্য কেউ। গেমসে যাওয়ার আগেও তাঁকে শুনতে হয়েছে ‘মাহফুজা বুড়িয়ে গেছে’। আর গেমসে পা দিয়ে শুনতে হয়েছে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভারতে নিয়ে আসা হয়েছে মাহফুজাকে।’ মাহফুজা মুখে কিছু বলেননি। এখন বোঝেন, এই ঘটনাগুলো ঘটে ভালোই হয়েছে। না হলে পুলে জীবনের শেষ জ্বালানিটুকু দিয়ে লড়াই করার তাগিদ যে পেতেন না!
মাহফুজা এখন কাজ করছেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে। যোগ দিয়েছেন চিফ পেটি অফিসার পদে। ১৪ বছর ধরে ভালোবাসার মানুষ আরেক সোনাজয়ী সাঁতারু শাজাহান আলী রনির সঙ্গে বসেছেন বিয়ের পিঁড়িতে। জলের দুই মানব-মানবী সুখের সংসারের ভেলা ভাসিয়ে দিয়েছেন।
এই হলো সব বাধা জয় করা অভয়নগরের অভয়কন্যার শিলালিপি।
রাশেদুল ইসলাম: ক্রীড়া সাংবাদিক।
মাহফুজা খাতুনের যত অর্জন
স্বর্ণপদক: ২
৫০ মিনিট ও ১০০ মিনিট ব্রেস্টস্ট্রোকে, দক্ষিণ এশীয় গেমস ২০১৬, গুয়াহাটি, ভারত
রৌপ্যপদক: ২
১০০ মিটার ও ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে, দক্ষিণ এশীয় গেমস ২০১৬, ঢাকা, বাংলাদেশ
ব্রোঞ্জপদক: ২
১০০ মিটার ও ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে, দক্ষিণ এশীয় গেমস ২০০৬, কলম্বো, শ্রীলঙ্কা
দেশের প্রতিনিধিত্ব
কমনওয়েলথ গেমস, দিল্লি ২০১০ ফিনা বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপ, দুবাই ২০১০
বিশ্ব সাঁতার প্রতিযোগিতা, বার্সেলনা ২০১৩ কমনওয়েলথ গেমস, গ্লাসগো ২০১৪