‘আপনের কী?’ মন্তব্যে এক চিকিৎসকের ‘আত্মোপলব্ধি’

চিকিৎসক রিয়াসাত আজিম
ছবি: সংগৃহীত

করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত আইসোলেশন সেন্টারে দায়িত্ব পালন করছিলেন এক চিকিৎসক। দেড় বছরের শিশুকে কোলে নিয়ে সেখানে ঢুকছিলেন এক ব্যক্তি। দুজনের মুখেই মাস্ক নেই। ওয়ার্ডে তাঁর এক স্বজন ভর্তি আছেন বলে জানালেন ওই ব্যক্তি। চিকিৎসক বললেন, এটা আইসোলেশন ওয়ার্ড। রোগী ছাড়া বাইরের মানুষ প্রবেশ নিষেধ। তা ছাড়া তাঁর (ব্যক্তি) সঙ্গে শিশু আছে। কারও মুখে মাস্ক নেই। দুজনেরই স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে। ওই ব্যক্তির জবাব, ‘বাচ্চা মরলে আমারটা মরবে। আপনের কী? কথা না বইলা নিজের কাজে যান...।’

ওই চিকিৎসকের নাম রিয়াসাত আজিম। তিনি কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা। তিনি বর্তমানে ভৈরব বাসস্ট্যান্ড এলাকার ট্রমা সেন্টারে স্থাপিত কোভিড-১৯ আইসোলেশন সেন্টারে কর্মরত।

ঘটনাটি থেকে ‘তীব্র আত্মোপলব্ধি’ হয়েছে রিয়াসাতের। তিনি নিজের ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে লিখে মনের কষ্ট তুলে ধরেছেন। ওই লেখার নিচে বিভিন্নজন মন্তব্য করেছেন। তাঁদের মধ্যে অনেক চিকিৎসকও রয়েছেন। করোনাকালে কাজ করতে নানা মন্দ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন তাঁরাও।

রিয়াসাত আজিম জানিয়েছেন, ভৈরবের এই আইসোলেশন সেন্টারে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত আছেন দেড় বছর ধরে। ঘটনাটি ঘটেছে শনিবার সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে। ঘটনার ২০ মিনিট পর নিজের ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। এই লেখা পড়ে যদি কেউ সচেতন হয়, সেটাই তাঁর প্রত্যাশা।

রিয়াসাত মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সচেতনতা সৃষ্টির জন্য অনেক কার্যক্রম চলছে। কথাও কম হচ্ছে না। কিন্তু ফলাফল আশাজাগানিয়া নয়। আমার এই পোস্ট শুধু ব্যক্তিগত কষ্ট থেকে নয়। উদ্দেশ্য, করোনা নিয়ে মানুষের ভুল-ভাবনার খণ্ডচিত্রটি সবার সামনে আনা। লেখা পড়ে যদি কিছু মানুষের উপলব্ধি হয়, তাতে আমার কষ্ট কিছুটা কমবে।’

চিকিৎসক রিয়াসাত নিজের লেখাটার শিরোনাম দেন ‘ভৈরবের করোনা পরিস্থিতি, ফ্যাক্ট: তীব্র আত্মউপলব্ধি’। ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরার পর তিনি জানিয়েছেন, ওই নারীর কথায় তাঁর আসলেই আত্মোপলব্ধি হয়েছে। লিখেছেন, ‘আসলেই তো আমার কী? এ দেশের মানুষ কখনোই স্বাস্থ্যবিধি মানবে না। কারণ, তাদের মতে “হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে...”, কিন্তু মরলে সব দোষ ডাক্তারের।’

চিকিৎসক রিয়াসাত আজিমের সেই লেখা।
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

এদিকে ফেসবুকে লেখাটা প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকে তার নিচে মন্তব্য করেছেন। মীর মোহাম্মদ মারুফ মিয়া নামের এক ব্যক্তি লিখেছেন, ‘এক অসভ্য সময়ে বসবাস করছি আমরা।’ দ্বীন ইসলাম নামের একজন চিকিৎসক লিখেছেন, ‘এই মানুষগুলো নিজের মনমতো চলে। না মানে ধর্ম; না মানে বিজ্ঞান।’

এমন আরও কয়েকজন চিকিৎসক সেখানে মন্তব্য করেছেন। কোনো কোনো লেখায় করোনাকালে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে তাঁরা কী ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন, সেই চিত্র উঠে এসেছে। বেশির ভাগ মন্তব্যই মন্দ অভিজ্ঞতা নিয়ে।

স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জে এখন পর্যন্ত ৭২ হাজার ৮৯৭ জনের নমুনা পরীক্ষায় মোট ৯ হাজার ১৩৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। জেলায় করোনায় মোট মারা গেছেন ১৫৪ জন। নমুনা পরীক্ষা, করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা—এই তিন সূচকে জেলার ১৩টি উপজেলার মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভৈরব। উপজেলায় ৯ হাজার ৬৩ জনের নমুনায় করোনা রোগী শনাক্তের সংখ্যা ১ হাজার ৬৫২। পুরো জেলায় শনাক্তের গড় হার ১২ দশমিক ৫৩ শতাংশ হলেও ভৈরবে সেটি ১৮ দশমিক ২২ শতাংশ। গত দুই সপ্তাহে শনাক্তের হার বেড়ে ৫০ শতাংশের ওপরে রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ৫৬ জনের। উপজেলায় এ পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ২৯ জন।

ভৈরবে করোনাভাইরাস নিয়ে সচেতনতার মাত্রায় হতাশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুবনা ফারজানা এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা খুরশীদ আলম। ইউএনও হলেন উপজেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি; স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ওই কমিটির সদস্যসচিব।

লুবনা ফারজানা বলেন, মানুষজন আরও সচেতন না হলে বছরের পর বছর পার হলেও করোনা প্রতিরোধে সুফল আসবে কি না সংশয় রয়েছে।

খুরশীদ আলম বলেন, মানুষ সচেতন না হওয়ায় সুফল মিলছে কম। অনেকে জানেন, তাঁরা করোনায় সংক্রমিত। তবু তথ্য গোপন করেন। বাইরে বের হন। অনেকে আবার করোনা নিয়ে মনগড়া কথা বলেন। এসব কারণে সচেতনতা বাড়ছে না; করোনা পরিস্থিতি আরও নাজুক হচ্ছে।