আমের উৎপাদন ভালো, দাম সহনীয়

সোনার বাংলা বাণিজ্যালয়ের টিনের ছাউনির ঘরটিতে শুধু বসার জায়গাটুকুই আছে। সেখানে একটি ছোট টেবিল আর তিনটি চেয়ার। বাকি জায়গা দখল করে আছে শত শত আমের ঝুড়ি। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি ফলের আড়তের দোকান এটি। বাজারের উত্তর দিকে রাস্তাঘেঁষা এ দোকান সহজেই চোখে পড়ে। আমের মৌসুম শুরুর আগে এ দোকানসহ আশপাশের প্রায় সব দোকানে কিছু তরমুজ ও অন্যান্য ফলে ভরা ছিল। গত শনিবার গিয়ে দেখা গেল, দাপট শুধু ফলের রাজা আমের।

আড়তটির মালিক মাহবুবুল আলম। তিনি আবার পাইকারি ফল ব্যবসায়ীদের সংগঠন কারওয়ান বাজার আদর্শ ফল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতিও। মাহবুবুল আলম বললেন, ‘চাহিদার তুলনায় আমের জোগান বেশি। তাই দামও কম। ধরেন, যেখানে চাহিদা ৩০০ টন, সেখানে আম আসছে হাজার টন।’

মাহবুবুল আলম আমের এই স্বল্প মূল্য বোঝাতে গতবারের দরের সঙ্গে তুলনা করলেন। তিনি জানালেন, এবার তাঁর আড়তে থাকা আমের মধ্যে ল্যাংড়ার দর প্রতি কেজি মানভেদে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। হিমসাগর ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা। আর লক্ষ্মণভোগ ২০ থেকে ২৫ টাকা। তাঁর দাবি, পাইকারিতে গত বছরের চেয়ে আমের দর কেজিপ্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা কম।

এখন বাজারে ল্যাংড়া, হিমসাগর, লক্ষ্মণভোগের পরিমাণই বেশি। আম্রপালিও আসতে শুরু করেছে। হাঁড়িভাঙা আসবে কয়েক দিন পর থেকে।

এবার মৌসুম শুরুর পর থেকেই বাজারে আমের দাম তুলনামূলক কম ছিল। এবার বৃষ্টি কম হয়েছে বলে বাগানমালিকেরা আমের ফলন নিয়ে চিন্তায় ছিলেন। কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও গবেষকেরা বলছিলেন, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এ ফলের জন্য কম বৃষ্টি বড় সমস্যা হবে না। আমের আকার কিছুটা ছোট হতে পারে। তবে ফলন ভালো হবে। তা হয়েছেও।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, তিন কারণে এবার দাম কম। মূল কারণ বেশি ফলন। এ ছাড়া টানা বৃষ্টিপাতে মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে কম। এতে বাজার চাঙা নয়। করোনার কারণে সীমান্ত জেলাগুলোয় অব্যাহত লকডাউনও চাহিদার ওপর প্রভাব ফেলছে। উত্তরের জেলা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ এবং দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরা, মেহেরপুর সীমান্তবর্তী জেলা। আর এগুলো বড় আম উৎপাদনকারী এলাকা।

কারওয়ান বাজারে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী, আম উৎপাদনকারী পাঁচ জেলার একাধিক বাগানমালিক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর আমের দাম সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে যাবে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেশে বছরে প্রায় ১২ লাখ আম উৎপাদিত হয়। এ উৎপাদন প্রতিবছরই বাড়ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান মনে করেন, উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ এর চাহিদা বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, চাহিদা বাড়ার কারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সেই সঙ্গে ক্রয়ক্ষমতা কিছুটা বেড়ে যাওয়া।

উৎপাদন ভালো

সম্প্রতি দেশের আমের বড় উৎপাদনকারী অঞ্চলে পরিণত হওয়া নওগাঁর সাপাহারের একজন ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হাবীব দেড় দশক ধরে আমের বাগান করছেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমের এত ফলন কম দেখেছি। ভালো ব্যবসা হবে। দাম এখন একটু কম। তবে আমাদের ক্ষতি হবে, এমনটি নয়।’

ক্ষতি কেন হবে না, এর উত্তরে হাবীব বলেন, ‘আশা করেছিলাম, কোনো বাগানে তিন টন আম হবে। হয়েছে ৯ টন। কিন্তু উৎপাদন যেহেতু বেশি হয়েছে, তাতে দাম কম হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাচ্ছে।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোহনপুরের বাসিন্দা রফিকুল ইসলামের প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ওপর একটি আমবাগান রয়েছে। তাঁর বাগানে গোপালভোগ, হিমসাগর ও ল্যাংড়া জাতের আমের গাছ রয়েছে। তিনি গত বছর ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২২০ টাকা মণ দরে ল্যাংড়া বিক্রি করেছেন। এবার বিক্রি করছেন ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত। রফিকুলেরও কথা, তাঁর এতে লোকসান হচ্ছে না। কারণ, এবার ফলন ভালো।

দেশের একক কোনো জেলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদিত হয় নওগাঁয়। এবার এ জেলায় আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৬২ হাজার টন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. শামছুল ওয়াদুদ বলেন, এবার ফলন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। প্রতি হেক্টরে এবার ১৫ টন আম হতে পারে। গত বছর গড়ে ১২ টন আম ফলেছিল।

আমের ফলন নিয়ে খুশি চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি দপ্তরের কর্মকর্তারাও। গত বছর জেলায় প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছিল সাড়ে সাত টন। এবার তা ১০ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে দাবি করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত উপপরিচালক এ কে এম মঞ্জুরে মাওলা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার পুরো জেলায় লক্ষ্যমাত্রা ছিল আড়াই লাখ টন। কিন্তু এটা সাড়ে তিন লাখ ছাড়াবে, আমরা নিশ্চিত।’

ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার এই সূর্য পুরি আমের গাছটি প্রায় দুই বিঘা জমি জুড়ে ছড়িয়ে আছে। অনেকেই এ গাছ দেখতে আসেন। সেই গাছে ঝুলে আছে আম। ছবিটি সম্প্রতি তোলা
ছবি: মুজিবর রহমান খান

আম্পান থেকে ইয়াস, আবার করোনা

সাতক্ষীরার ব্যবসায়ী শেখ মারুফুল হকের বাগানে গত বছর প্রচুর আম হয়েছিল। যে সময় আমগুলো পুষ্ট হয়েছে, ঠিক তখনই আঘাত করে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এতে তাঁর বাগানের প্রায় সব আম নষ্ট হয়ে যায়। সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুরের এই আম ব্যবসায়ী এবার প্রায় সব আম পাড়তে পেরেছেন।

মারুফুল হক বলছিলেন,এবার আমের একেবারেই কোনো ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি হয় দুইভাবে। ঝড়ে আর পোকায়। এবার দুই দিক থেকেই মুক্ত থাকা গেছে।

দেশে গত বছরের ২০ মে আম্পান আঘাত করে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও যশোর এলাকার আমের বাগান লন্ডভন্ড হয়ে যায়।

সাতক্ষীরার সুলতানপুর বাজারের ব্যবসায়ী আবদের আলী বলেন, ‘গত বছর আমাদের সোনার বাগান নষ্ট হইয়ে গিয়েছিল। এবার ফলন হয়েছে প্রচুর। ব্যবসায়ীরা এবার ক্ষতি পুষিয়ে নেবে।’

ব্যবসায়ীরা এ বছর যখন আশায় বুক বাঁধছিলেন, তখনই বিপদ নিয়ে হিসেবে হাজির হয়েছিল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। ২০ মে থেকেই এ নিয়ে নানা আলোচনা। তাই সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণের প্রায় সব জেলায় দ্রুত আম পাড়ার হিড়িক পড়ে যায়। সাতক্ষীরার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ল্যাংড়া আম পাড়ার তারিখ নির্ধারিত ছিল ২৭ মে। কিন্তু ইয়াসের ভয়ে বাগানের মালিকেরা বেশির ভাগ আম আগেই পেড়ে ফেলেন।’

একসঙ্গে প্রচুর আম পাড়ার ফলে বাজারে সরবরাহ অনেক বেড়ে যায়। এতে মৌসুমের শুরুতে দাম কমে যায়। কারওয়ান বাজারের আড়তদার মো. রিপন মিয়া। তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে আমাদের দাদন দেওয়া কৃষকেরা গাছে আম রাখতে চাননি।’
রাজশাহী বিভাগে যখন আম পাড়া শুরু হলো, তখনই দেশের সীমান্তের জেলায় করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকে। লকডাউন ও বিধিনিষেধের প্রভাব কিছুটা পড়েছে আম বিক্রিতে।

নওগাঁর সাপাহার বাজারে এবার আমের ফড়িয়াদের আনাগোনা অপেক্ষাকৃত কম বলে জানান বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কের পরিচালক সোহেল রানা। তিনি বলেন, করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা কম আসছেন। তবে কুরিয়ারের মাধ্যমে আম যাচ্ছে ব্যাপক হারে। গত বছর এই বাজার থেকে তিনটি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আম যেত। এবার ১০টির মতো প্রতিষ্ঠান কুরিয়ার সার্ভিস সেবা দিচ্ছে।

স্বস্তিতে খুচরা বিক্রেতা ও ক্রেতা

কারওয়ান বাজারের পাইকারি বাজারগুলো ছাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে ডান দিকে গেলে আমের বেশ কয়েকটি বড় দোকান। এসব দোকানে দেশি ল্যাংড়া, হিমসাগর ও লক্ষ্মণভোগ বেশি পাওয়া যায়। আছে দেশি গুটি আমও। পাইকারি বাজারের আমের দামের সঙ্গে এ বাজারে তারতম্য আছে। ল্যাংড়া পাইকারির চেয়ে এখানে কেজিতে মানভেদে ১০ থেকে ২০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। হিমসাগরও ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। বিক্রিতে খুশি বিক্রেতারা। দাম কম পেয়ে স্বস্তি ক্রেতারও।

কারওয়ান বাজারে গত শনিবার কথা হয় কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে। তাঁদের একজন রফিকুল ইসলাম এসেছিলেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে। ১৫ কেজি আম কিনলেন। রফিকুলের কথা, ‘গত বছরের দাম তো মনে নেই। তবে এবার যেমন প্রত্যাশা করেছিলাম, তার চেয়ে কম।’