প্রশ্ন:
প্রথম আলো: দেশে আমের মৌসুম শুরু হয়েছে। আমরা দেখছি, বিভিন্ন দোকানে লিখে রাখা হচ্ছে—ফরমালিনমুক্ত আম। অনলাইনেও ফরমালিনমুক্ত দাবি করে বিভিন্ন জন আম বিক্রি করছেন। এই প্রচারণায় ক্রেতারা কতটুকু আস্থা রাখতে পারেন?
মনিরুল ইসলাম: ফরমালিনমুক্ত দাবি করে আম বিক্রি আসলে প্রতারণা। এটা করা হয় ক্রেতার কাছ থেকে বাড়তি দাম নেওয়ার জন্য। আম বা কোনো ফল এবং শাকসবজিতে ফরমালিন ব্যবহার করা হয় না, এখনো হচ্ছে না, ভবিষ্যতেও হবে না।
প্রশ্ন:
প্রথম আলো: আপনি কিসের ভিত্তিতে এ দাবি করছেন?
মনিরুল ইসলাম: বিজ্ঞানের ভিত্তিতে। ফল ও শাকসবজিতে ফরমালিন কখনো কাজ করবে না। কারণ, ফাইবার বা আঁশে ফরমালিন কাজ করে না। ফরমালিন ব্যবহারের যেসব ছবি দেখানো হয়, সেগুলো ফরমালিন নয়। ফরমালিন বর্ণহীন, ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত। যেসব ছবি আমাদের হাতে এসেছে, সেসবে ফরমালিন হিসেবে যে তরলের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো নানা রঙের। ফরমালিন পানিতে যেমন অতি দ্রবণীয়, তেমনি অতি উদ্ধায়ী, তাৎক্ষণিকভাবে কখনোই ফরমালিন মাপা যায় না।
প্রশ্ন:
প্রথম আলো: তাহলে সরকারি সংস্থা ও ম্যাজিস্ট্রেটরা যন্ত্র দিয়ে যে পরীক্ষা করতেন, সেগুলোকে কী বলবেন?
মনিরুল ইসলাম: যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন পরীক্ষা হতো, সেটি যে ফল, শাকসবজি বা মাছ পরীক্ষার জন্য কার্যকর নয়, তা সরকারি তিনটি সংস্থার পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। পাশাপাশি যাঁরা অভিযান চালাতেন, তাঁরা ওই যন্ত্রের উৎপাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্ধারিত মাত্রা অনুযায়ী ১০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) পর্যন্ত ফরমালিন মানুষ কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি ছাড়াই গ্রহণ করতে পারে।
প্রশ্ন:
প্রথম আলো: তাহলে ফলে কি কোনো রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয় না?
মনিরুল ইসলাম: হয়, সেটা হলো ইথোফেন। ২-ক্লোরো ইথাইল ফসফনিক অ্যাসিডকে ইথোফেন বলা হয়। এটি আমসহ বিভিন্ন ফল পাকাতে ব্যবহার করা হয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই বাণিজ্যিকভাবে ফল পাকাতে ইথোফেনের ব্যবহার রয়েছে। ইথোফেন প্রয়োগ করা হলে ইথিলিন গ্যাস তৈরি হয়, যা ফলের পাকনপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। এটা প্রয়োগ না করা হলেও প্রাকৃতিকভাবে ইথিলিন তৈরি হয়ে ফল পেকে যায়। বাণিজ্যিকভাবে একসঙ্গে বেশি ফল পাকাতে ইথিলিন চেম্বার ব্যবহার করা হয়।
প্রশ্ন:
প্রথম আলো: বাংলাদেশে তো কোনো ইথিলিন চেম্বার নেই যে মাত্রা অনুযায়ী ইথোফেন প্রয়োগ করা হবে। অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় প্রয়োগের ফলে কি ঝুঁকি তৈরি হয়?
মনিরুল ইসলাম: বাংলাদেশে পরিমিত মাত্রায় প্রয়োগ করা হয় না, এটা ঠিক। তবে আমরা বিভিন্ন পর্যায় থেকে আমসহ বিভিন্ন ফল সংগ্রহ করে প্রতিবছর পরীক্ষা করি। এতে দেখা গেছে, সহনীয় মাত্রার চেয়ে ইথোফেন কম থাকে। যেমন আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত মানকাঠামো কোডেক্স অনুযায়ী আম, টমেটো, কলা, পেঁপে ইত্যাদি ফলে সর্বোচ্চ সহনীয় অবশিষ্টাংশের সীমা (ম্যাক্সিমাম রেসিডিউ লিমিট) হলো দুই পিপিএম। দৈনিক একজন মানুষ তাঁর শরীরের প্রতি কেজি ওজনের বিপরীতে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ পিপিএম ইথোফেন গ্রহণ করতে পারে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ফলে এই মাত্রা সহনীয় পর্যায়ের নিচে থাকে।
প্রশ্ন:
প্রথম আলো: মৌসুমের শুরুতে আম পাকাতে কার্বাইড ব্যবহারের কথা শোনা যায়।
মনিরুল ইসলাম: এটাও ঠিক। মৌসুমের শুরুতে অপরিপক্ব আম কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়। তখন আমের ঝুড়ির নিচে খুঁজলে কার্বাইডের পুঁটলি পাওয়া যাবে। দেশের আইনে কার্বাইড ব্যবহার নিষিদ্ধ। তবে আমরা কারওয়ান বাজারে ধ্বংস করা আম পরীক্ষা করে দেখেছি, কার্বাইডের অবশিষ্টাংশ (অর্থাৎ আর্সেনিক অবশিষ্টাংশ। কারণ, কার্বাইড সরাসরি মাপা যায় না) ক্ষতিকর মাত্রায় ছিল না। ধ্বংস করা আমের ওজন হিসাব করে দেখা গিয়েছিল, যে মাত্রায় অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি রয়েছে, তাতে একসঙ্গে প্রায় ৫২টি আম খেলে ডায়রিয়ার ঝুঁকি থাকে। কার্বাইড দিয়ে পাকানো অপরিপক্ব ফলে স্বাদ–গন্ধ কম হতে পারে, কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মাত্রায় রেসিডিউ বা অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়নি। সহনীয় মাত্রার বেশি কার্বাইড মানুষের পেটে গেলে চুলকানি ও অ্যালার্জি হতে পারে। ডায়রিয়াও হতে পারে।
প্রশ্ন:
প্রথম আলো: আপনারা এসব পরীক্ষা কোথায় করেছেন?
মনিরুল ইসলাম: আমরা ভারতের চেন্নাইয়ে অবস্থিত বিশ্বের সুপরিচিত পরীক্ষা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এসজিএসের পরীক্ষাগার থেকে পরীক্ষা করিয়ে এনেছি।
প্রশ্ন:
প্রথম আলো: তাহলে অভিযান চালিয়ে আম ধ্বংস করার কোনো যুক্তি নেই?
মনিরুল ইসলাম: অপরিপক্ব আম নিষিদ্ধ কার্বাইড দিয়ে পাকানোর কারণে জরিমানা করা ঠিক আছে। তবে আম ধ্বংস করা অনুচিত। আর চোখের দেখায় বোঝা সম্ভব না যে আমগুলো ক্ষতিকর। ভোক্তা হিসেবে সাধারণ মানুষেরও দায় আছে। আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, প্রতিবছর ২০ মের আগে আম কেনা উচিত নয়। মার্চ–এপ্রিলে পরিপক্ব–সুমিষ্ট আম বাজারে আসে না। তখনই কিনতে হবে কেন, একটু সবুর করা উচিত।
প্রশ্ন:
প্রথম আলো: মৌসুমের শুরুতে তো সাতক্ষীরার গোবিন্দভোগ আম বাজারে আসে। বাকি আমের ক্ষেত্রে ক্রেতার করণীয় কী?
মনিরুল ইসলাম: আম কোন সময় পাড়া শুরু হবে, তার একটি সময়সূচি প্রতিবছর ঠিক করা হয়। তা দেখে গ্রাহকের আম কেনা উচিত।
প্রশ্ন:
প্রথম আলো: সাধারণ মানুষের একটি কৌতূহলী প্রশ্ন আছে। আপেল ঘরে রেখে দিলে দীর্ঘদিন পরও পচে না কেন?
মনিরুল ইসলাম: যাঁরা এই প্রশ্ন করে তাঁদের বলুন, কোনো স্বজন দেশে আসার সময় তাঁকে দিয়ে ইউরোপের সুপারস্টোর থেকে কয়েকটি আপেল কিনে আনাতে। তারপর আপেলগুলো রেখে দিয়ে দেখেন, কত দিনে পচন ধরে। ছয় মাসেও পচন ধরবে না। শুকিয়ে যেতে পারে। কারণ হলো, আপেল গাছ থেকে পাড়ার পর দিনে ৫–১০ গ্রাম করে ওজন কমে। এই ওজন কমা বিলম্বিত করতে ১৯২০ সাল থেকে আপেলসহ বিভিন্ন ফলের ওপর মোমের প্রলেপ দেওয়া হয়। এটা স্বাস্থ্যসম্মত। নইলে গাছ থেকে পাড়ার পর রপ্তানি করে বাংলাদেশের মানুষের হাতে আসতে আসতে আপেল শুকিয়ে যেত।
প্রশ্ন:
প্রথম আলো: তাহলে আপনার বক্তব্যের সারমর্ম হলো, আমরা নিশ্চিন্তে আম খাব।
মনিরুল ইসলাম: আমি তো চিন্তার কিছু দেখি না; বরং আম না খেলে নানা রকম পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হতে হবে। শিশুদের তো তাজা মৌসুমি ফল খাওয়ানো খুবই দরকার।
প্রশ্ন:
প্রথম আলো: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
মনিরুল ইসলাম: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।