আর্থিক লেনদেনে বাড়ুক নারীর অংশগ্রহণ

অর্থ লেনদেনে গোপনীয়তা রাখতে নারীকে ডিজিটাল শিক্ষায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার আহ্বান।

  • ব্যাংক হিসাবগুলোকে কার্যকর, গতিশীল ও সহজে ব্যবহারযোগ্য করে নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর সুপারিশ।

  • কোন ধরনের সামাজিক ব্যবস্থা নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতায়নের পথে বাধা, তা চিহ্নিত করে সমাধানের ওপর জোর।

মুস্তাফা কে মুজেরী

নিজের ব্যাংক হিসাবে (মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিংসহ) সঞ্চয় করা, ঋণ নেওয়া, ব্যয় করা এবং লেনদেন সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে। ডিজিটাল জ্ঞানে পিছিয়ে থাকায় অনেক নারী মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হন। মুঠোফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস) এবং ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার (এমএফআই) সেবা নেওয়া নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক হিসাবের সঙ্গে যুক্ত করে তাঁদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো যায়।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নারী: চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা ও করণীয়’ শিরোনামে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বক্তারা।

সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিআরডি) ও প্রথম আলো যৌথভাবে গোলটেবিল বৈঠকটির আয়োজন করে। বক্তারা ব্যাংক হিসাবগুলোকে কার্যকর, গতিশীল ও সহজে ব্যবহারযোগ্য করে নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর সুপারিশ করেন। কোন ধরনের সামাজিক ব্যবস্থা নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা চিহ্নিত করে সমাধান করার ওপর জোর দেন তাঁরা।

মো. আবুল বশর

অনুষ্ঠানে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় সিআরডি পরিচালিত ‘আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে জেন্ডার বৈষম্য’ শীর্ষক গবেষণা প্রকল্পের একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। গবেষণা দলের সদস্য লীলা রশিদ ও গবেষণা সহযোগী আরিফ জাওয়াদ যৌথভাবে নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৯ সালের এক জরিপ অনুসারে, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের মধ্যে ৫৫ শতাংশের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক হিসাব (ব্র্যাঞ্চ ব্যাংকিং) রয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত দেশে ব্যাংকের সংখ্যা (শাখাসহ) ১০ হাজার ৬৭১। গ্রাহক ১১ কোটি ৬০ লাখ। এর মধ্যে নারী গ্রাহক কত, তা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া যায়নি। ওই সময়ে মোবাইলে আর্থিক সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীর হার ৪৮ শতাংশ। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে নারীর হিসাব রয়েছে ৪২ শতাংশ। ক্ষুদ্রঋণে ২২ থেকে ২৫ শতাংশ নারীর প্রবেশাধিকার রয়েছে। সুবিধাবঞ্চিত মানুষ ও স্কুলশিক্ষার্থীদের জন্য ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাবের গ্রাহক রয়েছে ২ কোটি ৬৮ লাখের বেশি। নারী–পুরুষ গ্রাহকের হার বোঝাতে পুরোনো তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে গ্লোবাল ফিনডেক্স ডেটা অনুসারে, বাংলাদেশে আর্থিক সেবার যেকোনো একটিতে প্রবেশাধিকার রয়েছে মাত্র ৩৬ শতাংশ নারীর। ২০১৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন সার্ভে অনুসারে, বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক হিসাব রয়েছে ৩২ শতাংশ নারীর।

সভাপতির বক্তব্যে ইনস্টিটিউট ফর ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফা কে মুজেরী বলেন, ২০২৬ সালের মধ্যে সব নাগরিককে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব শুরু হলেও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে এটা বড় কোনো অর্জন নয়। তাই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে লড়াই করতে হবে।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নারীর নামে ঋণ দেওয়া হয়েছে। তবে সেই ঋণ বাড়ির পুরুষ সদস্যরা ব্যবহার করছেন।
সুতপা চৌধুরী, পরিচালক, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি

নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. আবুল বশর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে ব্যাংকের প্রতিটি শাখাকে অন্তত তিনজন নারী উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং এর মধ্যে একজনকে ঋণসহায়তা দিতে হবে। বড় বড় অনেক ব্যাংক নারীদের অগ্রাধিকার দিতে চায় না। তারা বড় ঋণগ্রহীতাদের পেছনে ছোটে। তিনি জানান, আগামী সপ্তাহে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হবে। এর আওতায় নারীরা ছয় মাসের জন্য ৯ শতাংশ হার সুদে ৫০০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন।

সুতপা চৌধুরী

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির পরিচালক সুতপা চৌধুরী বলেন, ৭৪১টি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতাদের ৯১ শতাংশ নারী। ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে নারী বেশি হলেও ঋণের ব্যবহার নিয়ে এখনো সন্তুষ্ট হতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নারীর নামে ঋণ দেওয়া হয়েছে। তবে সেই ঋণ বাড়ির পুরুষ সদস্যরা ব্যবহার করছেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ডিজিটাল অর্থায়নে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন সামাজিক সুরক্ষা ভাতা পাওয়া অনেক নারীর নিজের মুঠোফোন না থাকায় তাঁর অর্থের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না। হয়তো ছেলের মুঠোফোনে তিনি ভাতা নেন। ছেলে টাকাগুলো নিজে ব্যবহার করে ফেলেন।

ফাহমিদা খাতুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সানজীদা আখতার বলেন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে নারীর বহুমাত্রিক দারিদ্র্যকে বিবেচনা করতে হবে। অর্থ লেনদেনে গোপনীয়তা রাখতে তাঁকে ডিজিটাল শিক্ষায় প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বলেন, তাঁদের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ৫৩ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ৬৩ শতাংশ নারী। সব ব্যাংক নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করলে ২০২৬ সালের মধ্যে সবার জন্য ব্যাংক হিসাব করার লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব।

সানজীদা আখতার

ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহাদাত হোসেন বলেন, ব্যাংকটির মুঠোফোনে আর্থিক সেবাব্যবস্থা রকেট–এ দুই হাজার পোশাক কারখানার বেতন-ভাতা যায়। নারীরা আগে বেতনের পুরো অর্থ হাতে পেয়ে খরচ করে ফেলতেন। এখন তাঁরা প্রয়োজনমতো অর্থ তুলে খরচ করছেন, সঞ্চয় করছেন।

মুঠোফোনে আর্থিক লেনদেন প্রতিষ্ঠান বিকাশ–এর চিফ এক্সটারনাল অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) শেখ মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, বিকাশের ৬ কোটি ২০ লাখ গ্রাহকের মধ্যে নারী ৪২ শতাংশ। তবে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপনির্ভর হওয়ায় নারীদের স্মার্টফোন পাওয়া সহজলভ্য করা দরকার।

লীলা রশিদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, যে নারীদের ব্যাংক হিসাব রয়েছে, তাঁদের কেনাকাটা, সাধারণ লেনদেন, বেতন–ভাতা, সামাজিক সুরক্ষা ভাতা, ঋণ, সঞ্চয়, বিনিয়োগের মাধ্যমে মূল ধারার শ্রমবাজারে যুক্ত হওয়ার জন্য আর্থিক সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে কি না, সেটা দেখাও জরুরি।

বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন পল্লী–কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনে (পিকেএসএফ) উপমহাব্যবস্থাপক তানভীর সুলতানা, বেসরকারি হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান তরঙ্গ–এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কোহিনুর ইয়াসমীন। সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সিআরডির প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও মো. মোখলেসুর রহমান এবং ‘আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে জেন্ডার বৈষম্য’ গবেষণা দলের সদস্য আয়েশা বানু।

বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।