আমি ৩ ডিসেম্বর বিকেলে রাওয়ালপিন্ডিতে পৌঁছাই। বিমানবন্দর থেকে আমাকে সামরিক ব্যারাকের একটি অফিসে জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে নেওয়া হয়। লে. কর্নেল আমির ও লে. কর্নেল হাসান আমার দেহ তল্লাশি করে সঙ্গে যা ছিল সব নিয়ে যান। খানিক পর আরও এক লোক এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন।
সংকেতে বলা হয়েছিল, আমাকে এক বৈঠকে যোগ দিতে হবে। কিন্তু তার বদলে এমন জিজ্ঞাসাবাদে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। একপর্যায়ে রাজনীতি, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। আমাকে ছয় দফা ব্যাখ্যা করতে বলা হয় এবং এ বিষয়ে আমার নিজের মত জানতে চান তাঁরা। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৫০ জনের একটি নামের তালিকা দেখিয়ে বলেন, তাঁদের চিনি কি না।
আমি বলি, আহমদ ফজলুর রহমান সিএসপি ছাড়া অন্যদের চিনি না। তাঁরা জানান, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা ও সংহতির যে ধারণা দিয়েছেন, শেখ মুজিবুর রহমান তার বিরোধী। শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতি করতে বাধা না দিলে পাকিস্তানের অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে না। তাঁরা বলেন, ‘আমরা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সমর্থনকারী যেকোনো লোককে নিশ্চিহ্ন করে ফেলব।’
তাঁরা বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আমাকে একটি বিবৃতি দিয়ে বলতে হবে যে আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং তাঁদের উল্লেখ করা অন্য লোকদের চিনি। শেখ মুজিবুর রহমান আমার আত্মীয়। তিনি আমাকে তাঁদের দলের সমর্থনে সামরিক ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক লোকদের সংগঠিত করতে বলেছিলেন। তাঁর নির্দেশনায় আমি নেতৃত্ব দিচ্ছি। এরা ভারত থেকে আর্থিক সাহায্য লাভ করছে। ভারত উপযুক্ত সময়ে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবে। বিবৃতিতে আরও বলতে হবে, ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যোগাযোগ আছে। শেখ মুজিবুর রহমানের পেছনে স্থল, নৌ, বিমানবাহিনী ও সিভিল সার্ভিসের সিনিয়র অফিসার এবং বহু বিশিষ্ট জননেতার সমর্থন রয়েছে। আমি এই বিবৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানাই ।
রাত ১০টা পর্যন্ত এই দুই কর্নেল কখনো প্রলোভন, কখনো চাপ দিতে থাকেন। একসময় তাঁরা বলেন, আমাকে তাঁদের কবজায় থাকতে হবে। তবে আমি ভালো, না দুর্ব্যবহার পাব, তা নির্ভর করবে আমার সিদ্ধান্তের ওপর। তাঁরা আমাকে মৃত্যুর হুমকি দেন। আর মৃত্যু হলে কেউই আসল কারণ জানতে পারবে না। আবার আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেশদ্রোহের অভিযোগেও অভিযুক্ত হতে পারি। শিগগিরই শেখ মুজিবুর রহমানকে এমন একটি অভিযোগের সম্মুখীন হতে হবে। তাঁরা ভয় দেখান, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমাকেও গুলি করে হত্যা করা হবে।
আমি জানতে চাই, আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না। হলে কোন আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা জানান, নৌবাহিনীর প্রধান সেনাপতির বিশেষ ক্ষমতাবলে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আমি গ্রেপ্তারের আদেশটি দেখতে চাই এবং আইন মোতাবেক তা লিখিতভাবে আমাকে দিতে বলি। তাঁরা ভীষণ রেগে ওঠেন। কর্নেল হাসান চরম নোংরা ভাষায় আমাকে গালিগালাজ করতে শুরু করেন। কর্নেল আমির তাঁর কোমর থেকে বেল্ট খুলে আমাকে বেদম মারতে থাকেন। আমাকে একটি সেলে আটক রাখার আদেশ দেন। এই ছোট্ট কামরাটিতে আলো–বাতাস ছিল না। সেলে ঢোকানোর আগে অন্তর্বাস ছাড়া আমার সব কাপড় খুলে ফেলতে বলা হয়। রাওয়ালপিন্ডিতে তখন প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছিল। আমি কাপড়চোপড় গায়ে রাখার জন্য বারবার অনুরোধ জানাই, কিন্তু ফল হয়নি।
ভোর চারটায় ওই দুই কর্নেল আবার আমার কাছে আসেন। আমাকে সেই অফিসকক্ষে নিয়ে একই প্রস্তাব দিতে থাকেন। সেদিন পয়লা রমজান ছিল। আমি সাহ্রি চাই। আমাকে সাহ্রি করতে দেওয়া হয়নি। কর্নেল হাসান বলেন, আমি প্রকৃতপক্ষে মুসলমান কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। আমাকে জোর করে উলঙ্গ করে ফেলা হয়।
প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে এই অবস্থা চলতে থাকে। পুরো সময় আমাকে হাঁটু বাঁকিয়ে হাত ওপরে তুলে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। আমি কোনো প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে বা একটু নড়াচড়া করলে সঙ্গে সঙ্গে লাথি, ঘুষি বা লাঠি দিয়ে মারা হচ্ছিল। দুই ঘণ্টা পর আবার আমাকে সেলে পাঠানো হয়। রাওয়ালপিন্ডি পৌঁছার ৪০ ঘণ্টার বেশি সময় অনাহারে থাকার পর আমাকে প্রথম খাবার দেওয়া হয়।
ওই দুই কর্নেল রোজ সকাল-সন্ধ্যা দুবার আমার ওপর নির্যাতন চালাতে থাকেন। তাঁরা একই ধরনের প্রশ্ন করতেন ও প্রস্তাব দিতেন। একবার আমাকে চেয়ারে বসিয়ে বেঁধে আমার চোখের সামনে তীব্র বৈদ্যুতিক আলো জ্বালিয়া দেওয়া হয়। সামরিক বাহিনীতে এই আলো সাধারণত ফ্লাডলাইট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমি এ থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য কাকুতি–মিনতি করে বলি যে আমার চোখের অসুখ আছে। কিন্তু আমার আকুতি তাঁদের হৃদয়ে কোনো মমতা জাগায়নি। উপরন্তু আমার মাথা যাতে ঝুঁকে না পড়ে, সে জন্য কর্নেল হাসান আমার চুল টেনে ধরে রাখেন। আমি কখনো চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করলে সঙ্গে সঙ্গে আমার ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন চালানো হতো।
তাঁরা আমাকে বলতে বলেন, আমি ভারতে গেছি। ঢাকায় পি এন ওঝা নামের এক লোকের সঙ্গে কয়েকবার দেখা করেছি। আওয়ামী লীগ ভারতের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য লাভ করছে, এসব। আমি এসব আদৌ জানতাম না। তাই অস্বীকার করতে থাকি।
আমি খুব ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এরপর কে কখন আমাকে চেয়ারের বাঁধন থেকে মুক্ত করে, তা আমার মনে নেই। রাওয়ালপিন্ডিতে আটক থাকার সময় নির্যাতনে আরও একবার জ্ঞান হারিয়েছিলাম।
ক্রমাগত নির্যাতন ও অনাহারের ফলে এই সময় আমি এত দুর্বল হয়ে পড়ি যে পরবর্তী জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ি। তাঁদের কথামতো কাজ করতে রাজি হই। এরপর আমার ওপর অত্যাচার করা বন্ধ হয়। আমাকে কম্বল, বিছানা ও খাবার দেওয়া হয়। ওই দুই লে. কর্নেল জানান, ঢাকায় আমার বিবৃতি লেখা হবে, তাঁরাও আমার সঙ্গে যাবেন।
আমাকে ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রের সেলে আটকে রাখা হয়। সন্ধ্যায় দুই লে. কর্নেল একটি লিখিত বিবৃতি দিয়ে তা পড়ে পরদিন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বলার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। রাওয়ালপিন্ডিতে যা বলা হয়েছিল, বিবৃতিতে তা–ই লেখা ছিল। এতে সই করার মানে কেবল আমার নিজেরই নয়, বরং জীবনে যাঁদের কখনো দেখিনি, তাঁদেরও নিশ্চিত মৃত্যু ডেকে আনা। ফলে আমি এই বিবৃতি দেব না বলে স্থির করি।
পরদিন আমার এই সিদ্ধান্তের কথা জানাই। তারপর থেকে আমার ওপর ক্রমাগত নির্যাতন চালানো হয়। এরপর আমাকে ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেটের ব্রিগেডিয়ার আকবর এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের রিজভির কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের কাছে আমার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানোর অভিযোগ করি। আমার অভিযোগে কান না দিয়ে তিনি বলেন, আমি কয়েকটি চিঠি লিখতে রাজি হলে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিবৃতি দেওয়ার জন্য চাপ দেবেন না। বাড়ি যেতে দেবেন। নানা বিষয় ভেবে আমি চিঠি লিখতে রাজি হই। ব্রিগেডিয়ারের নির্দেশে আমাকে তৃতীয় পাঞ্জাব অফিসার্স মেসে রাখা হয়।
সেখানে ছিলেন মেজর নাসের। আমাকে ইংরেজিতে টাইপ করা কয়েকটি কাগজ দিয়ে তা চিঠির আকারে বাংলায় লিখতে বলা হয়। বিবৃতির বক্তব্য আর এই লেখাগুলোর বক্তব৵ একই। মুহূর্তের মধ্যে আমার মুক্তি পাওয়ার সব আশা নিভে যায়। চিঠি লিখতে অস্বীকৃতি জানাই। শুরু হয় আবার নির্যাতন। শেষ পর্যন্ত আমার অবস্থা এমন হয়ে পড়ে যে নিজে চলতে পারতাম না। আমাকে কয়েকজন ধরাধরি করে মেসে নিয়ে যেত।
এক রাতে লে. কর্নেল আমির আমার মুখে এমন জোরে ঘুষি মারেন যে আমার একটি দাঁত গোড়া থেকে আলগা হয়ে যায়। পরে দাঁতটি পড়ে যায়। মেসে একজন ডাক্তার আমাকে দেখতে আসেন। পরীক্ষা করার পর তিনি ডিউটি অফিসারকে জানান, আমাকে নড়াচড়া করতে দেওয়া যাবে না। আমার ভীষণ জ্বর এসেছিল। পুরো মুখমণ্ডল ফোলা, ক্ষতবিক্ষত। আর সারা গায়ের অবস্থার কথা নাহয় না–ই বললাম। ডাক্তারের পরামর্শের ফলেই হোক, অথবা অন্য কোনো কারণে; এরপর আর কোনো শারীরিক অত্যাচার হয়নি।
১৯৬৮ সালের ১২ জানুয়ারি শরিফ নামের পাকিস্তান নৌবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট জানান, আমার চাকরি অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল কর্তৃপক্ষ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সেদিনই আমাকে চট্টগ্রামে এনে একটি ছোট মালঘরে আটকে রাখা হয়। এক সপ্তাহ নৌবাহিনীর হেফাজতে ছিলাম। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আমাকে বিবৃতি দিতে চাপ দেওয়া হয়। বলা হয়, আমি যদি বিবৃতি দিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করি, তাহলে নৌবাহিনী আমাকে সাহায্য করবে। তাতে আমি ক্ষমা পেতে পারি। নৌবাহিনীর হেফাজতে থাকার সময় আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়নি বটে, কিন্তু আলোচনার অজুহাতে রোজ রাতে বসিয়ে রাখা হতো। ঘুমানোর সুযোগ পেতাম না। (সংক্ষেপিত)
মোয়াজ্জেম হোসেন: লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ২ নম্বর আসামি।
সূত্র: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য আসামিদের জবানবন্দি (প্রথম খণ্ড)। খোশরোজ কিতাব মহল, ঢাকা