ইটভাটার বিষে আম-কলা কিছুই থাকছে না

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার দীঘলকান্দি গ্রামের এই ইটভাটার বিষে নষ্ট হচ্ছে ফসল । গত রোববার দুপুরে এস বি এফ সুপার ব্রিক ফিল্ড-১–এ
ছবি: প্রথম আলো

আমগাছে আম ধরেছে, এখন পচে পড়ে যাচ্ছে। কলাগাছে কলা ধরেছে, কিন্তু গাছের পাতা পুড়ে কালো হয়ে যাচ্ছে। গমের শিষ হয়েছিল, কিন্তু কালচে রং ধরে ফলন ভালো হয়নি। রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার দীঘলকান্দি গ্রামের একটি ইটভাটা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়ায় কৃষকদের ফসলের এমন ক্ষতি হয়েছে।

আম ও কলাবাগান এবং গমখেত থেকে দীঘলকান্দির ইটভাটাটি মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে। ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় ওই এলাকায় ৬৪টি আমগাছ এবং ৪টি কলাবাগানের সাড়ে ৫০০ কলার ঝাড়ের ক্ষতি হয়েছে। আমগাছগুলো ৬ লাখ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা ছিল। আর কলাগাছের ক্ষতি ৪০ হাজার টাকার বেশি হবে বলে চাষিরা জানান।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন–২০১৩–এর ৮ ধারায়  বলা হয়েছে, কৃষিজমি, আবাসিক এলাকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না।  

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক উদ্ভিদবিজ্ঞানী এম মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ইটভাটায় কয়লা পোড়ানোর কারণে ছাইয়ের কণা বের হয়ে গাছের পাতার ওপরে পড়ে আস্তরণ তৈরি করে। একে কার্বন শুট বলে। এতে সালোকসংশ্লেষণ বন্ধ হয়ে গাছের পাতা মারা যায়। আবার বৃষ্টি হলে তা পানির সঙ্গে মিশে কার্বলিক অ্যাসিড তৈরি করে। তাতেও গাছের পাতা মারা যায়। কার্বলিক অ্যাসিড আমের গায়ে পড়ে নিচের দিকে ফোটার মতো জমে থাকে। পরে সেখান থেকে পচন শুরু হয়। এভাবেই ইটভাটা থেকে নির্গত কার্বন ডাই–অক্সাইড ও সালফার ডাই–অক্সাইড ফসলের ক্ষতি করে।

ইটভাটাটির মালিকের নাম ছৈমুদ্দিন। তাঁর বাড়ি ও ইটভাটা পুঠিয়ার দীঘলকান্দি গ্রামে। ভাটার নাম এসবিএফ সুপার ব্রিকস ফিল্ড-১। এ ছাড়া পাশের বানেশ্বর-চারঘাট সড়কের পাশে শিশাতলায় তাঁর এসবিএফ সুপার ব্রিকস ফিল্ড-২ নামে আরেকটি ভাটা রয়েছে।
রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট ১২৫টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২৬টির কাগজপত্র হালনাগাদ করা ছিল। বাকিগুলোকে অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। আর এই ২৬টিকেও আরও কিছু শর্ত দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। শর্ত পূরণে ব্যর্থ ইটভাটাগুলোতে তাদের অভিযান চলছে। এই ২৬টি ভাটার মধ্যে এসবিএফ সুপার ব্রিকস ফিল্ড-১ ও এসবিএফ সুপার ব্রিকস ফিল্ড-২–এর নাম নেই।

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার দীঘলকান্দি গ্রামের একটি ইটভাটার বিষে নষ্ট হওয়া আম। গত রোববার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

এই ইটভাটার ক্ষতিকর প্রভাবে ফসলসহ স্থানীয় দীঘলকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শ্বাসকষ্ট এবং স্থানীয় লোকজনের নানা ধরনের স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কায় এলাকাবাসী রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালকের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। ভুক্তভোগী চাষিরাও পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তারপরও এ বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি।

২৪ এপ্রিল দুপুরে দিঘলকান্দি গ্রামে গিয়ে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। দেখা যায়, ভাটার উত্তর পাশের বাগানের আমের নিচের দিক থেকে পচন ধরেছে। কোনোটির পুরো অংশই পচে ঝরে পড়েছে। কোনোটি এখনো পচা অবস্থায় গাছের ডালে ঝুলে আছে।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা খন্দকার হাবিবুল আলম ও মো. হাসান ওয়ালি উল্লাহ আমগুলো পরীক্ষা করে দেখছেন। তাঁরা বললেন, ইটাভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণেই আমের এই ক্ষতি হয়েছে।

সেখানেই পাওয়া যায়, আম বাগানের মালিক আবু সুফিয়ানকে। কিন্তু তিনি কোনো কথা বলতে চান না। আমবাগান নিয়ে সমস্যার কথা তুললে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘আমরা সমস্যায় থাকলে আপনাদের কী?’

পাশ থেকে একজন লোক বললেন, এই ইটভাটা নিয়ে অভিযোগ করার কারণে বাগানমালিকদের নামে ২০ লাখ টাকার চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। এ জন্য তাঁরা কোনো কথা বলতে চাচ্ছেন না।

ভাটার উত্তর ও পশ্চিম পাশে চার-পাঁচটি কলাবাগান রয়েছে। সব গাছেই কলা ধরেছে। কিন্তু গাছের পাতা পুড়ে কালো হয়ে গেছে।

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা খন্দকার হাবিবুল আলম কালো পাতাগুলো দেখিয়ে বললেন, এগুলো ইটভাটার ধোঁয়ার কারণে হয়েছে। এই গাছগুলো এখন নষ্ট হয়ে যাবে।

ভাটার পাশেই মালিকের ছেলে শাহাবুদ্দিনকে পাওয়া গেল। তাঁর দাবি, তাঁদের ভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র আছে। দেখতে চাইলে তিনি বললেন, এ অবস্থায় দেখানো যাবে না। তিনি আরও বলেন, ভাটার দক্ষিণ পাশের আমের তো কোনো ক্ষতি হয়নি। এটাকে কী বলবেন? শুধু ভাটার কারণেই কি ক্ষতি হচ্ছে?

এ ব্যাপারে পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ বলেন, এই ভাটার বিষয়টি তিনি অবগত নন। খোঁজ নিয়ে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।