মেঝেতে পা ফেলার জায়গা নেই। শয্যা ছাড়াও পুরো মেঝে রোগীতে ঠাসা। রোগীর শয্যায় দাঁড়িয়ে স্বজনেরা। অনেকের নাকে অক্সিজেনের নল। জ্বর-কাশিতে ভুগছেন সবাই।
ভর্তি হয়ে দুই দিন ধরে অবস্থান করছেন, এমন রোগীদেরও নমুনা পরীক্ষা করানো হয়নি। ফলে কে করোনায় সংক্রমিত, কে সংক্রমিত নন, তা বোঝার উপায় নেই। শুক্রবার দুপুরে এমন ভয়াবহ অবস্থা চোখে পড়ে নাটোর সদর হাসপাতালের ইয়েলো জোনে।
শুক্রবার বেলা ১১টা। নাটোর সদর হাসপাতালের প্রধান ফটকে ঢুকতেই ডান পাশের জরুরি বিভাগে রোগী ও তাঁদের স্বজনদের ভিড়। কথা বলে জানা যায়, তাঁরা জ্বর-সর্দি-শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। হাসপাতালে ভর্তি হতে চান। কিন্তু দায়িত্বরতরা ভর্তি নিচ্ছেন না।
জরুরি বিভাগের ব্রাদার ডানিয়েল হেমব্রমের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, আগন্তুক সব রোগীকে তাঁরা ভর্তি নিচ্ছেন না। পরিস্থিতি জটিল না হলে অনেক রোগীকে নিজ নিজ উপজেলা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাসপাতালের ইয়েলো জোনে ভয়াবহ অবস্থা। বৃহস্পতিবার বিকেলে ৩টা থেকে শুক্রবার বিকেল ৪টা অবধি ২৫ জন সন্দেহভাজন করোনা রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ মেঝেতেও জায়গা পাচ্ছেন না। তাঁর কথার সত্যতা খুঁজতে দোতলার কোণে ইয়েলো ওয়ার্ডে গেলাম। সেখানে ছোট একটা কক্ষে ২০টি শয্যাসহ পুরো মেঝে রোগীতে কানায় কানায় ভর্তি। দুজন নার্স পিপিই পরে রোগীদের অক্সিজেন ও ওষুধ দিচ্ছেন। তাঁদের সহযোগিতা করছেন হাসপাতালের মর্গের দুই সুইপার (পিপিই ছাড়া)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এখানকার অন্তত ২৫ জন রোগী বৃহস্পতিবার বেলা ৩টা থেকে শুক্রবার বিকেল ৪টার মধ্যে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের তখন পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা করানো হয়নি। তবে অনেকের অবস্থা জটিল। শুধু উপসর্গ দেখে চিকিৎসা চলছে। তবে সব রোগীই একে অপরকে করোনা রোগী সন্দেহ করে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন। সঙ্গে থাকা স্বজনেরা মলিন মুখে দুশ্চিন্তার প্রহর গুনছেন। কথা হয় গোলাম মোস্তফা নামের এক স্বজনের সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর বাবাকে (৬৫) তিনি বৃহস্পতিবার রাতে ভর্তি করেছেন। এখন পর্যন্ত শয্যা পাননি। নমুনাও পরীক্ষা করা হয়নি।
মেঝেতে শুয়ে থাকা বাগাতিপাড়ার মোজাম উদ্দিন (৫৬) ও সিংহারদহের মুক্তার হোসেন (৩৫) জানান, শৌচাগারের প্রবেশমুখে মেঝেতে থাকতে থাকতে তাঁদের দম বন্ধ হয়ে আসছে। দুর্গন্ধে সারা রাত ঘুমাতে পারেননি। বিকল্প জায়গা না থাকায় তাঁরা এ নিয়ে আপত্তিও করেননি। তাঁদের দাবি, এখানে ভর্তি করার সঙ্গে সঙ্গে নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার। তা না হলে তাঁরা সত্যিই করোনা রোগী কি না, তা বুঝবেন কী করে। অন্য রোগী থাকলে তাঁরাও তো এখানে এসে করোনা সংক্রমণে পড়ছেন।
এ ব্যাপারে কথা হয় দায়িত্বরত চিকিৎসক শারমিন আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, হাসপাতালে শুক্রবার সব ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষা বন্ধ থাকে। করোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রেও ছুটির দিনে পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা নেই। শনিবার সকালে অ্যান্টিজেন টেস্টের জন্য ভর্তি রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করা হবে।
তাহলে প্রায় তিন দিন সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের সহাবস্থান সবাইকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে কি না, জানতে চাওয়া হলে শারমিন আক্তার বলেন, ‘কিছুই করার নাই।’
জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ জানান, হাসপাতালে যেহেতু অ্যান্টিজেন টেস্টের ব্যবস্থা আছে, তাই সেটা ছুটির দিনে কীভাবে চালু করা যায়, তা তিনি স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে দেখবেন। এ ব্যাপারে যদি কোনো সহযোগিতা প্রয়োজন হয়, তা তিনি করবেন।
জেলার সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতি
শুক্রবারও নাটোরে সর্বোচ্চ ২২৮ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ৮৯১ জন। মৃত্যু হয়েছে মোট ৬৫ জনের। রেড জোন ও ইয়েলো জোন মিলে শতাধিক রোগী ভর্তি আছে। এ ছাড়া ২ হাজার ৭১৯ জন বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে পাঠানো পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা গেছে।