এক গ্রামেই ৩০ প্রতিবন্ধী

চৌকিবাড়ি গ্রামের প্রতিবন্ধী শিশু ইরমি (৯)। ছবি: প্রথম আলো
চৌকিবাড়ি গ্রামের প্রতিবন্ধী শিশু ইরমি (৯)। ছবি: প্রথম আলো

আর দশটা গ্রামের মতোই চৌকিবাড়ি গ্রামটা। ইট বিছানো ও মাটির সরু পথ। বেড়া বা টিনের বাড়িঘর, গাছগাছালি, ফসলের খেত। পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী ইছামতী। গ্রামের দেড় শর বেশি পরিবারের সবাই প্রায় দরিদ্র, পেশা কৃষি বা দিনমজুরি। বগুড়ার ধুনট উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের এই গ্রাম, কিন্তু একটি বিষয়ে অন্য গ্রাম থেকে আলাদা। এ গ্রামের ৩০ জন নারী, পুরুষ ও শিশু প্রতিবন্ধী।

ধুনটের কোনো গ্রামে এত প্রতিবন্ধী আছে, তা জানতই না উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়। বিস্মিত জেলার সিভিল সার্জনও। এ ঘটনা জানার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) একাধিক চিকিৎসক বলেছেন, এ সংখ্যা অস্বাভাবিক। এলাকাটি বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় আছে বলেও মনে করেন তাঁরা। এক গ্রামে এত বেশি প্রতিবন্ধী থাকার জন্য চারটি কারণও অনুমান করেছেন তাঁরা।

২০১৫ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহায়তায় বগুড়ার স্থানীয় বেসরকারি সংগঠন টিএমএসএস ধুনটে চরম দরিদ্র লোকজনের ওপর একটি জরিপ চালায়। এ সময়ই চৌকিবাড়ির এ চিত্র উঠে আসে।

প্রথম আলোর পক্ষে এ দুই প্রতিবেদক দুই দফায় চৌকিবাড়ি গ্রামে যান। গ্রামের একাধিক বাড়িতে ঘুরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা হয় তাঁদের। মোট ৩০ জন প্রতিবন্ধীর মধ্যে সুলতান (২৫) দুর্ঘটনাজনিত কারণে পা হারিয়েছেন। অন্যান্যের মধ্যে আছে দৃষ্টি ও শারীরিক প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা ১৪। যারা শারীরিক প্রতিবন্ধী, তাদের হাত-পা শুকনো হওয়ার জন্য তারা চলনশক্তিহীন। এসব প্রতিবন্ধীর বেশির ভাগই বলেছে, ছোটবেলায় তাদের টাইফয়েড হওয়ার পর দৃষ্টি চলে গেছে বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। ছয়টি শিশু এবং দুজন পূর্ণবয়স্ক আছেন, যাঁরা জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী।

ছোটবেলায় জ্বর হয়ে এভাবে প্রতিবন্ধিতা সৃষ্টি হলে বেশির ভাগই স্থানীয় হাতুড়ে চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হয়েছে। পরিবারের অবহেলায় ভালো চিকিৎসক জোটেনি। তাঁদের একজন দুই চোখেই দৃষ্টিহীন আঙুরী (২৮)। আঙুরী বললেন, ‘একবার ডাক্তার দেহাইছিলাম। কোসে যে বড় হলেই স্যারা যাইব। বাবা-মাই মর‍্যা গেছিল। ভাইয়েরা আছিল। তা ভাইয়েরা কী চিকিৎসা করব?’

পরিবেশগত দূষণ, বিশেষ করে কোনো রাসায়নিক দূষণ অনেক সময় প্রতিবন্ধিতার কারণ হয় বলে বিশেষজ্ঞরা জানান। তবে চৌকিবাড়ি গ্রামে বা এর আশপাশে কোনো কলকারখানা নেই। এ গ্রামে অতীতে বড় কোনো দূষণ ঘটেছে, এমন কথা গ্রামের প্রবীণেরা স্মরণ করতে পারেননি।

চৌকিবাড়ি গ্রামের এসব প্রতিবন্ধীর ছবি এবং ভিডিও নিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় বিএসএমএমইউয়ের ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজমে (ইপনা)। প্রতিষ্ঠানটির সহযোগী অধ্যাপক গোপেন কুমার কুণ্ডু ছবি দেখে এবং বর্ণনাগুলো শুনে এ গ্রামে প্রতিবন্ধিতার মোট চার ধরনের কারণ উল্লেখ করেন। এর মধ্যে আছে সেরিব্রাল পালসি বা প্রসবকালীন জটিলতা, নিউরোমেটাবোলিক ডিজঅর্ডার বা রক্তের সম্পর্কের মধ্যে বিয়ে, পোলিও এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা।

চৌকিবাড়ি গ্রামের প্রতিবন্ধী ছয় শিশুর বাবা-মা মামাতো, খালাতো বা ফুফাতো ভাইবোন।

বগুড়ার সিভিল সার্জন শামসুল ইসলাম বললেন, ‘এক গ্রামে এত প্রতিবন্ধী মানুষ আছে, এটা তো স্বাভাবিক না। এমন খবর তো জানি না।’