রাজশাহীর সিল্ক
এক স্বীকৃতি, নতুন সম্ভাবনা
বন্ধ থাকার ১৬ বছর পর আংশিকভাবে চালু করা হয়েছে রেশম কারখানা। এর ফলে নতুন করে রেশমের বাজার বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিক্রয়কেন্দ্রে মিলছে গরদ শাড়ি, প্রিন্টেড শাড়ি, প্রিন্টের থান, টুপিস, হিজাব, ওড়না, টাইয়ের কাপড়, স্ট্রাইপ সুপার বলাকা, ডুপিয়ান, সার্টিন ইত্যাদি।
রাজশাহীতে বেড়াতে এসে ফেরার সময় স্মৃতি হিসেবে ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী সিল্কের কাপড় নেওয়ার রেওয়াজ আজকের নয়। এই ঐতিহ্যের কারণেই সিল্ক দিয়ে রাজশাহী জেলা ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে। ব্র্যান্ডিংয়ে রাজশাহীকে বলা হয়েছে ‘সিল্ক হেভেন’। এর লোগোতে একটি বৃত্তের দুই পাশে দুটি উজ্জ্বল সোনালি বর্ণের উড়ন্ত রেশম বস্ত্রের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, রাজশাহীর উন্নয়ন রেশমশিল্পকেন্দ্রিক।
এ বছর রাজশাহী সিল্কের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতিও পেয়েছে। ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে রাজশাহী ও ঢাকার মধ্যে চলাচলকারী একটি আন্তনগর ট্রেনের নাম দেওয়া হয়েছে সিল্কসিটি এক্সপ্রেস। বন্ধ থাকার ১৬ বছর পর আংশিকভাবে চালু করা হয়েছে রেশম কারখানা। এর ফলে নতুন করে রেশমের বাজার বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বেসরকারি পর্যায়ে রাজশাহীতে সবচেয়ে বড় রেশম কারখানা সপুরা সিল্ক মিলসের পরিচালক সাজ্জাদ আলী জানান, রেশমের কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে; বিশেষ করে রেশমের শাড়ির। সারা দেশে রেশমের থান কাপড়ের ওপর হাতের কাজ করছেন প্রায় ৬০০ নারী। এ ধরনের শাড়ির কদরই বেশি। এ ছাড়া আছে রেশমের পাঞ্জাবি, শার্ট, থ্রিপিস, ফতুয়াসহ হরেক রকম পণ্য।
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সরকারি রেশম কারখানার সামনের বিক্রয় কেন্দ্রে মিলছে গরদ শাড়ি, টাইয়ের কাপড়, টাই, প্রিন্টেড শাড়ি, প্রিন্টের থান, টুপিস, হিজাব, ওড়না, স্ট্রাইপ সুপার বলাকা, ডুপিয়ান, সার্টিন ইত্যাদি।
বাংলাদেশ রেশম শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি লিয়াকত আলী জানালেন, রাজশাহী সিল্কের জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর এর চাহিদা আবার বেড়েছে। এখন তাঁরা চাহিদা অনুযায়ী কাপড় সরবরাহ করতে পারছেন না। এর কারণ সুতার স্বল্পতা। দেশে বছরে সুতার চাহিদা ৪০০ থেকে ৪৫০ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হচ্ছে ৪০ টন। চীন বছরে নয়বার সুতা উৎপাদন করছে, ভারত ছয়বার। এখন চীনের সুতা কিনতে হচ্ছে ৬ হাজার টাকা কেজিতে। ২ মাস আগেও এই সুতা ৫ হাজার টাকা কেজি ছিল। দেশের সুতা ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা কেজি। তবে দেশের সুতার মান এখনো বিদেশি সুতার মতো হয়নি। কাজ করতে গেলে ছিঁড়ে যায়। এই সুতারও মানোন্নয়ন করতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে সুতার উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা চলছে। এ খাতের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও যুক্ত করার প্রস্তাব লিয়াকত আলীর। তাঁর মতে, রেশম বোর্ডের ১১টি নার্সারি আছে। একটি নার্সারি অন্তত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া যেতে পারে। মাছ চাষে যেমন প্রণোদনা দেওয়া হয়, এ ক্ষেত্রেও তা দেওয়া হোক। এতে করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে সুতা বাইরে রপ্তানি করা যাবে। পুকুরপাড়ে রেশম চাষের ব্যবস্থা করতে পারলে পরিত্যক্ত পোকাগুলো মাছের খাবার হতে পারে। এই খাতে অন্তত ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে।
গবেষণায় যা মিলেছে
২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট জার্মপ্লাজম ব্যাংকে তুঁত জাতের সংখ্যা ৬০ থেকে ৮৩ ও রেশমকীট জাতের সংখ্যা ৮৫ হতে ১১৩ তে উন্নীত করেছে। ২৭টি উচ্চফলনশীল রেশমকীটের জাত উদ্ভাবনের ফলে প্রতি ১০০টি রোগমুক্ত ডিমে ৭০ থেকে ৭৫ কেজি রেশমগুটি উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। উচ্চফলনশীল ১৭টি তুঁতজাত উদ্ভাবনের ফলে বছরে হেক্টরপ্রতি তুঁত পাতার উৎপাদন ৪০ থেকে ৪৭ মেট্রিক টনে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে। স্বল্প সময় ও অল্প ব্যয়ে অধিক মানসম্পন্ন কাঁচা রেশম উৎপাদনের লক্ষ্যে মাল্টি অ্যান্ড রিয়ারিং ও পরীক্ষণ যন্ত্রপাতি উন্নয়ন ও উদ্ভাবন করা হয়েছে। ফলে মানসম্পন্ন কাঁচা রেশম সুতা উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে।
ইনস্টিটিউটের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রধান ফসল হিসেবে চাষিদের তুঁত চাষ করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এখন বাড়ির আনাচকানাচে, রাস্তার ধারে পরিত্যক্ত জায়গায় বেশির ভাগ তুঁত চাষ হয়। রেশম গবেষণা ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে তুঁত চাষকে জনপ্রিয় করতে সাথি ফসল প্রবর্তন করা হয়েছে। চাষিরা এভাবে চাষ করলে লাভবান হবেন।
কারখানার চিত্র
রাজশাহী নগরের শিরোইল বাস টার্মিনাল এলাকায় ১৯৬১ সালে সাড়ে ১৫ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত হয় সরকারি রেশম কারখানা। ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা ঋণের বোঝা মাথায় রেখে ২০০২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার কারখানাটি বন্ধ করে দেয়। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে বন্ধ কারখানা খোলা হয়। রেশম উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, বন্ধ ঘোষণার সময় রেশম কারখানায় মোট ৬৩টি লুম ছিল। এগুলোর মধ্যে উৎপাদন চলত পুরোনো ৩৫টি লুমে। নতুন ২৮টি লুম চালুর আগেই কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বন্ধের আগে কারখানাটি বছরে ১ লাখ ৬ হাজার মিটার রেশম কাপড় উৎপাদন করত। কারখানায় ৬৩টি লুম চালু করা গেলে বছরে কাপড় উৎপাদিত হবে ২ লাখ ৮৭ হাজার মিটার।
কারখানায় দৈনিক মজুরিভিত্তিক ৪১ জন কর্মচারী কাজ করছেন। তাঁরা প্রতি মাসে গড়ে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ গজ কাপড় উৎপাদন করছেন। তাঁদের উৎপাদিত কাপড় কারখানার বিক্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছে।
একনজরে
১৯৭৭ সালে ‘বাংলাদেশ রেশম বোর্ড’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বাংলাদেশ রেশম বোর্ড, রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং সিল্ক ফাউন্ডেশন এই তিনটি প্রতিষ্ঠানকে একীভূতকরণের মাধ্যমে পুনর্গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড’। এটি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় রাজশাহীতে অবস্থিত। রেশম বোর্ডের মাধ্যমেই বর্তমানে রেশম উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
মূলত তুঁতগাছের পাতা খেয়ে পলু পোকা (রেশমকীট) মুখ থেকে লালা নিঃসরণ করে রেশমগুটি তৈরি করে। এগুলোই সুতার গুটি। গুটি থেকে সুতা ছড়ানো হয়। এই সুতার মাধ্যমে কাপড় তৈরি করা হয়। মাঠপর্যায়ে যাঁরা তুঁতগাছ চাষ ও রেশমকীট পালনের মাধ্যমে রেশমগুটি তৈরি করেন, তাঁদের বসনি বলা হয়। দেশে এ রকম ৩ হাজার ৭০০ বসনি আছেন। দেশে সরকারিভাবে তুঁত চাষের জন্য ১১টি নার্সারি আছে। এ ছাড়া সুতা কাটাই কারখানা আছে ১৩টি। বর্তমানে বছরে সরকারিভাবে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ কেজি সুতা উৎপাদন করা হচ্ছে।