কটাক্ষের শিকার ৭০% তরুণী

ওজন, রং, কাঠামো ইত্যাদি নিয়ে তরুণীদের কটূক্তির শিকার হতেহয়। গণপরিবহনে শিকার হতে হয় যৌন হয়রানির।

শিশুকাল থেকে বড়বেলা—দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে কটাক্ষের (বডি শেমিং) হাত থেকে কোনোকালে রেহাই মেলেনি মেয়েটির। মেয়েটা এত মোটা—ছোটবেলায় শোনা এমন কথা এখনো কানে বাজে। আর একটু বড়বেলায় গায়ের ‘কালো রঙের’ জন্যও কটাক্ষ শুনতে হয়েছে তাঁকে। মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছেন দুই বছর আগে। এখন একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী, অচেনা মানুষ—কটাক্ষকারীদের মধ্যে সবাই ছিলেন।

আঁচল ফাউন্ডেশন নামের একটি সামাজিক সংগঠনের জরিপে দেখা গেছে, ৬৯ দশমিক ৯২ শতাংশ তরুণী দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আত্মীয়দের কাছে কটাক্ষের শিকার হয়েছেন বড় একটি অংশ।

‘তরুণীদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব’ শীর্ষক জরিপটি হয়েছে গত মাসে। অনলাইনে প্রশ্ন পাঠিয়ে করা এ জরিপে অংশ নেন ১ হাজার ১৪ জন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া।

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ প্রথম আলোকে বলেন, লাঞ্ছনা, যৌন হয়রানি, সমাজ ও পরিবারে প্রতিবন্ধকতা, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি—এসব তরুণীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কেমন প্রভাব ফেলেছে, তা–ও উঠে এসেছে জরিপে। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে এ জরিপ হয়েছে বলে জানায় আঁচল ফাউন্ডেশন।

জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, সারা দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগের ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণীরা এতে অংশ নেন। অংশগ্রহণকারী তরুণীদের ৮৮ শতাংশ অবিবাহিত, ১১ শতাংশ বিবাহিত এবং বাকিরা আর সংসার করছেন না।

আত্মীয়দের মুখেই বেশি কটাক্ষ

জরিপে অংশ নেওয়া ৩৭ শতাংশের বেশি তরুণী জানিয়েছেন, শরীরের আকৃতি, গঠন ও কাঠামো নিয়ে আত্মীয়রা কথা ও ইঙ্গিতে তাঁদের হেয় করেছেন। বন্ধুবান্ধবের কাছে কটাক্ষের শিকার হয়েছেন ২২ শতাংশ। পরিবারের সদস্যদের মুখে কটু মন্তব্য শুনেছেন বলে জানিয়েছেন ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ তরুণী। পথচারীদের কটাক্ষ শুনতে হয়েছে প্রায় ১২ শতাংশ তরুণীকে।

আঁচলের জরিপে দেখা যায়, বেশি কটূক্তি শুনতে হয়েছে ওজনের কারণে (৩৯ শতাংশ)। গায়ের রঙের কারণে প্রায় ৩৭ শতাংশকে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হতে হয়েছে। এ ছাড়া দৈহিক গঠন ও দাগ, কণ্ঠস্বর নিয়েও তরুণীদের বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয় বলে উঠে আসে জরিপে।

শৈশবেই নিগ্রহের শিকার

আঁচলের জরিপ অনুযায়ী, প্রায় ৩৯ শতাংশ তরুণী শৈশবে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন। এর মধ্যে আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে ৩৫ শতাংশ যৌন নিগ্রহের শিকার হন। শৈশবে অপরিচিত ব্যক্তির হাতে ভুক্তভোগী হন ২৮ শতাংশের বেশি তরুণী। তাঁরা বলেছেন, শৈশবের এসব ঘটনা তাঁদের মনে সবার প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। তাঁদের মনে পুরুষবিদ্বেষী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া ১৫ শতাংশ একা থাকতে ভয় পান। শৈশবের যৌন নির্যাতনের কারণে একজন নারীকে সারা জীবন মানসিক সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হয়।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় ৪৪ শতাংশ তরুণী অনলাইনে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে অবান্তর ও কুরুচিপূর্ণ বার্তা পাঠিয়ে এবং মন্তব্য করে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে ৬১ শতাংশকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের ‘আইডি’ হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

গণপরিবহনে যৌন হয়রানি

জরিপে আরও দেখা যায়, ৪৫ শতাংশের বেশি তরুণী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হন। এর মধ্যে বাস বা বাসস্ট্যান্ডে যৌন হয়রানির সম্মুখীন হন ৮৪ শতাংশ তরুণী। এ ছাড়া রেল বা রেলস্টেশনে এবং শরিকি যাত্রা বা রাইড শেয়ারিং সার্ভিসেও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন তরুণীরা।

গণপরিবহনে যৌন হয়রানির মধ্যে আপত্তিকর স্পর্শের শিকার হন ৬৪ শতাংশের বেশি তরুণী। ২০ শতাংশ কুদৃষ্টি এবং অনুসরণের শিকার হন।

তরুণীদের ওপর নিগ্রহের এ চিত্র বাস্তবতাকেই তুলে ধরে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাহ এহসান হাবীব। তিনি মনে করেন, নিগ্রহের হার বেড়ে চলেছে। আর এর জন্য দায়ী সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক ধারণার প্রসার ও এর পৃষ্ঠপোষকতা।

অধ্যাপক এহসান বলেন, ‘নারীর প্রতি নিগ্রহের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা দেখানোর দৃষ্টান্ত খুব কম। আবার নিগ্রহকারীরাও রাজনৈতিক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেন।’