কবরের গাছে বাবার অস্তিত্ব খোঁজে সন্তানেরা

বাবার কবরের মাটিতে জন্মানো গাছে বাবারই স্পর্শ পায় সন্তানেরা। ছবি
প্রথম আলো

শোকের সময়সীমা থাকে না। আত্মীয়স্বজন বা প্রতিবেশীদের কাছে হয়তো ম্লান হয়ে যায়। তবে নগরের জীবনের রণক্ষেত্রে নিত্য হোঁচট খাওয়া সন্তানদের কাছে প্রতিটি দিনে লেপটে থাকে বাবা হারানোর অনুভব। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছোট মেয়েটি তাই বাবার প্রসঙ্গ এলে কিছু বলতে না পেরে ফুঁপিয়ে কাঁদে।

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পরপরই ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল মারা যান সাংবাদিক হুমায়ুন কবির খোকন। তখন তিনি ছিলেন ‘দৈনিক সময়ের আলো’ পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক। এর আগে কাজ করেছেন ‘আমাদের সময়’সহ বিভিন্ন পত্রিকায়।
বড় সন্তানের এমন বিদায় দুই বছরেও মানতে পারেননি সাংবাদিক খোকনের বৃদ্ধা মা আমেনা বেগম। ছেলের মৃত্যুর পর ৭৫ বছর বয়সে দুবার স্ট্রোক করেছেন তিনি।

করোনায় চলে গেছেন খোকন। ঘরজুড়ে তাঁর স্মৃতি
ছবি: প্রথম আলো

গত বুধবার দুপুরে রাজধানীর মহাখালীর বাসায় সাংবাদিক খোকনের স্ত্রী শারমিন সুলতানার কাছে জানতে চাওয়া হলো, এখন কেমন কাটে তাঁদের ঈদ? শারমিন প্রথম আলোকে বললেন, ‘ওদের বাবা আড়ংয়ের পাঞ্জাবি খুব পছন্দ করত। রোজার প্রথম দিকে দাম একটু কম থাকে। তখন স্বামীর পাঞ্জাবিটা কিনতাম। তিন বাচ্চার পোশাক কেনা হতো বোনাসের টাকায়। ওর মৃত্যুর পর থেকে আমার বাচ্চারা কোনো ঈদেই নতুন কাপড় পরেনি। তাকে ছাড়া এটি চতুর্থ ঈদ। আগেরগুলো গিয়েছে করোনার আতঙ্কে। এখনকার ঈদ হারানোর স্মৃতি নিয়ে। উৎসব শেষ হয়ে গেছে এ বাড়িতে।’
তিন সন্তান নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন শারমিন সুলতানা। তিনি বলেন, ভাড়া বাড়ির খরচসহ চারজন মানুষের এই শহরে টিকে থাকার চেষ্টাটাই খুব কঠিন। সম্প্রতি ছেলে আশরাফুল আবিরের স্নাতক শেষ হয়েছে। একটা চাকরি পেলে হয়তো জীবনটা একটু সহজ হবে। ছোট মেয়ে মেহরিন নাফিসা বনানীর সাউথ পয়েন্ট স্কুলের ছাত্রী। প্রতি রাতে পত্রিকার দ্বিতীয় সংস্করণ ছেড়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হতো বাবার। দেখা হতো না মেয়ের সঙ্গে। তবে পরদিন খুব সকালে নাফিসা স্কুলে যাওয়ার আগে তৈরি হয়ে যেতেন খোকন। রিকশায় করে যাওয়ার সময় অনেক গল্প হতো বাবা-মেয়ের।

মাত্র ৫০ বছর বয়সেই চলে গেছেন সাংবাদিক খোকন
ফাইল ছবি

নাফিসা বলছিল, ‘আমি সকালের অপেক্ষা করতাম। আগের দিন জমিয়ে রাখা সব গোপন কথা তখন বাবাকে বলতাম। বাবা কোনো দিন আমাকে বকেনি। আসলে সে ছিল আমার বন্ধু। এখন ওই সময়ে মা নিয়ে যায় স্কুলে। সহপাঠীদের বাবারা আসে স্কুলের গেটের সামনে। বাবার হাত ছেড়ে ওরা দৌড়ে ভেতরে ঢোকে, তখন নিজেকে সামলাতে পারি না। প্রতিদিন মনে হয়, এই ঘটনা আর কোনো দিন ঘটবে না আমার জীবনে।’
২০২০ সালে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে যান খোকন। করোনার সব উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির কিছুক্ষণের মধ্যে হৃদ্‌রোগে তিনি মারা যান। তিনি কোভিড পজিটিভ ছিলেন। দুদিন পর স্ত্রী শারমিন ও ছেলের করোনা শনাক্ত হয়। স্বামীর মৃত্যুর কষ্টটা সয়ে নেওয়ার সময় সন্তানসহ নিজেকেই দুই সপ্তাহ হাসপাতালে লড়াই করতে হয়েছে শারমিনকে। কয়েক দিন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রেও (আইসিইউ) থাকতে হয়েছে তাঁকে।

এখন চারজন মানুষের সংসার পুরোপুরি নির্ভরশীল বড় মেয়ের উপার্জনে। টিকে থাকার জন্য মহাখালীর ভাড়া বাসায় লড়াই করতে হচ্ছে এই পরিবারকে। প্রতি মাসে ভয় থাকে, মাস শেষে ভাড়াটা দেওয়া সম্ভব হবে তো!

শারমিন সুলতানা বলেন ‘আত্মীয়রা সহযোগিতা করে বলে এখনো মরে যাইনি। কিন্তু তাদের সাহায্য বেঁচে থাকার জন্য। ঈদ উৎসবে বিলাসিতার জন্য না। তাঁরাও বা কত দিন দেবে? নিজেদের সংসার আছে।’

স্বামীর স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন শারমিন সুলতানা
ছবি: প্রথম আলো

কথা বলতে বলতে চোখ গেল তাঁর নাকের বড় নাকফুলটার দিকে। শারমিন জানালেন, স্বামীর মৃত্যুর কিছুদিন আগে নাকে ইনফেকশন হয়েছিল। তখন গয়নাটি খুলে রাখতে চেয়েছিলেন। খোকন বলেছিলেন, ‘তোমার নাকফুলে আমার আয়ু আছে।’সেই স্মৃতি মনে পড়তেই আর কথা আগায় না। ঘরজুড়ে নিস্তব্ধতা আর ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখা পরিবারের বিভিন্ন সময়ের স্মৃতি। কোনো ছবিতে খোকন সন্তানকে আদর করছেন, কোনো ছবিতে গ্রামের বাড়ির পুকুরপাড়ে পুরো পরিবারের হাস্যোজ্জ্বল মুখ। একপাশে বইয়ের তাকে গুছিয়ে রাখা সাংবাদিক খোকনের পাওয়া বিভিন্ন সম্মাননা। তাকে বেশ কিছু বই জমিয়ে রাখা।

নিস্তব্ধতা ভাঙতে ভেতরের ঘর থেকে ছোট্ট একটি কাচের গ্লাস নিয়ে এল নাফিসা। বসার ঘরের সেন্টার টেবিলটার মাঝখানে রেখে জানাল, এই গাছ স্পর্শ করলে বাবার অস্তিত্বের মতো মনে হয়। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে তাদের কোনো ঈদ-ই কান্না ছাড়া আসেনি। জীবনের সব আনন্দ হারিয়ে গেছে বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে।

বাবার কবরের গাছের ডাল থেকে জন্মেছে এই গাছ
ছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লার মুরাদনগরে বাবার কবরের মাটিতে গাছ লাগিয়েছে ওরা তিন ভাইবোন। সেখান থেকে নিয়ে আসা একটি ছোট্ট ডাল থেকে শিকড় জন্মে হয়েছে নতুন গাছ। সন্তানদের কাছে ছোট্ট এই অর্কিডই এখন বাবার অস্তিত্বের মতো। রোজ তাতে পানি দেওয়া হয়। রেখে আসা হয় বারান্দায়। আবার ঝড়বৃষ্টি এলে দৌড়ে ঘরের ভেতর আনা হয় কাচের গ্লাসে রাখা কয়েকটি পাতার ছোট্ট গাছটিকে।