কবিতায় জাতির আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরেছেন শামসুর রাহমান

কবি শামসুর রাহমানের ৯৩তম জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে আলোচনাসভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন অধ্যাপক খালেদ হোসাইন। মঞ্চে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ও সচিব এ এইচ এম লোকমান। রোববার বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে
ছবি: বাংলা একাডেমি

কবি শামসুর রাহমান আধুনিক বাংলা কবিতার যে ধারা সৃষ্টি করেছেন, তা অব্যাহত আছে। সব সময় তিনি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, জীবনবোধের দিকে মানুষকে আহ্বান করেছেন। জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে উপলব্ধি করেছেন। এ জন্য একটি নিজস্ব বাগ্‌ভঙ্গি সৃষ্টি করতে সফল হয়েছেন তিনি। বাংলা সাহিত্যকে কবি শামসুর রাহমান যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, আগামী প্রজন্ম তা আরও এগিয়ে নেবে।

কবি শামসুর রাহমানের ৯৩তম জন্মদিন উপলক্ষে আজ রোববার সকালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। একই সঙ্গে তাঁরা স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু, সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে উপেক্ষা করে নিজের বিশ্বাসের জায়গায় কবির অনড় থাকার দিকটিও তুলে ধরেন।

গতকাল শনিবার ছিল কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিন। এ উপলক্ষে কবির নামাঙ্কিত একাডেমির শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। একক আলোচক ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও কবি খালেদ হোসাইন। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির সচিব এ এইচ এম লোকমান, সভাপতিত্ব করেন মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে রচিত শামসুর রাহমানের কবিতা ‘মাথায় যার ইতিহাসের জ্যোতির্বলয়’ আবৃত্তি করেন ডালিয়া আহমেদ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কাজী রুমানা আহমেদ।

খালেদ হোসাইন তাঁর দীর্ঘ আলোচনায় বাংলা কবিতা এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের আলোকে শামসুর রাহমানের অবস্থান ও অবদানের মূল্যায়ন করেন। তিনি বলেন, শামসুর রাহমানের জন্ম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে। তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, বাঙালির মাতৃভাষা সংগ্রাম, স্বাধিকার আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরে ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তন, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনসহ দেশ ও জাতির ইতিহাসের প্রধান রাজনৈতিক বাঁকবদলগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন। দেশের ইতিহাসকে আত্মস্থ করেছেন।

জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে উপলব্ধি করেছেন। সেই ইতিহাস ও উপলব্ধিকে নান্দনিকরূপে পরিস্ফুটিত করে উপহার দিয়েছেন অজস্র কবিতায়। তিনি জনগণের জন্য সাহিত্য রচনা করেছেন। সে জন্য একটি নিজস্ব বাগ্‌ভঙ্গি সৃষ্টি করতে সফল হয়েছেন। তাঁর সেই ভাষা সাবলীল, শাণিত, সতেজ, সহজবোধ্য অথচ তা শৈল্পিক সৌন্দর্যে সুষমামণ্ডিত। ফলে তাঁর কবিতার ভাষা, চিত্রকল্প কখনোই আরোপিত মনে হয় না—এখানেই তাঁর অনন্যতা।

খালেদ হোসাইন বলেন, ‘শামসুর রাহমান তাঁর প্রথম জীবনে যে ব্যক্তিগত রোমান্টিকতায় নিমগ্ন ছিলেন, অচিরেই তা সামষ্টিক পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে। তিনি তাঁর পরিপার্শ্বকে সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছেন, যা আমাদের ন্যায্য প্রাপ্য, তার জন্য দৃঢ়, অনমনীয় থেকেছেন। সব সময় তিনি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, জীবনবোধের দিকে আহ্বান করেছেন। কবি শামসুর রাহমান আমাদের প্রধান আধুনিক কবি হিসেবেই দীপ্তিমান থাকবেন।’

স্বাগত বক্তব্যে এ এইচ লোকমান বলেন, রবীন্দ্র-উত্তর যুগে ত্রিশের দশকে বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার সূচনা হয়েছিল, পঞ্চাশের দশকে এসে কবি শামসুর রাহমান সেই আধুনিকতার প্রধান কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব যথার্থই তাঁকে ‘কবিশ্রেষ্ঠ’ অভিধায় ভূষিত করেছে। তবে তিনি কেবল কাব্যচর্চার ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, জাতির সংকটকালে পথে নেমেও গণ-আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। তিনি স্বল্পভাষী এবং স্বভাবত লাজুক ছিলেন, কিন্তু প্রয়োজনের সময় হয়ে উঠেছেন অনমনীয়। ষাটের দশকে যখন রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব উঠেছিল, তিনি তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন, রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। আবার নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে তিনি চাকরিচ্যুত হয়েছেন, সাম্প্রদায়িক শক্তি তাঁর প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে—এসব সত্ত্বেও তিনি তাঁর বিশ্বাসের জায়গায় অনড় থেকেছেন।

সভাপতির বক্তব্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘কবি শামসুর রাহমান তাঁর কাব্যে এ দেশের জনগণের অভিপ্রায়ের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁকে আমরা রাইটার্স ক্লাবের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিসত্তার “কবিশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করেছি। তিনি বাংলায় কাব্য রচনা করেছেন, সে কারণে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে তাঁর কাব্যের বিপুল বিস্তৃতি ঘটেনি। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় এমন অনেক কবি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, যাঁদের কবিতার চেয়ে শামসুর রাহমানের কাব্যের ভাবগত গভীরতা, সৌন্দর্য, সৃজনশীলতা বা মৌলিকতা কোনো অংশেই কম নয়।’

নূরুল হুদা বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে। তাঁর কবিতা সেই সময়ের আন্দোলন ও ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে। অনেক সময় তিনি স্পষ্ট করে অনেক কথা বলতে পারেননি, রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। এর ভেতর দিয়ে তিনি একটি বাগ্‌ভঙ্গি সৃষ্টি করেছেন। জাতির কাব্যিক ইতিহাস নির্মাণ করেছেন। তাঁকে সম্মান জানানো প্রকৃতপক্ষে আমাদের নিজেদেরই সম্মানিত করা বলে মন্তব্য করেন কবি নূরুল হুদা।