রাজধানীর এক কর্মজীবী নারীর (৪৫) ডায়াবেটিস শনাক্ত হয় ২০১৯ সালের শেষ দিকে। ২০২০ সালের আগস্টে তিনি কোভিডে আক্রান্ত হন। সুস্থ হওয়ার একপর্যায়ে তাঁর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা প্রতি লিটারে ১৪ মিলিমোলে উঠে যায়। ওষুধ সেবনে নিয়ন্ত্রণ এলেও গত বছরের শুরু থেকে তাঁর পিঠে ব্যথা, দাঁতে সমস্যা, দুর্বলতা, ফুসফুসে সমস্যা, মাসিকে সমস্যার মতো নানাবিধ শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। এ বছরের জানুয়ারিতে তিনি দ্বিতীয়বার কোভিডে আক্রান্ত হন। ওই নারী বলেন, ‘করোনাকালে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নিয়ম মেনে চলতে পারেননি। এখন দুবেলা ইনসুলিন নিয়েও গ্লুকোজের মাত্রা ১৪–এর নিচে নামে না।’
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, খাওয়ার আগে প্রতি লিটারে ৪.২ থেকে ৭.২ মিলিমোল এবং খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর ১০ মিলিমোলের নিচে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা থাকা উচিত।
নিয়মিত চিকিৎসায় সব ধরনের ডায়াবেটিস যথাযথ নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব।
করোনাকালে অনেক ডায়াবেটিস রোগী কোভিডে আক্রান্ত হয়ে নানা শারীরিক জটিলতা ও নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিসের সম্মুখীন হয়েছেন। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির তথ্য অনুসারে, সারা দেশে সমিতির আওতাভুক্ত ১১৩টি শাখায় ২০২০–২১ অর্থবছরে অর্থাৎ করোনাকালে সাড়ে তিন লাখ নতুন ডায়াবেটিস রোগী নিবন্ধিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সমিতিতে এ নিয়ে নিবন্ধিত রোগীর সংখ্যা ৫৬ লাখ ২৬ হাজার। ২০১৯–২০ অর্থবছরে নতুন রোগী ছিল ৩ লাখের কিছু বেশি। করোনাকালে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত না হলে নতুন রোগীর সংখ্যা আরও বেশি হতো বলে মনে করছে সমিতি। কারণ, করোনাকালের আগে ২০১৭–১৮ এবং ২০১৮–১৯ অর্থবছরে নতুন রোগী যথাক্রমে ৫ লাখ ও ৪ লাখ ৮৫ হাজার বেড়েছিল। গত সাত বছরে দেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, ৩০ লাখ থেকে ৫৬ লাখে দাঁড়িয়েছে।
করোনাকালে ডায়াবেটিস সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্য নিয়ে আজ ২৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার পালন করা হচ্ছে ‘ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস’ ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ৬৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৫৬ সালের এই দিনে জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমসহ কয়েকজন বিশিষ্ট সমাজসেবকের উদ্যোগে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও করোনা প্রতিরোধে সচেতন হোন’।
রোগীদের ঝুঁকিতে ফেলছে কোভিড
করোনাকালে ডায়াবেটিসের রোগীদের চিকিৎসার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বারডেম একাডেমির পরিচালক অধ্যাপক মো. ফারুক পাঠান প্রথম আলোকে বলেন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণহীন হলে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর অবস্থা আরও গুরুতর হয়। কোভিডের ঢেউ বেশি থাকার সময় বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডায়াবেটিসের রোগীদের ৬০ শতাংশ কোভিডে আক্রান্ত ছিলেন। বেশির ভাগ রোগীর ফুসফুস আক্রান্ত হয়েছে এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি লেগেছে।
অধ্যাপক ফারুক পাঠান আরও বলেন, ডায়াবেটিস রোগীদের রক্ত জমাট বাঁধার যে প্রবণতা রয়েছে, কোভিড তা আরও বাড়িয়ে তোলে। এ কারণে হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
গতকাল রোববার দুপুরে রাজধানীর শাহবাগে বারডেম জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগ এবং সাধারণ ওয়ার্ড ৬২, ৬৩ এবং নারী সার্জারি ওয়ার্ড ঘুরে ১২ জন ডায়াবেটিস রোগীর সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের বেশির ভাগই দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছেন। রাজধানীর নবাবগঞ্জ থেকে আসা এক বয়স্ক রোগীর ভাতিজা বলেন, চার মাস ধরে তাঁর চাচার শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ। বৃহস্পতিবার গ্লুকোজের মাত্রা লিটারে ৪৫ মিলিমোলে উঠে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করেছেন।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ৮৪ লাখ ডায়াবেটিস রোগী আছেন। তবে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি এক জরিপের ভিত্তিতে মনে করে, এ সংখ্যা অনেক বেশি। অনেকে জানেনই না তাঁদের ডায়াবেটিস আছে। ২০১৮ সালে সমিতি সারা দেশে ২৫ বছরের বেশি বয়সী এক লাখ নারী–পুরুষের ওপর জরিপ চালিয়ে এক–চতুর্থাংশ ব্যক্তির ডায়াবেটিস শনাক্ত করে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কোভিড ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীরা সাধারণভাবে যেসব সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেন, তা এখন আরও জোরেশোরে নিতে হবে। নিয়মিত চিকিৎসায় সব ধরনের ডায়াবেটিস যথাযথ নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব। পরিমিত আহার, হাঁটাহাঁটি, হালকা ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম করতে হবে।