কাজে ও ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত নারী

কে এম আব্দুস সালাম, ফেরদৌস আরা বেগম, পারভীন মাহমুদ, কোহিনুর ইয়াসমিন, রোকেয়া রফিক, নাজনীন আহমেদ, আসিফ সালেহ, শামেরান আবেদ, কে এ এম মোর্শেদ, নবনীতা চৌধুরী

অংশগ্রহণকারী

কে এম আব্দুস সালাম

সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়

ফেরদৌস আরা বেগম

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)

পারভীন মাহমুদ

চেয়ারপারসন, ইউসেপ এবং সাবেক চেয়ারপারসন মাইডাস।

কোহিনুর ইয়াসমিন

রপ্তানিকারক উদ্যোক্তা, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, তরঙ্গ

রোকেয়া রফিক

নির্বাহী পরিচালক, কর্মজীবী নারী

নাজনীন আহমেদ

অর্থনীতিবিদ; সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বিআইডিএস

আসিফ সালেহ

নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক

শামেরান আবেদ

ঊর্ধ্বতন পরিচালক, মাইক্রোফাইন্যান্স ও আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন, ব্র্যাক

কে এ এম মোর্শেদ

ঊর্ধ্বতন পরিচালক, অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ, ব্র্যাক

সঞ্চালনা

নবনীতা চৌধুরী

পরিচালক, জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি, ব্র্যাক

নবনীতা চৌধুরী

নবনীতা চৌধুরী

‘কাজে ও ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত নারী’ শীর্ষক ব্র্যাক সংলাপে আপনাদের স্বাগত জানাই। যেকোনো দুর্যোগে নারী সামাজিক, অর্থনৈতিক-সব দিক দিয়েই বেশি ক্ষতির মুখে পড়েন। কিন্তু প্রায়শই ক্ষতির আলোচনা ও পরিসংখ্যানে নারীর সংখ্যার ব্যাপকতা ও কঠিন পরিস্থিতি আলাদা করে তুলে না ধরায় তা একরকম স্বীকৃতির বাইরেই থেকে যায়। এ অবস্থায় অর্থনীতিতে যে দুটো খাতে নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি—সেই কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের নারী উদ্যোক্তা এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের নারী কর্মীদের ওপর যে ধাক্কা লেগেছে, তার একটা পরিসংখ্যানগত ধারণা পেতে ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস ডাইভারসিটি কর্মসূচি অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ বিভাগের সহায়তায় একটি গবেষণা পরিচালনা করে। শুরুতেই কে এ এম মোর্শেদকে আমন্ত্রণ জানাব খুব সংক্ষেপে এই গবেষণার উদ্দেশ্য প্রক্রিয়া ও তা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল জানাতে।

কে এ এম মোর্শেদ

কে এ এম মোর্শেদ

৮-২৪ জুলাই এই জরিপ করা হয়েছে সিএম-এসএমই (কটেজ, মাইক্রো, স্মল ও মিডিয়াম) নারী উদ্যোক্তা এবং অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মজীবী নারীদের পরিস্থিতি বুঝতে। এতে ১ হাজার ৫৮৯ জন রেসপনডেন্ট ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১ হাজার অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মজীবী নারী এবং বাকি ৫৭৯ জন বিভিন্ন কটেজ, ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্পের নারী উদ্যোক্তা। এর বাইরেও আমরা আরও ৩০ জন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলেছি। ১০টা অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক খাত আমাদের এই আলোচনায় ছিল। উত্তরদাতাদের গড় বয়স ছিল ৩৫ বছর। তাঁদের ২৬ শতাংশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আছে। ৮টি বিভাগের ২৮টি জেলায় এ জরিপ করা হয়েছে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিউটি পারলার, গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ যেমন ছিল, কর্মীদের মধ্যে টেইলর ও বিউটি পারলারের কর্মীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি।তাঁদের অন্তত ৫০ শতাংশ বলেছেন যে তাঁদের মূলধনের একটা উৎস হচ্ছে এনজিও। ব্যাংকের ইনভলভমেন্ট ২৩ শতাংশ। যদিও যারা মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ, তাদের ৭০ শতাংশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। স্মল এন্টারপ্রাইজ ৩০ শতাংশ। তবে বড় অংশের মূলধনের একটা অংশ এসেছে ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে। ৯০ শতাংশ উদ্যোক্তা, ৮০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মী বলেছেন, কোভিডের ফলে তাঁদের ক্ষতি হয়েছে। অনলাইন শপ, গার্মেন্টসে ক্ষতি অনেক বেশি হয়েছে। নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায়, নির্মাণশ্রমিকেরা সমস্যায় পড়েছেন। সবারই দুই-তৃতীয়াংশ আয় কমেছে।

সরকার ২০ হাজার কোটি টাকার একটা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল। এক হাজার কোটি টাকা আলাদা করে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল। এ জরিপ যখন শেষ হয়, জুলাইয়ের শেষের দিকে, তখনো নারী ও পুরুষ মিলিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকার ১০ শতাংশের মতো বণ্টন করা হয়েছে। প্যাকেজটা কী, কীভাবে পেতে হয়, জিজ্ঞেস করায় দুই-তৃতীয়াংশ বলেছেন, তাঁরা এ প্যাকেজ সম্পর্কে জানেনই না। ৫৬ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা আসলে চেষ্টাই করেননি। যাঁরা জানেন কিন্তু চেষ্টা করেননি, তাঁরা মনে করছেন, সুদের হার বেশি হবে, ব্যাংক সহযোগিতা করবে না কিংবা তাঁদের ট্রেড লাইসেন্স নেই। যাঁরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, তাঁদের জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের সোশ্যাল সেফটি কর্মসূচি নিয়েছে, সেখানেও ৫৭ ভাগ কোনো কিছু পাননি। তাঁদের বেশির ভাগই ‘নিউ পুওর’। কোভিডের আগে তাঁরা দরিদ্র ছিলেন না, তাই সামাজিক সুরক্ষা খাতের তালিকায় তাঁদের নাম ছিল না। যেহেতু নাম ছিল না, তাই তাঁরা কোনো খাবার পাননি। যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই শহরের।

তাঁরা এই পরিস্থিতি কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছেন? সবচেয়ে প্রচলিত উত্তর হলো, খাবারের ব্যয় কমিয়ে দেওয়া। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৫ শতাংশের খাবারের ব্যয় কমেছে। কর্মজীবীদের ১৪ শতাংশের খাবারের ব্যয় কমেছে। শ্রমজীবীদের একটা বড় অংশ বলেছেন, তাঁরা লোকজনের (আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব) কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছেন । এর বাইরে সঞ্চয় বা আগের সম্পদ বিক্রি করেছেন-এমন সংখ্যা ১৮ শতাংশ। বিভিন্ন ব্যাংক বা এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন ৯ শতাংশ উদ্যোক্তা ও ৩ শতাংশ শ্রমজীবী। ৪১ শতাংশ উদ্যোক্তার কর্মী ছাঁটাই করতে হবে। সুখবর হচ্ছে, ৭৭ ভাগ উদ্যোক্তাই বলছেন, অবস্থা ভালো হলে তাঁরা আগের ব্যবসায় ফিরে যাবেন। ৭৯ ভাগ শ্রমজীবী বলেছেন, তাঁরা আগের কাজেই ফিরে আসবেন। তাঁদের এখনো আশা আছে। একটা ভালো দিক হলো উদ্যোক্তা ও শ্রমজীবী—সবাই কাজে ফেরার পূর্বশর্ত হিসেবে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার ওপর জোর দিচ্ছেন। কী ধরনের সাহায্য তাঁরা চান?

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৮৩ শতাংশ শ্রমজীবী ও ৫৬ শতাংশ উদ্যোক্তা নগদ সাহায্য চান। ঋণ চাচ্ছেন উদ্যোক্তাদের ৭৯ শতাংশ। শ্রমজীবীদের ২২ শতাংশ সাহায্য অথবা ব্যাংক কিংবা এনজিও থেকে ঋণ চান।

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের কোনো তথ্যভান্ডার নেই। আমাদের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ম্যানুয়ালে নারীর বিশেষ প্রয়োজনের কথা সেভাবে উল্লেখ নেই। নারী উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের তথ্যভান্ডার তৈরি করলে তাদের কাছে পৌঁছানো সহজ হতো।

নবনীতা চৌধুরী

এবার কোভিডে বিপুল পরিমাণ মানুষ শুধু কাজ হারিয়েছেন তা নয়, যাঁরা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছিলেন, সেই ব্যবসাগুলোও বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে। ব্র্যাকের গবেষণায় এসেছে, একজন পুরুষের বিপরীতে তিনজন নারী কাজ হারিয়েছেন। প্রণোদনা প্যাকেজের ২০ হাজার কোটি টাকার মাত্র ৫ শতাংশে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ফেরদৌস আরা বেগম, আপনি এটা যথেষ্ট মনে করছেন কি না?

ফেরদৌস আরা বেগম

ফেরদৌস আরা বেগম

প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে ৫ শতাংশ নারীদের জন্য রাখা হয়েছে। সেটার একটা নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। মোট ১১ হাজার ১৮৩ জনকে এ ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৯ হাজার ৫০০ জনের ভেতর ১৭০ জন নারী ছিলেন। অর্থাৎ এই ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে প্রায় ২ শতাংশের মতো নারীরা পেয়েছেন। ব্র্যাক ব্যাংকের গবেষণায় এসেছে, এপ্রিলে যেখানে ৬৭ শতাংশ এন্টারপ্রাইজ বন্ধ ছিল, জুনে এসে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ শতাংশে। তার মানে হচ্ছে, তারা এই ধাক্কা সামলে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে।

সরকার এবারের বাজেটে প্রায় ৯৫ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকার একটা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তার মধ্যে পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) মাধ্যমে একটা বড় অংশ বণ্টন করা হবে। ২ হাজার কোটি টাকার একটা বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য। কর্মসংস্থানের সমস্যাটা খুব বড়। কটেজ ও মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ ২৬ মিলিয়নের মধ্যে প্রায় ১৫ মিলিয়নের চাকরির ব্যবস্থা করছে। খাতগুলোর মধ্যে কৃষি একটা গুরুত্বপূর্ণ খাত। আমাদের মোট কর্মসংস্থানের ৪০ শতাংশ আসে কৃষি খাত থেকে। কৃষি খাতে নজর দিলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ আছে। প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাঁরা বলেছেন যে এ সম্পর্কে জানেন না কিংবা প্রশাসনিক ব্যবস্থা অন্য রকম হলে কটেজ, মাইক্রো এন্ট্রাপ্রেনিউর বা নারীদের কাছে পৌঁছাত। এ ক্ষেত্রে যদি এসএমই ফাউন্ডেশন, বিসিক, পিকেএসএফ, চেম্বারস, মাইক্রো ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউশন, এনজিওকে যদি যুক্ত করা যেত, তাহলে কিছুটা ভালো ফল পাওয়া যেত। ভারতে তিন লাখ রুপি পর্যন্ত কোল্যাটারাল-মুক্ত ঋণ দেওয়া হয়। বাংলাদেশেও এটা আছে। কিন্তু বাস্তবায়ন খুব একটা হচ্ছে না। আরেকটা হতে পারে ক্লাস্টার বেজড ফাইন্যান্সিং। ১৭২টি ক্লাস্টার আছে। প্রতিটা ক্লাস্টারে যথেষ্টসংখ্যক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আছেন। তাঁদের মাধ্যমে অর্থায়ন করা গেলে তা কার্যকর হতো। আরেকটা হতে পারে অর্ডার বেজড ফান্ডিং। এরও একটি নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু সেটা কার্যকর হচ্ছে না। নীতিমালায় পরিষ্কার করে বলা আছে ট্রেডিং সেক্টরের, ম্যানুফ্যাকচারিং ও সার্ভিসিংয়ের জন্য কত যাবে। আমাদের জিডিপির ৫১ শতাংশ সেবা খাত থেকে আসে। তার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে খুচরা ও পাইকারি বিক্রয়। তাই সেখানে যদি ২০ শতাংশের সীমা না থাকত, তাহলে ভালো বণ্টন হতে পারত। মাইক্রো ও কটেজ এন্ট্রাপ্রেনিউরদের জন্য আলাদা ক্রেডিট রেটিং পদ্ধতি করা দরকার।

নবনীতা চৌধুরী

নারী উদ্যোক্তাদের একটা বিরাট অংশ প্রাতিষ্ঠানিক তালিকায় নেই। ব্যাংকে যাননি, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা নেননি। তাঁদের সহায়তার আওতায় না আনতে পারলে স্বাভাবিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে, নতুন করে দারিদ্র্য সৃষ্টি হতে পারে। অনানুষ্ঠানিক কর্মীদেরও কোনো তালিকা নেই। তাঁরা আবার দরিদ্র মানুষের তালিকায়ও নেই। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। নাজনীন আহমেদ, আপনার কী মত?

নাজনীন আহমেদ

নাজনীন আহমেদ

সাধারণত এমএসএম (মাইক্রো, স্মল, মিডিয়াম) সব কটিকে একত্র করে কোনো কিছু বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এই গবেষণায় কটেজ ও মাইক্রো আলাদা করে দেখা হয়েছে, সে জন্য আমি ব্র্যাককে অভিনন্দন জানাই। কারণ, যখন কটেজ ও এমএসএম একসঙ্গে বলি, তখন মিডিয়াম ও স্মলের সমস্যা এবং মাইক্রো ও কটেজের সমস্যা দুটো একসঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু দুটো আসলে এক রকম নয়। মিডিয়াম ও স্মলে চিত্রটা ভিন্ন, সেখানে বেশির ভাগই হয়তো চাকরি করেছেন অথবা তাঁদের নিজের সঞ্চয় বা গয়না আছে। ফলে স্মল ও মিডিয়াম পর্যায়ের উদ্যোক্তা যেখানে ব্যাংক কিংবা নিজের সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করেন, অন্যরা সেখানে এনজিওর ওপর। এমএসএমে প্রণোদনার ২ শতাংশ নারীরা পেয়েছেন। আমার সন্দেহ, এই ২ শতাংশের মধ্যে মাইক্রো ও কটেজ কত শতাংশ আছে বা আদৌও আছে কি না। কারণ, ব্যাংকগুলো বলছে, এসএমইকে ঋণ দিয়ে পোষায় না। কারণ, ছোট ঋণে অনেক খরচ।

অনানুষ্ঠানিকদের তালিকা তৈরির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক খাতে যাঁরা আছেন, তাঁদেরও হালনাগাদ কোনো তথ্যভান্ডার নেই। সরকারের সামাজিক সুরক্ষা নীতির একটা উপাদান ছিল যে একটা খানা জরিপ হবে, যেখানে প্রত্যেকের সম্পদের তথ্য থাকবে। এ জরিপ প্রি-টেস্টের পর আর এগোয়নি। এ জরিপ হলে তার মাধ্যমে বুঝতে পারতাম দরিদ্র মানুষ কারা, কোথায় কত দরিদ্র আছে। পাশাপাশি তারা কী পেশায় আছে, আয়ের উৎস চলে আসত। তাহলে আজ আর আলাদা করে অনানুষ্ঠানিক খাতের উদ্যোক্তা, শ্রমিক বা আনুষ্ঠানিক খাতের উদ্যোক্তা খুঁজে বের করতে হতো না।

নবনীতা চৌধুরী

গবেষণা বলছে যে ১০ জনের ৯ জন উদ্যোক্তা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তিনজনে একজন ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। পাটজাত পণ্য ও হস্তশিল্পের উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এ খাতে কর্মীদের অধিকাংশই ছিলেন নারী। কোহিনুর ইয়াসমিন, আপনি নিজেই হ্যারডসের মতো বিশ্ব বিখ্যাত বিপণিতে আপনার পণ্য বিক্রি করেন। ব্যবসায় পূর্ণ উদ্যমে কবে ফেরা যাবে? আপনি আশার আলো দেখছেন কি?

কোহিনুর ইয়াসমিন

কোহিনুর ইয়াসমিন

বিশ্ববাজারে কিন্তু জুন থেকে চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু পাটপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ১০ জন আছেন কি না, সন্দেহ। জেডিপিসির তথ্য অনুযায়ী চলমান সংখ্যা ২৯৫। মোট সংখ্যা ৭২০। ২৯৫ জনের মধ্যে মাত্র ১০ জনের মতো রপ্তানির সঙ্গে জড়িত। বাকিরা স্থানীয় বাজারের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু স্থানীয় বাজার পুরোটাতেই ধস নেমেছে। এদিকে রপ্তানির বাজার বেড়ে গেছে। হ্যারডস মেইল করে জানতে চেয়েছে আমাদের স্টক লোড আছে কি না, থাকলে তারা পুরোটাই কিনে নিতে চায়। এদিকে আমরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। অর্ডার বেড়ে যাওয়ার কারণ চানতে চেয়েছিলাম। তারা তিনটি কারণ উল্লেখ করেছে। একটা কোভিডের কারণে সারা বিশ্বই প্রাকৃতিক পণ্যের দিকে ঝুঁকছে। দ্বিতীয়ত, যেহেতু এ খাতে নারীরা বেশি কাজ করেন এবং কোভিডের কারণে তাঁরা সংকটে আছেন। তৃতীয়ত, তারা বলছে আমাদের দেশে কোভিড পরীক্ষার অত পরিবেশ নেই। সে জন্য আমরা সাহায্য করছি। এ মুহূর্তে আমরা যদি সম্মিলিতভাবে বিশ্ববাজার ধরতে পারি, তাহলে আমাদের যে বড় ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে পারব। এ ক্ষেত্রে সরকারের যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

নবনীতা চৌধুরী

ব্র্যাকের গবেষণায় এসেছে, ৩৬ শতাংশ স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ১৯ শতাংশ উদ্যোক্তা বলছেন উৎপাদন বাড়াতে আইটি ও প্রযুক্তিবিষয়ক দক্ষতা বাড়াতে, ব্যবসার নানা দিক নিয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণ সহায়তা দরকার। তার মানে শুধু অর্থ ও ঋণসহায়তা নয়, সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিরও প্রয়োজন রয়েছে। পারভীন মাহমুদ, দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণেও কোভিড–পরবর্তী বাস্তবতা বদলে গেছে কি না?

পারভীন মাহমুদ

পারভীন মাহমুদ

আমরা জানি যে ব্যবসার জন্য পুঁজি দরকার। কিন্তু গবেষণায় পুঁজির পাশাপাশি কিছু আনুষঙ্গিক চাহিদার বিষয়ও এসেছে। ব্যবসার জন্য বিজনেস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসও প্রয়োজন। এখানে আমাকে সঠিক পণ্য উৎপাদন করতে হবে এবং সেটার গুণগত মান থাকতে হবে। এর জন্য আমাদের সে ধরনের শিক্ষার দিকেই যেতে হবে।

নিউ নরমাল থেকে আমরা এখন বেটার নরমালের দিকে যাচ্ছি। নিউ নরমালে টিকে যাওয়ার জন্য নারীদের ব্যবসা ব্যবস্থাপনায় বদল আনার জন্য সক্ষমতা ও দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।

মাইক্রো ইনস্যুরেন্স গুরুত্বের সঙ্গে দেখার সময় এসেছে। সরকারের ইনস্যুরেন্স খাতে নীতিমালা করা হয়েছে। সেখানে মাল্টি ইনস্যুরেন্সের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু সেটা মাইক্রো ও স্মল এন্টারপ্রাইজের জন্য বাস্তবায়নের সুযোগটা নেই। যেসব পরিবার সংকটে পড়েছে, তারা যেন নতুন করে শুরু করতে পারে। মাইক্রো ইনস্যুরেন্স ও নারীদের জন্য একটা সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকেও অনেক ট্রেনিং হচ্ছে।

নবনীতা চৌধুরী

আমাদের গবেষণা দেখাচ্ছে, অনানুষ্ঠানিক খাতের অন্তত ৮৪ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁরা এখনো পুর্নোদ্যমে কাজে ফিরতে পারেননি। কবে ফিরতে পারবেন, এ নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। রোকেয়া রফিক, অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য আপনি যথেষ্ট উদ্যোগ দেখেন কি না?

রোকেয়া রফিক

রোকেয়া রফিক

কর্মজীবী নারীর পক্ষে আমরা এপ্রিল-জুন সময়ে ১৫০ জন গৃহকর্মীর ওপর একটা জরিপ করেছি। আগস্টেও করেছি। সেখান থেকে আমরা দেখতে পেয়েছি, তাঁরা একেবারেই কর্মহীন হয়ে গেছেন। তাঁদের কেউ আর কাজে নিচ্ছেন না। তাঁরা সম্পূর্ণভাবে কাজ হারিয়েছেন। হয়তো নিয়োগকর্তার কাছ থেকে এক-দুই মাস তাঁরা সাহায্য পেয়েছেন। নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে তাঁরা বিভিন্ন কাজে সংযুক্ত হয়েছেন। কিন্তু ১৫০ জনের মধ্যে ৯০ শতাংশ গ্রামে চলে যাননি। মাত্র ১০ শতাংশ গ্রামে গেছেন। তাহলে তাঁরা কীভাবে টিকে ছিলেন? এসব দেখতে গিয়ে বস্তির ভেতরে জরিপ করেছি এবং তাঁদের কাছ থেকে জেনেছি যে তাঁরা তাঁদের ব্যয় ৫০ শতাংশ কমিয়ে ফেলেছেন। শুধু ভাত-ডাল খেয়েছেন। তাঁদের ভেতর নিউট্রিশনের প্রচণ্ড রকম ঘাটতি দেখা গেছে। বিনোদন বলে কোনো জিনিস তাঁদের মধ্যে নেই। জামাকাপড় বানানোর প্রবণতা বা কোথাও বেড়াতে যাওয়া—এ সবকিছু তাঁরা বাদ দিয়েছেন। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা কিছুটা খরচ কমাতে পেরেছেন। এ সময়ে তাঁরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। যেসব দোকান থেকে তাঁরা মাসকাবারি বাজার করেন, সেখানে কিস্তির মতো কিছু টাকা দিয়ে বাজার নিচ্ছেন। তাঁরা কাজ হারানোয় এ প্রভাব শুধু তাঁর ওপর পড়ছে না, ওখানকার ক্ষুদ্র দোকানদারের ওপরও পড়ছে। জুলাইয়ের পর থেকে আবারও তাঁরা কাজ ফিরে পাচ্ছেন। খণ্ডকালীন কিছু কাজ তাঁরা পাচ্ছেন। কিন্তু আগে তাঁরা দরদাম করতে পারতেন, এখন সেটা পারছেন না। ২০১০ সালে গৃহকর্মীদের জন্য একটা নীতিমালা হয়েছিল। কিন্তু সেটা নীতিমালার জায়গায়ই থেকে গেছে, আইনে সম্পৃক্ত হয়নি। সেটা হলে তাঁরা পরিচয়পত্রের মতো কিছু পেতেন, যা দিয়ে সহজেই তাঁদের তালিকা করা যেত এবং সহায়তা করা যেত।

নবনীতা চৌধুরী

গবেষণায় এসেছে, ৬৬ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা কখনো ব্যাংকেই যাননি। তাঁরা সব সময় এনজিওর ওপরই নির্ভর করেছেন। এখনো ৫০ শতাংশের বেশি নারী উদ্যোক্তা কোভিড–পরবর্তী বিনিয়োগের জন্য এনজিওর দিকেই তাকিয়ে আছেন। আবার অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা দীর্ঘমেয়াদী বেকারত্বে পড়েছেন অনেকে। তাদের টার্গেট করে সহায়তা, কর্মসংস্থান করা না গেলেও তো দারিদ্র্য বাড়বে। শামেরান আবেদ, এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?

শামেরান আবেদ

শামেরান আবেদ

সাধারণত আমাদের দেশে চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত ঋণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারাও পান না। তাদের মধ্যে নারী উদ্যোক্তা আলাদা করে ধরলে সেখানে একেবারেই ঋণ যায় না। সে জন্য স্মল ও কটেজে এনজিওর মাধ্যমেই ঋণ দিতে হবে। কিন্তু সেখানেও এখন কিছু অসুবিধা আছে। এখন তারল্যসংকট আছে অনেক এমএফআইতে। আমরা ব্র্যাক কিছুটা ব্যবস্থা করতে পেরেছি। এ খাতে আমরা অনেক ঋণ দিচ্ছি ও পুনঃঅর্থায়ন করছি। সরকারের দিক থেকে তিন হাজার কোটি টাকার একটা প্যাকেজ এসেছে মাইক্রো ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউটগুলোর জন্য। এটা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এর মধ্যে একেকটা এমএফআই শুধু ৬০ কোটি টাকার মতো অ্যাকসেস করতে পারবে। আমরা দিনে ২৫০-৩০০ কোটি টাকা বিতরণ করে থাকি। সে জন্য কোনো বড় এমএফআই এই প্যাকেজগুলোর দিকে যাচ্ছেন না। ছোট ও মাঝারি কিছু এমএফআই কিছু সুবিধা পাবেন এখান থেকে। যখন সরকার থেকে এ রকম প্যাকেজ ঘোষণা হয়, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে এনজিওকে দেওয়া হয়। ওখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১-২ শতাংশ রাখে। তারপর এটা যায় ব্যাংকগুলোর কাছে। ব্যাংকগুলো আবার ২-৩ শতাংশ রেখে দেয়। ৪ বা ৫ শতাংশ হারে এনজিও এ অর্থায়ন পায়। এনজিওদের বলা হয় যে ৮-১০ শতাংশ সুদে এই ঋণ প্রান্তিক চাষি বা নারী উদ্যোক্তাদের দিতে হবে। অপারেটিং কস্ট ও লোন লসের পুরো খরচ আমাদের ওপর। আমাদের মার্জিনে সেটা কুলোয় না। মাঝখানে ৪-৫ শতাংশ ব্যাংকগুলো ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ে নিচ্ছে। তাদের এখানে কোনো খরচ নেই এবং ক্রেডিট রিস্কও তারা নিচ্ছে না। এসব কারণে এ প্যাকেজগুলো অকেজো হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে অনেক বেশি অর্থায়ন করা উচিত। কিন্তু বাস্তবে উল্টো হচ্ছে। বেশির ভাগ এনজিও যা আদায় করছে, তা–ই বিতরণ করছে। অন্যদিকে অনানুষ্ঠানিক খাতে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের কীভাবে সাহায্য করতে পারি? এখানে অনেক কাজ রয়ে গেছে। অনেক দিন আগে সামাজিক সুরক্ষা নীতি করা হয়েছে। সেখানে অনেকগুলো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল, টার্গেটিং ইমপ্রুভ করার কথা ছিল। অনেক কিছুই হয়নি। এখন সময় এসেছে কাজগুলো করার। এখন নিউ পুওর কারা আছেন, চিহ্নিত করা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভেতর নিয়ে আসা প্রয়োজন। তাঁদের অতিদারিদ্রের বাইরে রাখতে হলে এখনই এসব করতে হবে।

নবনীতা চৌধুরী

ব্র্যাকের গবেষণায় এসেছে, টিকে থাকতে জুন মাসের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক খাতের ৩৯ শতাংশ নারী শ্রমিক ধার করেছেন। ৩৫ শতাংশ কাজে ফিরতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। ৬২ শতাংশ নারী শঙ্কিত যে তাঁরা আদৌ আগের কাজে ফিরতে পারবেন কি না। তাঁদের অনেকেই পরিবারের একমাত্র বা প্রধান আয়ের উৎস ছিলেন। সচিব মহোদয় কে এম আবদুস সালামের কাছে জানতে চাই, সরকার কীভাবে তাঁদের চিহ্নিত করা, তালিকার আওতায় আনা, অর্থ, ঋণ, কর্ম বা দক্ষতা সহায়তা দেওয়ার কথা ভাবছে?

কে এম আবদুস সালাম

কে এম আবদুস সালাম

ব্র্যাক চমৎকার একটা জরিপ করেছে। সে গবেষণার ফলাফল ও পরামর্শ উপস্থাপন করেছে। উপস্থাপনার প্রথম পাতায় একজন নারীর ছবি ছিল, যিনি চা বিক্রি করছেন। রাস্তায় গেলে হয়তো দেখবেন তাঁর সে দোকান এখন নেই। তিনি হয়তো অন্য কাজ করছেন। কিংবা জরিপমতে, ধার করছেন অথবা সরকারের অনুদান নিচ্ছেন, প্রতিবেশীর কোনো সাহায্য গ্রহণ করছেন অথবা ব্যক্তি উদ্যোগ বা সংস্থার সাহায্য গ্রহণ করছেন।

দেশে মার্চে করোনা শুরু হয়ে এখন সেপ্টেম্বর। ছয় মাস পেরিয়েছে। সরকারের প্রথম উদ্যোগ ছিল মানুষকে স্বাস্থ্যের দিক থেকে সুস্থ রাখা। কারণ, মানুষের জীবন আগে রক্ষা করতে হবে। প্রথম দুই-তিন মাস বাংলাদেশে ব্যাপক হারে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। সরকার নেতৃত্বে ছিল, সবাই সহায়তা করেছে। সরকার থেকে কতগুলো অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে ইতিমধ্যে। এবারে ২০ বছরের জন্য পারস্পেক্টিভ প্ল্যান করা হচ্ছে। ২০২১-৪১। ২০৩০-৩১ সালের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন ও মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা একটি উন্নত বাংলাদেশ দেখতে চাই। এ উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের পারস্পেক্টিভ প্ল্যান করা হয়েছে। পারস্পেক্টিভ প্ল্যান ধরেই বাজেট করা হয়। এ বছর হলো আমাদের টিকে থাকার বছর। মার্চেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৩১টি নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনার মধ্যে স্বাস্থ্য কীভাবে রক্ষা করতে হবে, অর্থনীতি কীভাবে চলবে, কলকারখানা, শিল্প, কৃষি কীভাবে চলবে, তার বিস্তারিত বলেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বিশাল প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। সেটা শিল্প, ম্যানুফ্যাকচার, কৃষি খাতে কাজে লেগেছে। কৃষি খাতকে এ বছর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। সে উপলক্ষে কর্মসংস্থান ব্যাংকসহ আরও কিছু ব্যাংক বিশেষ ঋণ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এখন যারা পিছিয়ে পড়েছে, এসব সেবা তাদের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করলে দেখবেন সবকিছু সাজানো হয়ে গেছে।

নবনীতা চৌধুরী

কোভিড-১৯ নানা রকম ব্যবস্থাগত ত্রুটি সামনে নিয়ে এসেছে, তেমনি এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নারীকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নারীর ক্ষমতায়নের পরবর্তী ধাপে যাওয়ারও একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। আসিফ সালেহ, এ বিষয়ে আপনার মত শুনে আলোচনা শেষ করতে চাই।

আসিফ সালেহ

আসিফ সালেহ

আমরা সবাই আশার কথা শুনতে চাই। একটা সময় আবারও স্বাভাবিক গতিতে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে। কিন্তু আমরা কি আবার আগের জায়গায় ফিরে যেতে চাই? বছরের পর বছর কিছু পদ্ধতিগত বৈষম্য, যেগুলো গত ছয় মাসে কোভিড হওয়ায় ধরা পড়েছে, সেগুলো ঠিক করে যদি আমরা এগোই, তাহলেই আমরা বলতে পারব সংকট থেকে সুযোগ এসেছে এবং সেখানে ‘বিল্ড ব্যাক বেটার’ করতে পেরেছি।

সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমরা বিশাল পার্থক্য দেখেছি। লকডাউনের সময় যখন জরুরি ভিত্তিতে আমরা সাহায্য দিতে চেয়েছি, সরকারও তখন অনেক বরাদ্দ দিয়েছে, কিন্তু ঠিক সময়ে ঠিক মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া নিয়ে সবাই স্ট্রাগল করেছে। চার বছর আগে সোশ্যাল সেফটি নেট স্ট্র্যাটেজি হয়েছে, সেটি বাস্তবায়নে একটা বড় গ্যাপ দেখতে পেয়েছি। এই জায়গা জোর দিয়ে দেখতে হবে। মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিউ নরমালের অংশ হবে। এ সংকটে রাষ্ট্র সমর্থন না দিলে আমরা বারবার এই বিপদের সম্মুখীন হব। এ রকম কাঠামোগত সমস্যা বেশ কিছু জায়গায় দেখা গেছে। স্বাস্থ্য খাত এর মধ্যে একটা অন্যতম জায়গা। বিল্ড ব্যাক বেটারের দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, গত ছয় মাসে আমরা যে জায়গাগুলোতে পিছিয়ে গেছি সেগুলোর উন্নতি করতে হবে। যেমন গর্ভনিরোধ প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক কমতি দেখছি। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ স্বাস্থ্য সমস্যায়ও হাসপাতালে যায়নি। টিবির সংক্রমণ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছি। একটা বড় ভয়ের বিষয় হলো স্কুলগুলো খুললে আমরা সবাইকে পাব না। একটা বড় অংশই ঝরে পড়বে। এ বড় অংশের ব্যাপক অংশ হবে মেয়ে শিশুরা। আশা করছি এটা মিথ্যা আশঙ্কায় পরিণত হবে। এ জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শুধু অর্থনৈতিক দিক নয়, সামাজিক দিকও দেখতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতার সঙ্গে তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিল্ড ব্যাক বেটারের ক্ষেত্রে তৃতীয় দিক হলো, অনেক নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। ডিজিটাল খাতে অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে অনেক নিয়োগ হবে। নারীরা ডিজিটাল যন্ত্রপাতির প্রবেশাধিকারে অনেক পিছিয়ে আছে। কোনো পেশাকে পুরুষবান্ধব পেশা হিসেবে না দেখে সবার জন্য সুযোগ হিসেবে দেখতে হবে। ডিজিটাল খাতে যদি নারীদের প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা হওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি, তবে তাঁরা সুযোগগুলো নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারবেন। সফল হওয়ার আগ্রহ নারীদের অনেক বেশি এবং সফল হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। কিন্তু সংকটে সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে থাকেন। সেই জায়গায় নতুন নতুন ফাইন্যান্সিয়াল প্রোডাক্ট আনতে হবে। মাইক্রো ফাইন্যান্সের সঞ্চয় পদ্ধতি মানুষকে নিউ নরমালে মানিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। সঞ্চয়ের ক্ষেত্রেও নারীদের আগ্রহ অনেক বেশি। এখানে এনজিওর একটা ভূমিকা আছে। সরকার ও এনজিওর সমন্বয়েই এমডিজিতে বিশাল সাফল্য এসেছে, নারীর উত্থান ঘটেছে, মানব উন্নয়ন সূচকে প্রতিবেশী দেশ থেকে এগিয়ে গিয়েছি। আমরা জানি, একটা সময়ে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা যেন সত্যিকারভাবে সমতামূলক হয়।

নবনীতা চৌধুরী

প্রত্যাশা রইল সব দুর্যোগের মতো কোভিডেও অধিক ক্ষতির শিকার নারীদের সহায়তায় সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগ মনোযোগী হবে।
সবাইকে ধন্যবাদ।

সুপারিশ

  • নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালনায় পরিবর্তন আনা, বিশেষ করে ই-কমার্স-এর ওপর সক্ষমতা তৈরির জন্য দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।

  • পাটজাত পণ্যসহ নারী উদ্যোক্তাদের তৈরি পণ্য যাতে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করতে পারে, সে ক্ষেত্রে সরকারের যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

  • ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য গুচ্ছভিত্তিক অর্থায়নের (ক্লাস্টার-বেইজড ফাইন্যান্সিং) ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে ব্যাংক, এনজিও ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা এবং সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন।

  • ক্ষুদ্র, কুটির ও ছোট শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য অল্প বা বিনা সুদে এমনকি সহজ শর্তে ঋণপদ্ধতি চালু করা দরকার। বিভিন্ন মহামারিতে তাঁদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে বিমার ব্যবস্থাও করা প্রয়োজন। উদ্যোক্তাদের হালনাগাদ তথ্যভান্ডার থাকা প্রয়োজন।

  • অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারী কর্মীদের হালনাগাদ তথ্যভান্ডার এবং তাঁদের পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করা দরকার। যেমন গৃহকর্মীদের পরিচয়পত্র থাকলে তাঁদের সহজে খুঁজে বের করে সহায়তা করা যেত।

  • অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারী কর্মীদের মধ্যে যাঁরা দারিদ্র্যের মধ্যে নিপতিত হয়েছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন।