কান্না, কষ্টের সংবাদ সম্মেলনে নিখোঁজ আটজনের স্বজন

হাতে মাইক্রোফোন থাকলেও কিছুই বলতে পারেননি নিখোঁজ সাজেদুল ইসলাম সুমেনর মা হাজেরা খাতুন। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে l ছবি: প্রথম আলো
হাতে মাইক্রোফোন থাকলেও কিছুই বলতে পারেননি নিখোঁজ সাজেদুল ইসলাম সুমেনর মা হাজেরা খাতুন। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে l ছবি: প্রথম আলো

লিখিত বক্তব্য শেষ। এবার নিখোঁজ আটজনের স্বজনদের বক্তব্য শুরুর পালা। কিন্তু কান্নার দমকে তাঁরা কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বলে গেলেন তাঁদের কষ্টের কথা। তাঁদের কান্না, কষ্টে সংবাদ সম্মেলনে আসা গণমাধ্যমকর্মী ও মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীদেরও চোখ মুছতে দেখা যায়।
গত বছরের ৪ ডিসেম্বর রাজধানী থেকে র্যাব পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এই আটজনকে। সেই থেকে তাঁরা নিখোঁজ। স্বজনেরা তাঁদের জন্য কষ্ট, ফিরে পাওয়ার আকুতি জানালেন গতকাল বৃহস্পতিবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে। জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন তাঁরা।
আটজনই শাহীনবাগ ও নাখালপাড়া এলাকার। এঁরা হলেন ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম ওরফে সুমন, তাঁর খালাতো ভাই জাহিদুল কবীর ওরফে তানভীর, একই এলাকার মাজহারুল ইসলাম ওরফে রাসেল, আল আমিন, মাসুম ভুঁইয়া, আসাদুজ্জামান রানা, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা ও গাড়িচালক কাউসার আহমেদ এবং আদনান চৌধুরী। স্বজনেরা জানান, প্রথম ছয়জনকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে র্যাব-১ লেখা চারটি গাড়ি দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। অপর দুজনকে র্যাবের মতো পোশাক পরা ও র্যাব পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিরা তাঁদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়।
এই আটজনের বাসা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্বাচনী এলাকায়। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, এসব গুম বা অপহরণের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা নেই। যাঁরা গুম হয়েছেন বলে বলা হচ্ছে, তাঁরা নিজেরাও কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়েন সাজেদুল ইসলামের বোন সানজিদা ইসলাম। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ৪ ডিসেম্বর রাত সাড়ে আটটার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি নির্মাণাধীন বাড়ির সামনে থেকে ছয়জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনাস্থলেই রাসেলকে বেধড়ক মারধর করার কথা জানা যায়। ওই ছয়জনকে র্যাব-১ লেখা তিনটি পিককাপ ও একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বাসায় এসে বাবা-মায়ের সামনে থেকে আদনান ও কাউসারকে ধরে নিয়ে যান র্যাব পরিচয়ধারীরা। আদনানের বাবা-মাকে র্যাবের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, তাঁকে ফেরত দিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু আজও তাঁর বাবা-মা ছেলের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। ‘বাসা থেকে বের হওয়ার পরে আর ফেরেননি’ শুধু এই লিখে পরিবারগুলো তিনটি থানায় চারটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে পেরেছে। আল আমিনের পরিবার কারও নাম উল্লেখ না করে ভাটারা থানায় অপহরণ মামলা করেছে। কিন্তু তাঁদের খুঁজে বের করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। পরিবারগুলো র্যাব সদর দপ্তর ও র্যাব-১-এর কার্যালয়ে বারবার ধরনা দিয়েও কিছু জানতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের মহাপরিদর্শক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের দ্বারে ঘুরেছেন স্বজনেরা। একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, শহীদ মিনারে অনশন করেও কিনারা হয়নি। ন্যূনতম তথ্যও মেলেনি।
লিখিত বক্তব্য পড়া শেষে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের বক্তব্য পর্বের শুরু হলো কান্না দিয়ে। কান্নার কারণে কথাই বলতে পারছিলেন না তাঁরা। কান্না আর বিলাপে কেটে যায় প্রায় দেড় ঘণ্টা। কাউসারের মা কমলা বেগম বক্তব্য দিতে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। পরে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, তাঁর তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে কাউসার সবার বড়। তাঁর আয়েই চলত পরিবার। এখন তাঁদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। প্রতিবেদকের হাত ধরে তিনি বলেন, ‘আমি রাস্তার ভিখারি, বাবা। আমার ছেলেটার মুখ দেখে মরতে চাই। আপনারা ব্যবস্থা করেন।’
রাসেলের বোন নুসরাত জাহান বললেন, ‘আমরা প্রতিটা মুহূর্ত অপেক্ষা করি রাসেলের জন্য। ঘুমের মধ্যে চমকে উঠি—এই বুঝি ভাই এল। ফোন বাজলে মনে হয়, ওরই ফোন।’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, শুধু প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা থাকবে আর বাকি মানুষ গরু-ছাগলের মতো মারা যাবে, তা হবে না।
অনুষ্ঠানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সি আর আবরার সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে সব সময়ই এ ধরনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করা হচ্ছে। তবে সাত খুনের ঘটনার পর এ ধরনের ঘটনা অস্বীকার করার অবকাশ থাকে না। এখানে পরিবারবর্গ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বলছেন, সেগুলো যদি আমরা যুক্তি দিয়ে মিলিয়ে দেখি, তবে অবশ্যই বলতে হবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অংশ এতে জড়িত ছিলেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি খোঁজ নিয়েও তাদের কোনো হদিস পাইনি। ওদের মধ্যে একটা ছেলেকে (সাজেদুল ইসলামকে) চিনতাম। ওর পরিবার আমার কাছে এসেছিল। র্যাব তাদের ধরে নিয়ে গেছে, এ রকম অভিযোগেরও কোনো ভিত্তি পাইনি। মন্ত্রী হওয়ার পর তারা আর আমার কাছে আসেনি।’ তিনি বলেন, এ ঘটনায় সরকারি কোনো বাহিনী জড়িত ছিল না।
তাহলে শহরে কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর এত শক্তি যে একসঙ্গে আটজনকে ধরে নেওয়ার এক বছরেও ন্যূনতম সূত্র মিলল না—এ প্রশ্ন করলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ওরা যখন নিখোঁজ হয়, তখন দেশে একটা অরাজক পরিস্থিতি চলছিল। এমনও তো হতে পারে তারা গা ঢাকা দিয়েছে। নিজেদের কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। আমি বলছি যেকোনো ধরনের ঘটনাই তো ঘটতে পারে।’