কারও কারও মজার জন্য তছনছ বহু পরিবার

সচেতনতাই পারে ট্রেনে পাথর বা ঢিল ছোড়া বন্ধ করতে
ফাইল ছবি

‘বাসে গেলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তাই নিরাপদ ভেবে ট্রেনে চড়ি। আর সেই ট্রেনেই আমার পাঁচ বছর বয়সী ছেলের চোখে আঘাত লাগল। বাইরে থেকে আসা পাথরে ট্রেনের জানালার কাচে লাগে, এরপর গ্লাস ভেঙে সেই পাথর ছেলের চোখে আঘাত করে। ডাক্তার বলেছেন, ছেলের দৃষ্টিশক্তি আস্তে আস্তে কমে যাবে। এখন তো মনে হচ্ছে, ডাক্তারের কথাই সত্যি হতে যাচ্ছে। এখন নামাজ পড়ি আর আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি, আমার বাবুর চোখটা যাতে নষ্ট না হয়। এত সুন্দর ছেলেটা আমার, কী যে হয়ে গেল।’ ৪ অক্টোবর মুঠোফোনে কথাগুলো বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদলেন মারুফ ইসলাম। তাঁর পাঁচ বছর বয়সী ছেলে আজমীরের চোখের দৃষ্টিশক্তি নিয়ে অজানা আশঙ্কায় ভুগছেন এ বাবা।

গত ১৫ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় নীলফামারীর সৈয়দপুর রেলস্টেশনের হোম সিগন্যালের কাছে আজমীর ইসলামের ঘটনাটি ঘটে। তখন স্টেশনে পৌঁছাতে আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি ছিল। নীলফামারীর ডোমার উপজেলার মাছের হ্যাচারি ব্যবসায়ী মারুফ ইসলামের ছোট ছেলে সে। মারুফ ইসলাম জানান, ১৫ অক্টোবর আবার ঢাকায় আসতে হবে ছেলের চোখের ফলোআপের জন্য।

৫ বছর বয়সী আজমীরকে এখন সব সময় চশমা পরে থাকতে হচ্ছে।
ছবি: সংগৃহীত

ঘটনার পর ছেলের কর্নিয়া অপারেশনসহ এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে এক লাখ টাকার বেশি টাকা।

৩৪ বছর বয়সী সহকারী লোকোমাস্টার কাওসার আহমেদের চোখ অল্পে থেকে রক্ষা পেয়েছে। কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকা আসার পথে ভৈরবের কাছে গত ২ সেপ্টেম্বর পাথরের আঘাতে জানালার কাচের গুঁড়া তাঁর চোখে ঢুকে। রেল কর্তৃপক্ষ কাওসার আহমেদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে।

২৫ সেপ্টেম্বরের রাতের কথা ভুলতে পারছেন না গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তামান্না তন্নী। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেয়ে তামান্না মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বললেন,‘ গোপালগঞ্জগামী টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেসে জানালার পাশে আমার সিট ছিল না। ওই সিটে যিনি ছিলেন তাঁকে অনুরোধ করে আমি সেই সিটে বসেছিলাম মাথাব্যথা একটু কমানোর জন্য। সেই মাথাতেই আঘাত পেলাম। ভয়ে প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। মাথায় যখন আঘাত পাই, তখন মনে হয়েছিল আমি মরে যাচ্ছি।’

তামান্নাকে তাঁর মা এসে বাড়ি নিয়ে গিয়েছেন। পরীক্ষার সময় ফিরবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তামান্না বললেন,‘আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না যে এই ঘটনাটি আমার সঙ্গেই ঘটেছে। ট্রেনের কথা মনে হলেই ভয় লাগছে। কিন্তু ট্রেনে না চড়ে তো উপায়ও নেই।’
তামান্নার মাথার আঘাতের ক্ষত শুকিয়ে আসছে। চিকিৎসা বাবদও খুব বেশি টাকা খরচ হয়নি। কিন্তু তিনি যে ভীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তা কাটতে সময় লাগবে তা তাঁর কণ্ঠই বলে দিচ্ছিল।

আজমীর, কাওসার, তামান্না...এভাবে সংখ্যাটি বাড়ছে। ট্রেনের যাত্রী বা ট্রেনের কর্মী বাইরে থেকে ছোড়া পাথরের আঘাতে কেউ চোখ হারাচ্ছেন, কেউ অল্পের জন্য রক্ষা পাচ্ছেন। আর ঘটনাগুলোতে ভীতি তৈরি করছে অন্য যাত্রী ও ট্রেনের কর্মীদের মনে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ও পাথর নিক্ষেপ বন্ধে নড়েচড়ে বসেছে।

বাংলাদেশের প্রথম নারী ট্রেনচালক সালমা খাতুনের চাকরি জীবনে কেটে গেছে প্রায় ১৮ বছর। মুঠোফোনে যখন কথা হয়, তখন তিনি ট্রেন চালিয়ে কালিয়াকৈর থেকে মাত্রই ঢাকায় পৌঁছেছেন। বললেন, ‘এই জীবনে সরাসরি বাইরে থেকে ছোড়া পাথরের আঘাতে আহত হইনি। তবে সহকর্মী বা অন্যরা আহত হচ্ছেন। অনেকে মারাও যাচ্ছেন। তাই মনে ভয় তো লাগেই। কিন্তু ট্রেন চালানোর সময় আসলে আমাদের করার কিছুই নেই। মাঝেমধ্যে জানালা বন্ধ রাখি। কিন্তু গরমের জন্য বেশিক্ষণ জানালা বন্ধও রাখা যায় না। আর এটা তো কোনো সমাধানও নয়। কখন, কোথায় কে পাথর নিক্ষেপের জন্য বসে আছে, তা আমরা কেউ জানি না। ছোট শিশু না বুঝে বা কেউ হয়তো স্রেফ মজার জন্য কাজটি করছে, অথচ এই মজার কারণে মানুষের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।’

প্রকৌশলী প্রীতি দাশ (২৪) ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে ভাটিয়ারী এলাকায় চলন্ত ট্রেনে বাইরে থেকে ছোড়া পাথরের আঘাতে নিহত হন। খুব জাঁকজমক করে ঘটনার মাত্র ১৭ মাস আগে বিয়ে হয়েছিল প্রীতি দাশের। ট্রেনে করে ফিরছিলেন ঢাকায় ঈদের পরদিন, ২০১৩ সালের ১০ আগস্ট।

২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল খুলনা-বেনাপোল রুটের বেনাপোল কমিউটার ট্রেনে দায়িত্ব পালন করছিলেন রেলওয়ের পরিদর্শক বায়েজিদ হোসেন। পাথর নিক্ষেপের পর তিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন। ৪১ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।

পাথর নিক্ষেপের পরিসংখ্যান

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী রেলওয়েতে গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ১১০টি। এতে ট্রেনের জানালার কাচ ভেঙেছে ১০৩টি এবং আহত হয়েছেন ২৯ জন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অবশ্য বলছেন, করোনায় বিধিনিষেধের কারণে বিভিন্ন সময় ট্রেন বন্ধ না থাকলে পাথর হামলার সংখ্যা আরও বেশি হতো।

চলন্ত ট্রেনে বেশি পাথর মারা হয়—এমন ১৫টি স্থান চিহ্নিত করেছে রেলওয়ে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর কেউ পাথর ছুড়েছে, কেউ এমন ছবি তুলে দিলে অথবা প্রত্যক্ষদর্শীদের জন্য নগদ ১০ হাজার টাকা দেওয়ার পুরস্কার ঘোষণা করেছে রেলওয়ে পুলিশ।

৫ অক্টোবর রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন,‘আমরা সংবাদ সম্মেলনে সার্বিক পরিস্থিতি জানিয়েছি। বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছি। এখন দেখা যাক, এসবে সুফল মেলে কি না। একটু সময় তো লাগবেই। আর পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটাচ্ছে শিশু না হয় মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিরা।’

উপমহাদেশে ১৮৫৩ সালে যাত্রীবাহী ট্রেন চালু হওয়ার পর থেকেই কোনো না কোনো স্থানে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। দেশে প্রথম রেলওয়ের সূচনা হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর দর্শনা-জগতি রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেললাইন নেটওয়ার্ক দেশের ৪৪টি জেলায় সংযুক্ত।

১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর রেল যোগাযোগ শুরুর দিন থেকেই এর ওপর ১৪৪ ধারা জারি আছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো, রেললাইনের পাশে বস্তি বসানো হয়, রেললাইনের ওপর বাজার বসে, রেললাইনের ওপর মাদক সেবন ও ব্যবসা চলে। সীমান্তবর্তী এলাকায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে ট্রেনে পাথর ছোড়া হয়। জায়গামতো ট্রেন না থামালে পাচারকারীরা পাথর ছোড়ে। শিশু–কিশোরেরা মজা করার জন্য পাথর ছুড়ে মারে।

২০১৯ সালে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও ট্রেনে ভ্রমণ করার সময় বিরূপ পরিস্থিতির মুখে পড়েছিলেন। ছোড়া পাথরের আঘাতে জানালার কাচ ভেঙে গিয়েছিল। বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন স্পিকার। সে বছরই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের হিসাব বলছে, পাঁচ বছরে (২০১৫–১৯) ট্রেনে পাথর ছুড়ে দুই হাজারের বেশি জানালা-দরজা ভাঙার ঘটনা ঘটেছিল।

আইন আছে, ভুক্তভোগীদের মামলা করায় আগ্রহ কম

১৮৯০ সালের রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারায় শাস্তির বিধান আছে। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের জন্য ১০ হাজার টাকা জরিমানার পাশাপাশি ১০ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা আছে। আর কোনো রেলযাত্রী মারা গেলে ৩০২ ধারায় ফাঁসিরও বিধান আছে। পাথর নিক্ষেপকারী অপ্রাপ্ত বয়স্ক হলে, সে ক্ষেত্রে তার অভিভাবকের শাস্তির বিধান আছে।

প্রীতি দাশ নিহতের ঘটনায় সন্দেহভাজন দুই কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। রেলওয়ের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। তবে তাতে দৃষ্টান্তমূলক সাজার আওতায় কাউকে আনা সম্ভব হয়নি। রেলওয়ের পরিদর্শক বায়েজিদ হোসেনের ঘটনাতেও রেলওয়ের পক্ষ থেকে চারজনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছিল।

আজমীরের বাবা মারুফ ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তামান্না তন্নী বা সহকারী লোকোমাস্টার কাওসার আহমেদ ঘটনার পর মামলা করেননি। মারুফ ইসলাম আর তামান্না জানান, ঘটনার আকস্মিকতায় তাঁরা মামলা করার কথা ভাবতে পারেননি। আগে ছেলে বা নিজের সুস্থতার বিষয়টি বেশি অগ্রাধিকার পেয়েছে। আর কাওসার আহমেদ বললেন,‘কার বিরুদ্ধে মামলা করব? আসামিই তো অজ্ঞাতনামা। আমি তো জানিই না, কে আমাকে আঘাত করেছে। চলন্ত ট্রেনে বসে অভিযুক্ত কে, তা বের করাও অসম্ভব।’

সহকারী লোকোমাস্টার কাওসার আহমেদ। দায়িত্ব পালনের সময় গত ২ সেপ্টেম্বর ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের কারণে জানালা ভেঙে কাচের গুঁড়া তাঁর চোখে ঢুকে পড়ে।
ছবি: সংগৃহীত

তবে আজমীরের ঘটনার পর গত ১৬ আগস্ট সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশনের সহকারী স্টেশনমাস্টার ময়নুল হোসেন বাদী হয়ে সৈয়দপুর রেলওয়ে থানায় (মামলা নম্বর ১) ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের ৪২৭ ও ১৮৯০ সালের রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারায় পাথর নিক্ষেপ করে যাত্রীকে গুরুতর জখম এবং ট্রেনের জানালার গ্লাসের ক্ষতি বিষয়টি উল্লেখ করে মামলা করেছেন। মামলার আসামি অজ্ঞাতনামা। জানালার গ্লাসের ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে আনুমানিক পাঁচ হাজার টাকা।

৫ অক্টোবর ময়নুল হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি আমার করা প্রথম মামলা হলেও পাথর নিক্ষেপের ঘটনা তো আর নতুন নয়। এর আগে জয়দেবপুর জংশনে কাজ করার সময়ও এমন অনেকগুলো ঘটনা পেয়েছিলাম।’

মামলার অগ্রগতি প্রসঙ্গে ময়নুল হোসেন বললেন,‘কয়েক দিন আগে থানায় জানতে চেয়েছিলাম মামলায় অগ্রগতি সম্পর্কে। থানা থেকে জানানো হয়েছে, অভিযুক্ত বা অভিযুক্তদের ধরতে লোক লাগিয়ে রাখা হয়েছে। ধরতে পারলেই আমাকে জানাবে।’
আজমীরের পাথর নিক্ষেপের মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সৈয়দপুর রেলওয়ে থানার এসআই মীর্জা মোহাম্মদ মুক্তা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, কে পাথর মারছে, তা বের করা কঠিন। মামলার তদন্ত চলছে।