‘কারখানায় নিঃসন্দেহে দাহ্য পদার্থ ছিল’

ইয়াছির আরাফাত

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কারখানায় দুর্ঘটনা, মৃত্যু, তদন্ত কমিটি—এই বৃত্তেই চাপা পড়ে যায় অসংখ্য মানুষের কান্না। হাশেম ফুডের সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াছির আরাফাত খান

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: করোনায় প্রতিদিন শতাধিক মৃত্যুর মধ্যে আজ ৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু দেখল বাংলাদেশ। হাশেম ফুড লিমিটেডের দুর্ঘটনার ধরন দেখে কী মনে হয়েছে আপনার?

ইয়াছির আরাফাত: ঠিক কোন ঘটনা থেকে আগুনের সূত্রপাত, তা বলা মুশকিল। কারণ তদন্ত করে এটা জানা যেতে পারে। পুড়ে যাওয়া কারখানায় আগুন জ্বলেছে ২০ ঘণ্টা ধরে। আমার ধারণা, এর কারণ হলো, প্রতিটি তলায় প্রচুর দাহ্য পদার্থের উপস্থিতি ছিল। দাহ্য পদার্থ বলতে অতিদাহ্য পদার্থ হতে হবে, এমন নয়। কারখানায় ব্যবহৃত কাঁচামালও এখানে আগুনের উৎপত্তি ও বিস্তারে ভূমিকা রাখে। আর এই কারখানার নিজস্ব আগুন নেভানোর ক্ষমতা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নড়বড়ে ছিল বলে মনে হয়। এর আগেও সেখানে চারবার আগুনের ঘটনা ঘটেছে বলে শুনেছি। আগুন লাগলে প্রাথমিক পর্যায়ে যদি ঠেকানো না যায়, তবে পরে এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন আর কিছু করারও থাকে না। এই কারখানায় আগুন লাগার পর যখন ছড়িয়ে পড়েছে, তখন আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: খাদ্যদ্রব্য তৈরি করার এসব কারখানায় কোন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার হয়?

ইয়াছির আরাফাত: খাদ্যদ্রব্য তৈরিতে বিভিন্ন কাঁচামাল ও রং ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া প্যাকেজিংয়ের জন্য বিভিন্ন পলিমার প্রতিষ্ঠানে রেজিন, সলভেন্ট বা এ ধরনের নানা পেট্রোকেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। এসব সামগ্রী যখন আগুনের সংস্পর্শে আসে, সেগুলো গলে তরল জ্বালানিতে পরিণত হয়ে যায়। হাশেম ফুডে এ ধরনের সামগ্রী ছিল, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: অভিযোগ উঠেছে, কারখানার বিভিন্ন তলার ফটক বন্ধ ছিল। আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। আগুন লাগলে ফটক বন্ধ করে দেওয়ার কারণে এর আগে তাজরীন গার্মেন্টসেও অনেক প্রাণহানি হয়েছিল।

ইয়াছির আরাফাত: একটি কারখানায় যখন আগুন লাগে, তখন প্রাথমিক কাজ হলো, কর্মীদের সেখান থেকে বের করে আনা। আমরা অভিযোগ পাচ্ছি, এখানে কর্মীরা আটকে ছিলেন। তাঁদের বের হতে দেওয়া হয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক। তাজরীন কারখানায় আগুনের ঘটনায় একই ঘটনা ঘটেছিল। তখন সেটা নিয়ে অনেক কথা শোনা গিয়েছিল। ওই নির্দয় আচরণ নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল। কিন্তু এখন সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। আমাদের এখানে এ–ই হয়, বড় ঘটনা ঘটলে চিৎকার হয়, কিন্তু একসময় সব জিইয়ে যায়। তাই এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। আগুন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাপনার অভাবের পাশাপাশি এখানে শিশু শ্রমিক ব্যবহারের কথাও শোনা যাচ্ছে। এসব দেখভাল করার জন্য কর্তৃপক্ষ আছে। সেসব কর্তৃপক্ষ এসবের দিকে দৃষ্টি দেয়নি। যে প্রতিষ্ঠানের কারখানায় আগুন লেগেছে, সেটি বড় কোম্পানি। এরা সরকারের অনুমোদন নিয়েই চলছে। যে কারখানায় আগুন লেগেছে, তার ডিজাইনে ত্রুটি ছিল বলে মনে হয়। কেননা, নিচতলায় আগুন লেগে তা ওপরের তলায় ছড়িয়ে পড়েছে, অথচ কেউ বের হতে পারেননি। আগুন যদি নিচতলায়ই নিয়ন্ত্রণ করা যেত, তবে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হতো। কারখানা ভবনের ডিজাইনে ত্রুটি থাকতে পারে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: তৈরি পোশাক কারখানার নিরাপত্তা নিয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ আছে। কিন্তু এর বাইরে নানা ধরনের কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়ে উদ্যোগ কতটুকু?

ইয়াছির আরাফাত: তৈরি পোশাক কারখানায় বাইরের দেশের ক্রেতাদের চাপ আছে। যার কারণে ওই খাতে গুরুত্ব দেওয়া হয় বেশি। কিন্তু আমাদের রাসায়নিক কারখানা, প্লাস্টিক কারখানা বা খাদ্যসামগ্রী তৈরির প্রতিষ্ঠানের মতো কারখানাগুলোর যথাযথ দেখভাল করার যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। নেই রাসায়নিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও দিকনির্দেশনা।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বিভিন্ন দুর্ঘটনার পর নানা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের গুরুত্ব কী? এগুলো আমরা কতটুকু জানতে পারি?

ইয়াছির আরাফাত: আমাদের এখানে দুর্ঘটনা হয়। এ নিয়ে নানা কথা হয় এবং এক বা একাধিক তদন্ত দল যেনতেনভাবে তৈরি হয়। তারা একটি রিপোর্ট দেয়, সেটি আবার আমাদের কাছে আসে না। গাজীপুরের টঙ্গীর ট্রাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদনে কী সুপারিশ করা হয়েছিল, তা আমরা কেউ জানি না। সেসব সুপারিশ ওই ধরনের কারখানাগুলোয় পাঠানো হয়েছিল বলে মনে হয় না। যদি পাঠানো হতো এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাগিদ দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কার্যকর তদন্ত ও সুপারিশ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে কী করা উচিত?

ইয়াছির আরাফাত: আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে যথাযথ তদন্ত হওয়া দরকার। কাউকে দায়ী করার জন্য তদন্ত নয়। একটি দুর্ঘটনার সূত্রপাত একটা ভুল থেকে হলেও এর কারণ থাকে অনেক। দরকার হচ্ছে, সঠিক কারণগুলো খুঁজে বের করা এবং একই ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশমালা প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট এজেন্সি ও কারখানাগুলোকে দেওয়া। ইদানীং কারখানাগুলোয় দুর্ঘটনার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ আমরা দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হচ্ছি। ফলে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। গতকালের দুর্ঘটনার পর জেলা প্রশাসককে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। মগবাজারে যে দুর্ঘটনা ঘটল, সেখানেও একাধিক তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা একেকজন একেক রকম কথা বলছেন। এখনো রিপোর্ট হয়নি যদিও। আসলে এসব দুর্ঘটনার তদন্তে একটি বিশেষজ্ঞ দলের সমন্বয়ে একটি জাতীয় পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার। অনেক দেশে দুর্ঘটনার তদন্তে ‘কেমিক্যাল সেফটি বোর্ড’ বা ‘ন্যাশনাল অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন বোর্ড’ আছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে যেন তারা যায়, তারা যেন সুপারিশমালা তৈরি করে এবং সেগুলো যেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো যায়। আমাদের শ্রম আইন এবং পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নীতি আছে। সেটার দেখভাল যে ঠিকমতো হচ্ছে না, একের পর এক দুর্ঘটনা থেকে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।