দেশে সাদা পদ্ম বিলুপ্তির পথে। হাতে গোনা যে কয়েকটি জেলায় এই ফুল ফুটতে দেখা যায়, ফরিদপুর তার একটি। জেলার গজারিয়ার বিলের সাদা পদ্ম শতাধিক বছর ধরে আশপাশের কয়েকটি জেলার মানুষের কাছে এক বড় আকর্ষণ।

গজারিয়া বিলের যে অংশে সাদা পদ্ম ফোটে, সেটি ব্যক্তিমালিকানার জমি। পদ্ম ফুল কেটে সাফ করে মাছ চাষের কথা ভাবছেন জমির মালিক। এই খবরে নিসর্গপ্রেমীদের মধ্যে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে।

ফরিদপুর নিসর্গ সংসদের সদস্য মজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে সাদা পদ্ম বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। গজারিয়া বিলের এই পদ্মও যদি কেটে ফেলা হয়, তাহলে আমাদের একটি ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। সরকারি বা বেসরকারি যেভাবেই হোক, এই ফুল রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। তবে আমার দাবি থাকবে, সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হোক।’

ফরিদপুর শহর থেকে আনুমানিক ১২ কিলোমিটার দূরে গোয়ালন্দ-তাড়াইল সড়কের পূর্ব পাশে কৃষ্ণারডাঙ্গি গ্রামে গজারিয়া বিলের অবস্থান। স্থানটি নগরকান্দা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন উপজেলার সীমানায় অবস্থিত। আকারে ছোট হওয়ায় এটি স্থানীয় লোকজনের কাছে ‘গজারিয়ার কোল’ নামেও পরিচিত। বিলে আগে বড় বড় গজার মাছ পাওয়া যেত। এ কারণেই নাম ‘গজারিয়া বিল’।

পদ্ম (Nelumbo nucifera) ভারত ও ভিয়েতনামের জাতীয় ফুল। এটি বহুবর্ষজীবী। গাছের কাণ্ড লতানো। পাতা গোল, প্রায় ৪০ সেন্টিমিটার চওড়া। সরু কাঁটাযুক্ত লম্বা বোঁটার ফুলগুলো সুগন্ধিযুক্ত। পাপড়ি সাদা, পুংকেশর হলদেটে। একটি ফুলে ১২ থেকে ১৮টি পাপড়ি থাকে। বর্ষা থেকে শরৎকালে এই ফুল বেশি ফোটে। ফল দেখতে বাটির মতো; রং সবুজ। ভেতরে বাদামি বীজ থাকে। পানির ওপরে পাতা ও ফুল ভেসে থাকে। মূল থাকে পানির নিচে কাদায় আবদ্ধ। সাধারণত এঁদো ডোবাতেই জন্মে ভুবনমোহিনী এই ফুল।

সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি পদ্মের রয়েছে নানা ঔষধি গুণ। ফুল ও ফলের ভেতরে থাকা বীজ বা বোঁটা আমাশয়সহ বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে খুবই উপকারী। ফলের বীজ হৃৎপিণ্ড, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধের উপকরণ। ডায়রিয়া সারাতে পদ্মের বোঁটা কাঁচা খেলেই উপকার পাওয়া যায়। এ ছাড়া পদ্মচাক ও বীজ সুস্বাদু খাবার। এর ডাঁটা সবজি হিসেবে খাওয়া হয়।

সরেজমিন গজারিয়া বিল

দূর থেকে গজারিয়া বিলের দিকে তাকালে মনে হয়, সবুজ খেতে বসে আছে একঝাঁক সাদা বক। কাছাকাছি যেতেই ভুল ভাঙে—বক কোথায়? এ তো বড় বড় সাদা পদ্ম ফুল। কোনোটি সম্পূর্ণ ফোটা, কোনোটি আধা ফোটা আবার কোনোটি শুধুই কলি। মাঝেমধ্যে জোরে বয়ে যাচ্ছে দখিনা বাতাস। এতে দোল খেয়ে গোল পদ্মপাতাগুলো উল্টে যাচ্ছে; দুলে উঠছে ফুল। বাতাস একটু দম ধরতেই সেগুলো ফিরে যাচ্ছে আগের অবস্থানে। এ এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। ফুলের মধু খেতে ভিড় করছে নাম জানা-অজানা নানা কীটপতঙ্গ।

বিলের পাশেই বাড়ি কৃষক নূরুদ্দীন খাঁর (৬২)। সাদা পদ্ম নিয়ে বলতে গিয়ে ফিরে গেলেন সেই ছোট্টবেলায়, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই দেখছি, বিলে সাদা পদ্ম ফোটে। কেউ বিলের মধ্যে তা লাগাইছে নাকি আপনা-আপনি হইছে জানি না। কত দিন ধইরা এই বিলে সাদা পদ্ম ফোটে তা-ও আমার জানা নেই। আমার বাবার কাছে শুনেছি, তিনিও তাঁর ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন।’

গৃহবধূ নাসিমা বেগম ১২ বছর আগে এই গ্রামে বউ হয়ে আসেন। এরপর থেকে দেখছেন, প্রতিদিনই পদ্ম ফুল দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে লোকজন আসে। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন পূজার সময় ছুটে আসেন পদ্ম ফুলের জন্য।

গ্রামের বাসিন্দা রিকশাভ্যানচালক ইউনুস খান বলেন, পদ্মবীজ এলাকার শিশু-কিশোরদের কাছে খুবই প্রিয়। তারা সুস্বাদু এই বীজের নাম দিয়েছে ‘বাদাম’। আর অতীতে পদ্মপাতায় বেঁধে লবণ বিক্রি করা হতো। ব্যবসায়ীরা ছুটে আসতেন বড় বড় পদ্মপাতা সংগ্রহ করতে।

কেটে ফেলা হবে সাদা পদ্মের ভান্ডার?

গজারিয়া বিলটি প্রায় ১০ একর জায়গায় বিস্তৃত। তবে সাদা পদ্ম ফোটে বিলের ১ একরের মতো জায়গায়জমিটির মালিক স্থানীয় রামনগর ইউনিয়নের পুঞ্জনগর গ্রামেরনাসির উদ্দিন আহমেদ। তিনি ১০ বছর আগে বিলের ২ একর জমি কেনেন। এর প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে সাদা পদ্ম ফোটে।

নাসির উদ্দিন বললেন, তিনি মাছের খামার করতে জমিটি কিনেছিলেন। তবে নানা কারণে আজও তা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু অচিরেই তিনি প্রকল্প শুরু করতে চান। তাহলে দুর্লভ এই সাদা পদ্মভান্ডারের ভবিষ্যৎ কী? নাসির উদ্দিন বলেন, ‘সব কেটে ফেলা হবে। আমি জানি, এই ফুল অনেক আগে থেকে এই বিলে ফুটে আসছে। এটি দেশের ও এলাকার সম্পদ। কিন্তু তা রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, ওই ফুল থেকে তো আমার কোনো লাভ আসে না।’ তবে প্রশাসন উদ্যোগ নিলে এবং তাঁকে ‘সাপোর্ট’ দিলে নাসির কিছুটা ক্ষতি হলেও তা মানতে রাজি আছেন।

ফরিদপুর হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্ত্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘জায়গাটি ব্যক্তিমালিকানার হওয়ায় আমি সেখান থেকে গোড়াসহ ওই সাদা পদ্মের চারা সংগ্রহ করে সরকারি জায়গায় সংরক্ষণের উদ্যোগ নেব। আর পদ্মগুলো ওই জায়গাতেই সংরক্ষণ করা যায় কি না, সে ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ও মৎস্য কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলব।’