ক্যালিগুলা: ঘৃণার মধ্যে যার বসবাস

শুরু করা যাক শেষ দৃশ্য দিয়ে। রোমান সম্রাট ক্যালিগুলা তাঁরই প্রহরীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। মাটিতে পড়ে মৃত্যুর ঠিক আগে আঙুল উঁচিয়ে বলছেন, ‘আমি মরছি না, আমি বেঁচে থাকব।’
আসলেই ক্যালিগুলা মরেননি। আর মরেননি বলেই পৃথিবীর নানা দেশেই আজও যুক্তিহীন নিষ্ঠুরতার কাছে পরাজিত হচ্ছে মানবতা। ১২ খ্রিষ্টাব্দের খেয়ালি এই রোমান সম্রাট তো সর্বকালের অন্ধকার জগতেরও রাজা। ফরাসি কথাসাহিত্যিক আলবেয়ার কামুর বিখ্যাত ক্যালিগুলা নাটক দেখে সে উপলব্ধিই সঞ্চারিত হয়।
কামুর ইতিহাস আশ্রয়ী নাটক ক্যালিগুলার প্রথম মঞ্চায়ন হয়ে গেল ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে। অসীম দাশের নির্দেশনায় ফেইম স্কুল অব ডান্স অ্যান্ড ড্রামা দল মঞ্চে এনেছিল নাটকটি।
ক্যালিগুলার মতো দুর্বোধ্য চরিত্র মঞ্চে হাজির করা সহজ নয়। তার ওপর ১৯৩৯ সালে রচিত ‘অ্যাবসার্ড’ ঘরানার এই নাটকের সব শর্ত পূরণ করাও দুরূহ। এখানেই শেষ নয়, সমসাময়িক কালের সঙ্গে ক্যালিগুলা চরিত্রটির সংযোগ স্থাপনও ছিল জরুরি। এই তিন ক্ষেত্রেই দক্ষতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছে অসীম দাশের দল। পোশাকে পরিকল্পনা ও মঞ্চ সজ্জায় কালের সীমারেখা মুছে দেওয়া হয়েছে। কুশীলবদের পরানো হয়েছে আধুনিক নাগরিক পোশাক। তাতে রোম সাম্রাজ্যের একটা নির্দিষ্ট সময় যেন সমসাময়িক কালের ভেতর অনায়াসে ঢুকে পড়তে পেরেছে।
বোন দ্রুসিলার মৃত্যুর পর সম্রাট ক্যালিগুলা আবিষ্কার করলেন মৃত্যুর কাছে সবাই সমান। ভালোবাসা কিংবা অনুকম্পা সহ্য হয় না তাঁর। অর্থহীন ক্রোধ আর ঘৃণার বিকারে ডুবে যান তিনি। নিজের পর্ষদ থেকে দরিদ্র প্রজা, রেহাই পায় না কেউ। জনগণকে পতিতালয়ে যেতে বাধ্য করার পাশাপাশি তাদের না খাইয়ে মারার জন্য শস্যাগার বন্ধের নির্দেশ দেন তিনি। তাঁর স্নেহ ও কৃপা প্রার্থীদের তিনি ঘৃণা করতেন আর প্রশ্রয় দিতেন ষড়যন্ত্রকারীদের। শেষ পর্যন্ত নিজের প্রিয়ভাজন রক্ষীদের হাতেই মৃত্যু হয় তাঁর।
নাটকের ক্যালিগুলা ইতিহাসের সম্রাট ক্যালিগুলার চেয়ে দূরবর্তী নন। তবে আলবেয়ার কামুর লক্ষ্য ইতিহাসকে ধরে রাখা নয়, বরং নিষ্ঠুর ব্যক্তির মধ্যে যে শূন্যতা আর পাগলামি আছে, সেটাই তুলে ধরা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় রচিত এই নাটক যেন হিটলারের মধ্যে ক্যালিগুলার পুনর্জন্মই দেখাতে চায়।
ক্যালিগুলা চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেছেন তরুণ অভিনেতা মুবিদুর রহমান। ইডিপাস কিংবা নওকর শয়তান মালিক হয়রান নাটকেও মুখ্য চরিত্রে ছিলেন তিনি। এবার যেন নিজেকেই ছাপিয়ে গেলেন।
নাটকের একটি দৃশ্যে তরুণ কবি স্কিপিও নিঃসঙ্গ ক্যালিগুলাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘তোমার আশ্রয় কিসে?’ ক্যালিগুলার উত্তর, ‘ঘৃণায়’। আসলেই তা–ই। আজকের পৃথিবীতে ঘৃণার মধ্যেই তো ক্যালিগুলা বারবার জেগে ওঠে। নাটক শেষ হলে এই উপলব্ধি নিয়ে ফিরে আসি।