গুডবাই সামার: কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আমাদের প্রজন্ম, সেই ষাটের দশক থেকে যাঁরা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তাঁদের জন্য এটি প্রত্যক্ষ জীবনাভিজ্ঞতা। এর প্রভাব, স্বীকৃতি, সম্মান তথা বিজয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে আমরা যখন আগরতলায়, দ্য স্টেটসম্যান এবং অন্য পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১ আগস্ট আয়োজিত রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’–এর কথা জানতে পারি। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের সহায়তার জন্য দেশের বাইরে অনুষ্ঠিত প্রথম কোনো কনসার্ট। এরপর ইতিহাস জানা–বোঝার চেষ্টা থেকে এ–সংশ্লিষ্ট নানা লেখা পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশ করেছি।

সে সময় আমাদের পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা কবি, লেখক, শিল্পী, গায়ক, সংস্কৃতিসেবী, বিজ্ঞানীসহ অন্যান্য সৃজনশীল মানুষ। আমাদের জীবনের সবচেয়ে দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। স্বাধীনতার পরে এই মানুষগুলোর ভূমিকা নিয়ে তুমুল আগ্রহের কারণেই ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’, মার্কিন গায়িকা জোয়ান বায়েজের লেখা ও সুরে ‘বাংলাদেশ’ গান, বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’–এর কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ও রাশিয়ার আন্দ্রেই ভজনেসেনস্কির কবিতা পাঠ অনুষ্ঠান ইত্যাদি নানা উদ্যোগের কথা জানতে পারি। এসব আয়োজন আমাকে ক্রমাগত মোহিত করতে থাকে এবং একধরনের দায়বদ্ধতা ও ভালোবাসা থেকে সেসব নিয়ে লিখতে উদ্যোগী হই। এরই ধারাবাহিকতায় একসময় জানতে পারি, ক্রিকেটের বিখ্যাত স্টেডিয়াম ওভালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যপীড়িত শরণার্থীদের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহের জন্য ‘গুডবাই সামার’ নামে একটি বিশাল রক কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের সেরা সব রক ব্যান্ড গান পরিবেশন করেছিল সেখানে। এই লেখা বিখ্যাত ওভাল গ্রাউন্ডের সেই কনসার্টটি নিয়ে—

এত দিন ধরে আমরা জানতাম ১ আগস্ট ১৯৭১ সালে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামে বড় কনসার্টটির কথা। পরে জানতে পারি জোয়ান বায়েজের ‘দ্য স্টোরি অব বাংলাদেশ’ গানটির কথাও। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ঘাঁটতে গিয়ে ১৩তম খণ্ডের ৬৫৬ পৃষ্ঠায় পেয়ে যাই একই বছরের ২০ নভেম্বর কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ও আন্দ্রেই ভজনেসনস্কি কবিতা পাঠ করেছিলেন এবং ১৪ নভেম্বর লন্ডনের এক অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসনসহ বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও লন্ডনের বেশ কয়েকজন গায়ক ও সংগীতজ্ঞ বাংলাদেশের জন্য কবিতা পাঠ, গান ও যন্ত্রসংগীত পরিবেশন করেছিলেন।

অতি সম্প্রতি জানতে পেরেছি, ওই বছরেরই ১৮ সেপ্টেম্বর ক্রিকেটের বিখ্যাত স্টেডিয়াম দ্য ওভাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের দারিদ্র্যপীড়িত শরণার্থীদের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহের জন্য ‘গুডবাই সামার’ নামের একটি বিশাল রক কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। লন্ডনের কেনিংটনে অবস্থিত ওভাল বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ইংল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেট খেলাগুলো এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। পূর্বে কেনিংটন ওভাল নামে পরিচিত মাঠটি ব্যবসায়িক অংশীদারত্বের কারণে এখন কিয়া ওভাল নামে পরিচিত।

আনরক ফেস্টিভ্যাল ডট কম সাইট, যেটি ওভালের অনুষ্ঠানের নানান তথ্য এবং ছবি সংরক্ষণ করেছে, সেটি থেকে সম্প্রতি আমরা জানতে পারি, বাংলাদেশের জন্য আয়োজিত সেই রক কনসার্টে দর্শক সমাগম হয়েছিল ৩৫ হাজারের মতো। মূল উদ্যোক্তা ছিল ‘কস্তুর’ নামের একটি দাতব্য সংগঠন। সে সময়ে দ্য হু, দ্য ফেসেস, মট দ্য হুপল, লিন্ডিসফার্ন, কুইনটেসেন্স, অ্যাটমিক রুস্টার, দ্য গ্রিস ব্যান্ড ও কোচিসের মতো ইংল্যান্ডের সেরা সব রক ব্যান্ড সেখানে গান পরিবেশন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছিল ব্যান্ড দল ‘আমেরিকা’।

২০০৭ সালের ৫ অক্টোবরে ইএসপিএন ক্রিকইনফো ডট কমে মার্টিন উইলিয়ামসন ‘দ্য ওভাল, ড্রাগস অ্যান্ড রক এন রোল’ শিরোনামের একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ওভালের সে অনুষ্ঠানটি চলেছিল বেলা ১১টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। রেফারেন্স হিসেবে তিনি দুটি বইয়ের নাম উল্লেখ করেন—ফেয়ারফিল্ড থেকে ২০০১ সালে প্রকাশিত স্টিফেন চকের লেখা অ্যাট দ্য হার্ট অব ইংলিশ ক্রিকেট ও ২০০৫ সালে ভিশন স্পোর্টস পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ডেভিড নরির ওভাল রিফ্লেকশনস। এ দুটি নিবন্ধ থেকে আমরা জানতে পারি, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার মধ্যে উপভোগ্য ওই দিনটি ব্রিটিশ রক ব্যান্ডের জন্য স্মরণীয় এক ইতিহাসের জন্ম দেয়। দর্শনার্থীদের জন্য টিকিটের দাম ধরা হয়েছিল দেড় পাউন্ড। ১৫০০০ পাউন্ড আয় হয়েছিল ওই কনসার্ট থেকে। সারে ক্রিকেট ক্লাব পেয়েছিল ৩০০০ পাউন্ড। ক্রিস চার্লসওয়ার্থ নামের এক ব্যক্তি নিজেকে ওই কনসার্টে থাকা দর্শক বলে দাবি করেন। তিনি বেশ কয়েকটি নিবন্ধ লিখেছেন। তাঁর নিজের ব্লগস্পটে প্রকাশিত ‘দ্য হু—দ্য ওভাল কনসার্ট ’৭১’ শিরোনামের একটি লেখা থেকে আমরা এ তথ্যও পাই, ব্যান্ড দল হু তাদের পেমেন্ট ফি ৯০০০ পাউন্ড দান করে দিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের জন্য। ভাবতেই হূদয় কেঁপে ওঠে, বাংলাদেশের নিপীড়িত, দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এত এত মানুষ!

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী রক ব্যান্ড হু পেছনে ফেলে দিয়েছিল অন্য দলগুলোকে

দুটি দলের পরিবেশনার মধ্যকালীন সময় কখনোই ১৫ মিনিটের বেশি ছিল না, অথচ বেলা এগারোটায় শুরু হয়ে টানা প্রায় ১১ ঘণ্টা ধরে চলেছিল কনসার্ট। অনুষ্ঠানের এমসি ব্রিটিশ ডিজে, ক্লাব প্রমোটার, রেকর্ড প্রযোজক ও সাবেক নৃত্যশিল্পী জেফ ডেক্সটার ছিলেন সম্পূর্ণ ক্রিকেটীয় ড্রেসে—সাদা পোশাক, সাদা প্যাড, গ্লাভস পরিহিত—হাতে ব্যাট। সে ব্যাট দিয়ে ড্রাম বাজিয়েছিলেন তিনি। সেই ব্যাট পরে ছুড়ে মারা হয় দর্শকদের মাঝে। ১৯৭০ সালে তিনি মার্কিন ফোক রক ব্যান্ড ‘আমেরিকা’র ম্যানেজার হন। গুডবাই সামার কনসার্টে আমেরিকার এই ব্যান্ড দলটিও অংশ নিয়েছিল। সেদিন তাদের পরিবেশনা দিয়ে গুডবাই কনসার্টের বিশেষ বিকেলটিকে তারা করে তুলেছিল আরও বিশেষ।

সত্তরের দশকে উত্থান হওয়া ইংলিশ কান্ট্রি রক ব্যান্ড দল কোচিস সকাল এগারোটায় কনসার্ট শুরু করে। এই দলটির প্রধান গায়ক ছিলেন স্টুয়ার্ট ব্রাউন, যিনি বেড়ে উঠেছিলেন বিখ্যাত গায়ক স্যার এলটন জনের সঙ্গে। পরে দুজন মিলে ব্লুসোলজি নামে অন্য একটি দলও গড়ে তুলেছিলেন।

কোচিসের পরেই মঞ্চে উঠে আসে দ্য গ্রিস ব্যান্ড নামের ব্রিটিশ রক ব্যান্ডের দলটি।

‘গুডবাই সামার’ কনসার্টের পোস্টার

অন্তর্জালে প্রকাশিত কয়েকটি নিবন্ধ ও আনরক ফেস্টিভ্যাল নামের সাইটটি থেকে জানা যায়, গুডবাই সামার কনসার্টের সেই অনুষ্ঠানটিতে ব্যান্ড দল হু ও ফেসেসের মধ্য ঠান্ডা একধরনের প্রতিভার রেষারেষি ছিল। স্বভাবতই উভয় দলই তাদের সেরাটা ঢেলে দিয়েছিল সে কনসার্টে। ফলে কনসার্ট জমে উঠেছিল আরও। মার্টিন উইলিয়ামসনের বর্ণনায় আমরা পাই, দর্শকেরা সেদিন এসেছিলেন বর্ণাঢ্য জিনস, টপস, ফ্রক ইত্যাদিসহ রংবেরঙের জামাকাপড় পরে। ভেতরে আসতে অসম্মতি জানিয়ে তত্কালীন সারে ক্রিকেট ক্লাবের সেক্রেটারি ও ইংলিশ ক্রিকেটার জিওফ্রে হাওয়ার্ডকে পুলিশ জানিয়েছিল, তারা বড়জোর বাইরে পাহারা দেবে।

সে অনুষ্ঠান নিয়ে লেখালেখি থেকে জানা যায়, ওভালে সেদিন ব্যান্ড দল হু আলাদা মাত্রার নতুন স্টেজ অ্যাক্ট ও স্পষ্টতর সাউন্ড সিস্টেম দিয়ে অন্য দলগুলোকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। যদিও এ ধরনের অনুষ্ঠানে দুটি দলের মধ্যে তুলনার কোনো মানে নেই। তবু সত্যি বলতে গেলে হু সেদিন হারিয়ে দিয়েছিল ফেসেসকে। হু বেশির ভাগ গানই গেয়েছিল তাদের নতুন অ্যালবাম থেকে, দর্শকদের জন্য যেটা ছিল একদমই নতুন। এই কনসার্টেই প্রথম গানগুলো শোনার সৌভাগ্য হয় তাঁদের। ‘সামারটাইম ব্লুস’ দিয়ে যখন তারা কনসার্ট শুরু করে, গানটি সরাসরি দর্শকদের হূদয়ে আঘাত করেছিল। সে আঘাতের প্রতিক্রিয়া যেন প্রবাহিত হয়েছিল দর্শকদের মধ্যেও। তাঁরা ক্রমাগত কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন, নাচছিলেন আর গাইছিলেন।

হু নামের ব্যান্ড দলটি গড়ে ওঠে ১৯৬৪ সালে লন্ডনে। প্রধান গায়ক রজার ড্যাল্ট্রে, গায়ক পিট টাউনশেন্ড, বেস গিটারিস্ট জন এন্টউইসল এবং ড্রামার কিথ মুনের ক্ল্যাসিক লাইন আপ তাদের বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী রক ব্যান্ডের পরিচিতি এনে দেয়। সারা বিশ্বে তাদের ১০ কোটি রেকর্ড বিক্রিই এর বড় উদাহরণ।

রড স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে ওভালে ফেসেস ব্যান্ড

দ্য ডিট্যুরস নামের গানের একটি দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গঠন করা হয়েছিল হু। দলটি পপ আর্ট ও মড মুভমেন্টের অংশ হিসেবে নানান গানের অনুষ্ঠানে একধরনের ধ্বংসাত্মক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করত। ওভালেও পিট টাউনশেন্ড তার নিখুঁত আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমা দিয়ে নিজেকে ওই কনসার্টের সেনাপতি হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। একসময় হু গাইতে শুরু করে তাদের গান ‘জেনারেশন’। সে সময় টাউনশেন্ড উন্মাদের মতো লাফিয়ে মঞ্চে উঠে আসেন। গান গাইতে গাইতে তিনি ছোট ছোট বৃত্তাকারে ঘুরতে শুরু করেন। হঠাত্ একদম নতুন গিবসন গিটার দিয়ে আঘাত করেন নিজের মাথায়। ওই দিনই কেনা হয়েছিল গিটারটি। সেটি ভেঙে গিয়েছিল এবং ভাঙা টুকরোগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল দর্শকদের মাঝে। তিনি ‘ন্যাকেড আই’ (যেটি তখন পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়নি) দিয়ে শুরু করে ‘ম্যাজিক বাস’-এ এসে থামেন। আক্ষরিক অর্থেই ম্যাজিক ছড়িয়েছিলেন তিনি সে অনুষ্ঠানে।

রজার ডাল্ট্রে

ঢাকা ট্রিবিউন লন্ডনের ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের সচিব নিয়াজ আলমের নেওয়া এক সাক্ষাত্কারে পিট টাউনশেন্ড জানান, কনসার্টটি তাঁর পুরোপুরি মনে না থাকলেও ঘটনাটি মনে আছে। পিটের ভাষ্যে আক্ষরিক অর্থেই তাঁরা পুরোপুরি মাতাল ছিলেন সেদিন। রড স্টুয়ার্টের প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, সেদিন রড ভিড়ের মধ্যে ৫০০ ফুটবলে লাথি মেরেছিলেন, যেটি দর্শকদের অনেকক্ষণ ধরে মাতিয়ে রেখেছিল। তিনি জানান, সেবার তাঁরা দাতব্যকাজে অনেকগুলো অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। ওভাল কনসার্ট নিয়ে রড স্টুয়ার্ট বলেন, ‘তাঁরা ছিলেন আমাদের লোক।...লন্ডনে নানান জাতির লোকজন এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রায় ১০ হাজার সোমালীয় এসেছে। সুতরাং সেখানে আসলে ছিলেন আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাই। বাংলাদেশিরা কাজপাগল। কঠোর পরিশ্রম করতে পারে তারা। এ কারণে আমরা তাদের শ্রদ্ধা করতাম, ভালোবাসতাম। আমরা মূলত তাদের সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। এটা ছিল ভয়াবহ ঘটনা। এ পরিস্থিতিতে তাদের সাহায্য করতে পেরে আমরা সম্মানিত বোধ করেছি।’

ক্রিস চার্লসওয়ার্থের ‘হু রিটেইন টাইটেল অ্যাট ওভাল’ শিরোনামের একটি লেখায় (চার্লসওয়ার্থের দাবিমতে লন্ডনের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক লেখা থেকে তিনি লেখাটি লিখেছেন; আনরক ফেস্টিভ্যাল ডট কমেও এটি পাওয়া যায়) জানা যায়, গ্রিক দেবীর মতো একমাথা চুলের ডাল্ট্রে মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ডটি ধরে ছিলেন, ড্রামার মুন তাঁর ড্রামটিকে বাজাচ্ছিলেন চরম নির্দয়ভাবে। মুনের শরীরে যেন প্রেতাত্মা ভর করেছিল সেদিন। ড্রামের স্টিকগুলো কোথায় ছিটকে গিয়েছিল, কেউ জানে না। শুধু জন এন্টউইসল ছিলেন শান্ত। তিনি নীরবে দেখছিলেন আর একমনে বাজিয়ে যাচ্ছিলেন তার গিটারটি।

বিপরীতে দ্য ফেসেস নিজেদের উপস্থাপন করেছিল বন্ধুত্বের বার্তাবাহী একদল দূত হিসেবে। স্বাভাবিকভাবেই রক কনসার্টের মতো একটি কনসার্ট দর্শকেরা উন্মাদনাকেই অধিক সাদরে গ্রহণ করে। একটি চিতাবাঘের চামড়ার স্যুট পরে মঞ্চে উঠেছিলেন রড স্টুয়ার্ট (স্যার রডেরিক ডেভিড স্টুয়ার্ট), যেটি পরে তিনি বাংলাদেশের সহায়তায় নিলামে তোলেন এবং ৫০০ পাউন্ড সংগ্রহ করেন। গ্র্যামি ও ব্রিট অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী ব্রিটিশ গায়ক ও গীতিকার, সর্বকালের সেরা জনপ্রিয় শিল্পীদের একজন রড স্টুয়ার্ট (জন্ম ১০ জানুয়ারি ১৯৪৫) ছিলেন গুডবাই সামার কনসার্টের প্রধান আকর্ষণ। ষাট ও সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে প্রথমে দ্য জেফ বেক গ্রুপ, পরে ফেসেস ব্যান্ডে যোগ দিয়ে স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরের রড স্টুয়ার্ট সবার দৃষ্টি কাড়েন এবং জনপ্রিয়তার শীর্ষে আসেন। ২০০৮ সালে বিলবোর্ড ম্যাগাজিন তাদের ‘বিলবোর্ড হট ১০০ অলটাইম টপ আর্টিস্ট’-এ তাঁকে সর্বকালের সফলদের মধ্যে ১৭তম ঘোষণা করেছিল। ১৯৯৪ সালে রিও ডি জেনিরোতে একটি বৃহত্তম কনসার্টে তিনি ৩৫ লাখ দর্শকের সামনে ফ্রি স্টেজ পারফর্ম করেছিলেন।

শনিবারের সেই দিনটিতে রড স্টুয়ার্টের নেতৃত্বেই ফেসেস ব্যান্ড দাঁড়িয়েছিল ওভালে। সে সময়ের ব্রিটিশ কি-বোর্ডিস্ট আয়ান ম্যাকল্যাগান, বেস গিটারিস্ট ও ভোকাল রনি লেন, ড্রামার ও পারকাসনিস্ট কেনি জোনস, গিটারিস্ট রনি উড ও রড স্টুয়ার্ট মিলে ১৯৬৯ সালে গড়ে তোলেন ব্যান্ড ফেসেস। রড স্টুয়ার্ট ছিলেন দলটির প্রধান গায়ক।

দর্শকেরা সেদিন এসেছিলেন বর্ণাঢ্য জিনস, টপস, ফ্রক ইত্যাদিসহ রংবেরঙের জামাকাপড় পরে

গুডবাই সামার কনসার্টে রনি উড ‘প্লিথ’ ও ‘ম্যাগি মে’ গান দুটিতে দুর্দান্ত গিটারের কাজ দেখিয়েছিলেন। স্টুয়ার্ট তখন একজন ‘ড্রাম-মেজর’-এর মতো হাতের মাইকস্ট্যান্ডটি দোলাতে দোলাতে মঞ্চের চারপাশজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। ‘লুজিং ইউ’ দিয়ে তাঁরা তাঁদের সেদিনের প্রদর্শনীর সমাপ্তি ঘোষণা দিয়েছিলেন। অবশ্য পরে আবার এসে ‘ফিল সো গুড’ গানটি করেছিলেন তাঁরা। দ্য ফেসেসই ছিল একমাত্র দল, যারা দ্বিতীয়বারের মতো মঞ্চে উঠেছিল সেদিন। সামর্থ্যের প্রতিটি বিন্দু তারা ঢেলে দিয়েছিল সেদিন বাংলাদেশ নামের ছোট একটি দেশের মানুষের সমর্থনে আয়োজিত ওভালের সেই কনসার্টটিতে।

অসামান্য প্রশংসা পাওয়া লিন্ডিসফার্ন নামের গানের দলটি যখন মঞ্চে উঠে আসে, পিএ সিস্টেমের (পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম) কোনো একটা ত্রুটির কারণে তারা খানিকটা সমস্যায় পড়েছিল। অ্যালান হালের কণ্ঠও সামান্য কমই শ্রুতিমধুর শোনাচ্ছিল। ভোকাল, গিটারিস্ট ও পিয়ানিস্ট অ্যালান হাল, ভোকাল, ম্যান্ডোলিন ও হারমোনিকাবাদক রে জ্যাকসন, কি-বোর্ডিস্ট, গিটারিস্ট, ম্যান্ডোলিন ও ব্যাঞ্জোবাদক সিমোন কাউই, বেস গিটারিস্ট ও বেহালাবাদক রড ক্লেমেন্ট এবং ড্রামার রে লেইডল মিলে ১৯৬৮ সালে গড়ে তুলেছিলেন লিন্ডিসফার্ন ব্যান্ড। ‘নাইসলি আউট অব টিউন’, ‘ফগ অন দ্য টাইন’ অ্যালবামগুলো তাদের খ্যাতি এনে দিয়েছিল।

ভারতীয় সংগীত প্রভাবিত জ্যাজ, সাইকেডেলিক ও প্রগ্রেসিভ রকের মিশ্রণে ’৬৯-এর এপ্রিলে গড়ে ওঠা রক ব্যান্ড কুইন্টিসেন্স মূলত সম্পূর্ণ আলাদা একটি স্বাদ দিয়েছিল দর্শকদের। বেস গিটারিস্ট শম্ভু বাবাজি, রিদম গিটারিস্ট মহাদেব, কি-বোর্ডিস্ট, পার্কাসনিস্ট ও ভোকাল শিবশঙ্কর জোনস, পার্কাসনিস্ট ও ড্রামার জেক মিল্টন, লিড গিটারিস্ট অ্যালান মস্টার্ট ও পার্কাসনিস্ট, বাঁশিবাদক রাজা রামের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ব্যান্ডটি তুমুল খ্যাতি অর্জন করেছিল সে সময়। গুডবাই সামার কনসার্টেও ৪৫ মিনিটের জন্য মঞ্চ মাতিয়ে রেখেছিল কুইন্টিসেন্স।

এই কনসার্টে আগত দর্শকদের সামান্যও ঝিমিয়ে পড়তে দেয়নি সত্তরের দশকে ‘অল দ্য ইয়ং ডুডস’ গান দিয়ে খ্যাতির শিখরে পৌঁছানো আরেকটি রক ব্যান্ড ‘মট দ্য হুপল’। বিকেলের সেশনটিতে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তারা দর্শকদের।

অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত আইরিশ গীতিকার ও গায়ক ইউজিন ওয়ালেসও গেয়েছিলেন গুডবাই সামার কনসার্টে। তাঁর দুর্ভাগ্য যে তার মতো অসাধারণ হূদয়নিংড়ানো শিল্পীকে সে সময়ের বিখ্যাত গায়ক জো ককারের সঙ্গে তুলনা করা হতো। জো ককারের ছায়াতেই তিনি আড়ালে পড়ে ছিলেন। গুডবাই সামার কনসার্ট তাঁকে আবার আলোয় নিয়ে এসেছিল।

পিট টাউনশেন্ড ছিলেন ওই কনসার্টের অঘোষিত সেনাপতি

ব্রিটিশ রক ব্যান্ড অ্যাটমিক রুস্টার তো এই কনসার্টের জন্য তাদের আমেরিকা সফর বাতিল করেছিল। তাদের ইতিহাস বৈচিত্র্যময়। এই দলটিতে ভিনসেন্ট ক্রেনই একমাত্র সদস্য, যিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন। অ্যাটমিক রুস্টারের বেশির ভাগ গানও তাঁরই লেখা। তাদের জনপ্রিয় ও হিট অ্যালবাম ‘ডেভিল’স আনসার’ ও ‘টুমরো নাইট’ ১৯৭১ সালে ইউকে টপচার্টে যথাক্রমে ৪ ও ১১ নম্বর অবস্থানে ছিল। অন্য বেশির ভাগ দলের মতো অ্যাটমিক রুস্টারও কনসার্টের দিন দুর্বল সাউন্ড সিস্টেমের শিকার হয়েছিল।

সৌভাগ্যক্রমে পুরো সন্ধ্যাটা আক্ষরিকভাবেই পাল্টে দিয়েছিল ব্যান্ড দল হু এবং দ্য ফেসেস। আগত দর্শকদের রঙিন, বর্ণাঢ্য ওই পোশাকের মতোই গুডবাই সামার কনসার্টটিও হু এবং ফেসেসের কারণে হয়ে উঠেছিল তুমুল কোলাহলপূর্ণ, উন্মাদনাময় ও বর্ণাঢ্য। রাতে যখন বিস্তীর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল রংধনুর মতো আলো, দর্শকেরা চিত্কার করে, দুহাত নাড়িয়ে উল্লাস করছিলেন।

বাংলাদেশের এক চরম দুঃসময়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশ্বনন্দিত শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি বা গায়কেরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন হূদয় দিয়ে। তাঁরা গলা খুলে চিত্কার করে গান করেছেন বাংলাদেশের পক্ষে। সে চিত্কারে এগিয়ে এসেছেন বিদেশিরা। বাংলাদেশকে নিয়ে বাঁধা তাঁদের সুর পৌঁছেছে বিশ্ববাসীর কাছে। দুর্ভাগ্যক্রমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই বন্ধুদের অনেক কিছুই আমাদের কাছে পৌঁছায়নি, আমরা জানতে পারিনি। ওভালে অনুষ্ঠিত ‘গুডবাই সামার’ কনসার্ট ছিল তেমন একটি কার্যক্রম। সেই বিদেশি গায়কদের জন্য আমাদের ভালোবাসা অমলিন থাকবে।

তথ্যসূত্র:

  • বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, ১৩তম খণ্ড

  • ঢাকা ট্রিবিউন

  • www.ukrockfestivals.com/goodbye-summer-1971.html

  • www.espncricinfo.com/

  • justbackdated.blogspot.com/2014/03/the-who-faces-at-oval.html

  • justbackdated.blogspot.com/2013/12/the-oval-concert.html

  • www.thewholive.net/review/readreview.php?id=77