রাজধানীর বনশ্রীতে গৃহকর্মী লাইলী বেগমের (২৬) রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় গৃহকর্তা ও দারোয়ানকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এদিকে গ্রেপ্তার হওয়া গৃহকর্ত্রীর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল শনিবার ময়নাতদন্ত শেষে লাইলীর মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

গত শুক্রবার বনশ্রীর ৪ নম্বর সড়কের জি ব্লকের একটি বাসায় লাইলীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। লাইলীকে হত্যার অভিযোগ এনে তাঁর পরিবার ও এলাকার লোকজন ওই বাড়িতে হামলা চালায় এবং গাড়ি ভাঙচুর করে। দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ।

ওই ঘটনায় শুক্রবার রাত ১১টার দিকে খিলগাঁও থানায় দুটি মামলা হয়। লাইলীর ভাশুর শহীদুল ইসলাম বাদী হয়ে গৃহকর্তা মঈনুদ্দিন, গৃহকর্ত্রী শাহানা বেগম ও দারোয়ান তোফাজ্জল হোসেনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মঈনুদ্দিন ও তোফাজ্জলকে শুক্রবারই গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আর শাহানাকে গতকাল বেলা দেড়টায় গ্রেপ্তার করা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খিলগাঁও থানার এসআই মঞ্জুর রহমান বলেন, গতকালঢাকা মহানগর হাকিম এ কে এম মাঈনুদ্দিন সিদ্দিকীর আদালতে দুজনকে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। আদালত মঈনুদ্দিন ও তোফাজ্জলের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আর গৃহকর্ত্রীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

স্থানীয় লোকজনের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে অপর মামলাটি করেছে পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খিলগাঁও থানার এসআই আমিনুল ইসলাম বলেন, এই মামলায় এজাহারনামীয় ৩৭ জন আসামি ছাড়াও অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। ৩৭ জনের মধ্যে আবদুল হাকিম, ছোট মিয়া ও বাহার নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

এদিকে লাইলীর স্বজনেরা জানিয়েছেন, বাড়ির মালিকের সঙ্গে বকেয়া বেতন নিয়ে ঘটনার আগের দিন লাইলীর ঝগড়া হয়। শুক্রবার তাঁর বেতন দেওয়ার কথা ছিল। এর জের ধরেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে তাঁরা অভিযোগ করেন।

লাইলী তাঁর দুই শিশুসন্তান নিয়ে বনশ্রীর পাশে হিন্দুপাড়া বস্তিতে ননদ জাহানারা বেগমের সঙ্গে থাকতেন। লাইলী যে বাড়িতে কাজ করতেন, সেই বাড়ি থেকে বস্তিটি তিন-চার মিনিট হাঁটার পথ।

গতকাল ওই বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, লাইলীর এক ছেলে আতিকুরকে কোলে নিয়ে বসে আছেন জাহানারা বেগম। তিনি বলেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মানুষের বাসায় কাজ করতেন লাইলী। প্রতিদিন রাতে ওই বাসা থেকে ভাত নিয়ে ফিরতেন। ঘটনার আগের দিন (বৃহস্পতিবার) রাতে তিনি ভাত নিয়ে ফেরেননি। বকেয়া বেতনের টাকা চাওয়ায় বাড়ির মালিক ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বলে জানান। পরের দিন লাইলী আবার কাজের উদ্দেশ্যে বের হন। সকাল ১০টার দিকে তাঁর মৃত্যুর খবর আসে। তিনি আগের রাতে বা ভোরে লাইলীর মধ্যে কোনো হতাশা বা মনমরা ভাব দেখেননি।

একই বস্তিতে থাকা লাইলীর জা শাহনাজ বেগম প্রথম আলোকে বলেন, মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁরা যখন বাচ্চা দুটিকে নিয়ে ওই বাসায় যান, তখন বাড়ির মালিক ও তাঁর ছেলে তাঁদের আটকে রাখেন। তখন সেখানে পুলিশের সদস্যরাও ছিলেন। বাড়ির মালিক ও তাঁর ছেলে তাঁদের একটি সাদা কাগজে সই দিতে বলেন। কিন্তু তাঁরা তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। একপর্যায়ে জোর করে তাঁরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন।

জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মঞ্জুর রহমান বলেন, লাইলীর বেতন বকেয়া ছিল এটা তাঁরা নিশ্চিত হতে পেরেছেন। ওই দিন কাজে যাওয়ার পর লাইলীর সঙ্গে ওই বাড়ির মালিক বা তাঁর স্ত্রীর কোনো ঝামেলা হয়েছিল কি না, সেটা তাঁরা জানতে পারেননি।

পুলিশের করা সুরতহালের প্রতিবেদনে লাইলীর গলার ‘ডান পাশে সামান্য অর্ধচন্দ্রাকার দাগ’ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া শরীরে আর কোনো দাগ নেই। গতকাল বিকেলে তাঁর ময়নাতদন্তের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, লাইলীর গলায় কালো দাগ ছিল। তাঁর মাথায় সামান্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাঁর গলা থেকে টিস্যু নেওয়া হয়েছে। আত্মহত্যা না হত্যা তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। সব পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়ার পর বোঝা যাবে।